ছেলেদের ব্রতকথা : রঙ্গন রায়
ছেলেদের ব্রতকথা : রঙ্গন রায়
আলোচনায় : মনীষিতা নন্দী
"ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চনফুল, ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল"; বসন্তের আবহ চারপাশে। এমন আবহে কবি রঙ্গনের বইটি উল্টেপাল্টে দেখতে গিয়ে মলাটের হালকা নীলচে বেগুনী ছোঁয়াতে মনে মনে কাঞ্চনফুলের ছবি আঁকি। কবিতামালার প্রাক সূচনা ও তর্পণে, সেই কাঞ্চনফুলের সুগন্ধেই "ছেলেদের ব্রতকথা" উৎসর্গিত হয়, কবির "স্বর্গত উইমা (দিদিমা)", শ্রীযুক্তা সুষমা সিনহার পাদপদ্মে। কবিতার শরীরে শরীরে ঘিরে থাকে, মা, বাবা, দিদিমা, জ্যেঠু, জ্যেঠিমা কিংবা নাম জানা ও অজানা প্রেমিকাদের মত পারিবারিক, শহুরে, আটপৌরে, আদুরে, কিছু বিন্দু বিন্দু প্রাণের আরাম। রঙীন - ধূসর ছবিতে মুগ্ধতা নিয়ে ভেসে থাকি, কবির শরৎ - বসন্তের সর্বমোট সাতষট্টিটি সৃষ্টিতে। কবিতা যাপনে। আন্দোলনে। 'সাতষট্টি' এখানে সংখ্যা মাত্র। সংস্পন্দন ও তার ব্যাপ্ত রেশ এর অভিব্যক্তিই কবিতাদের মূল চিত্ররূপ, যেখানে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় ভাবনাদের ডালপালা বিস্তারের এক আকাশ অবকাশ। বইয়ের ওপরে, প্রচ্ছদপটে চোখ রাখলেই দোলা দেয় কবির কথন, "বিগ্রহে পা দিলে মাথা দিতে হয়। শরীরে পা দিলে মাথা দিতে হয়। মাটিতে পা দিলে মাথা দিতে হয়না।" "পায়ের কাছে, মাথার কাছে চিরজীবন মাটি হয়ে" থেকে যাবার মত কিছু নিজের নিয়ম নিরন্তর নিজে গড়তে চেয়েছেন কবি। যেন বলছেন, তাঁর সৃষ্ট এই নিয়মগুচ্ছ, ধরা দেবে তাঁরই ব্রতকথা হয়ে। 'যোগাযোগ' কবিতাতে বিস্তৃত দেশকাল, পরিবার, পৃথিবী ছাপিয়ে, মধ্যগগন থেকে শোনা যায়, আমার 'আমি'র বিচ্ছিন্ন অনুভব, পারিপার্শ্বিকের তীব্র বস্তুবাচক প্রভাব; যাবতীয় মনঃসংযোগ, আধ্যাত্মিকতা থেকে দূরত্ব রচনা ক'রে, বিচ্ছিন্ন একাকীত্বে মুছে দেয় অবশেষের ঈশ্বর স্পর্শটুকুও। "একটা দূরত্ব হয়ে যায় বলেই, আমার কাছে ঈশ্বর এসে পৌঁছয়না।" "একটি ১২ লাইনের কবিতা" তে, কবির মতে, সংখ্যাগতমান যখন গুণগতমানের উর্দ্ধে উঠে যায়, তখন বিশেষ ক'রে কবিতার ক্ষেত্রেও যেন সবকিছু প্রয়োজনেরও বেশী মাত্রায় পেয়ে যাবার দুর্ভিক্ষ তৈরি হয়। মুড়ি - মুড়কির মত দোকানে মিলতে থাকে কবিতা। সংখ্যায় অনেক। গুণমান কহতব্য নয়। ঘরে ঘরে বেনোজলে ভাসমান কবির দেখা মিলতে থাকে। "বিধাতার রাজ্যে ভালো জিনিস" খুব বেশী রকম হ'তে গিয়ে 'মাঝারি'র ভারে টালমাটাল পৃথিবী। "এরপর বাজারে পটলের দোকানে পাওয়া যেতে লাগল কবিতা। সকলে পটলের দোর্মার বদলে খেতে লাগল কবিতার দোর্মা।" "জুলাই মাসের কবিতা" জুড়ে বর্ষা জলে থইথই ভালোবাসা। কখনও লোডশেডিং কিংবা শ্রাবণ - ঘন - গহন মেঘের কালো চাঁদোয়া - ক্যানভাস স্বেচ্ছায় বিছিয়ে নেয়, "অন্ধকার ব্যালকনি", কখনও "গালের মসৃণতায় পিছলে যাচ্ছে আলো", কখনও "টিউশন ফেরত ছাতা নিতে ভুলে যাওয়া", 'ওর্ণা মাথায়' মেয়ে; বৃষ্টিতে মাখামাখি শব্দ - কথায় সার্থক ক'রে তোলে কবির ভরভরন্ত - নান্দনিক আষাঢ়ে কিংবা শ্রাবণী জুলাই। স্মৃতি রোমন্থক কবি, "যেন এক্ষুনি কাগজ নিয়ে নেমে" পড়বেন 'শৈশবে'র অপেক্ষারত নৌকায়। শৈশব থেকে কৈশোর পথের প্রেম বলে, "ব্যালকনি থেকে তুমি এখনও ভালোবাসছ বলেই জুলাই মাস সার্থক হয়ে উঠছে।" "শহরের স্মৃতি" কবিতায় মুহূর্তে মুহূর্তে বর্তমানের বিন্দুগুলো অতীত ছবি এঁকে যেন আরো জীবন্ত দৃশ্যায়ন ঘটাচ্ছে, যেমন একটা পুরো শহরের টুকরো টুকরো ঘটে যাওয়া ঘটনাক্রম, যেখানে কবির একেবারে ভেতরকার সেই সত্য মানুষটিই 'নায়ক' কিংবা 'মুখ্য'। তাঁর চোখেই রচিত হচ্ছে অপূর্ব এক চিত্ররূপকল্প। সেখানে সাংঘাতিক প্রভাবে চক্রাকারে ঘুরে ফিরে এসে স্মৃতিরা বলে "প্রাচীন রাস্তা থেকে সেই গত শীতের মত আগেকার হাওয়া ...... আমাদের বিলম্বটুকু শুধু কয়েনের ওঠা নামায়।" অন্যদিকে চূড়ান্ত অপ্রেম, শূণ্যতা, অগোছালো মন, একাকীত্বের হাহাকার, কিছু ঘৃণা, কিছু এমনিই ভালো না লাগার কথা ছুঁয়ে যায় "ডিয়ার বিয়ার" কবিতাকে। নির্দ্বিধায় তাই কবির উচ্চারণ, "এই মুহূর্তে আমার কোনও রকম প্রেম পাচ্ছে না। সত্যি কথা। এই চাঁদের আলো আলোচিত হ'বে না।" অনেকটা যেন "প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য" - এর প্রেক্ষিতে ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে উচ্চারিত স্বতঃস্ফূর্ত রক্তক্ষরণ। "যখন পেরোচ্ছি টীনএজ" - কবিতার প্রথম পর্বে কবির কাছে বয়ঃসন্ধি যেন হঠাৎ নেমে আসা এক মহাসমারোহের ঝড়; "সেই যে শীতের দুপুরে বাসের স্টিয়ারিং লক হয়ে গেল।" একটা অনির্দিষ্ট অপ্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা, কবির কথায়, "পরবর্তী বাসের অপেক্ষা।" আদৌ সে অনির্দিষ্ট নামের কোনো বিন্দুতে পৌঁছতে পারা যাবে কিনা, ভেবে ভেবে জ্বলতে থাকে হৃদয়, পুড়তে থাকে শরীর, মন, বিবর্তন - পরিবর্তনে। হঠাৎ বড় হয়ে যাবার বিস্ময়ে হতবাক চিত্তে, স্মৃতিরা এসে ব্যথার গান লেখে, "যেন চকচক করছে আমার শৈশব, এক্ষুনি মুখ দিয়ে শিশুর গন্ধ ভেসে উঠবে - দু'হাত ভর্তি আলো নিয়ে বাবা এগিয়ে আসবেন আমার দিকে।" "যখন পেরোচ্ছি টীন এজ" - এর দ্বিতীয় পর্বে, প্রথম পর্বের রেশ ধরেই স্মৃতিছবির ডালপালা বিস্তারে আবারও মনকেমন আঁকে বয়ঃসন্ধি চোখ। কবিতার দেওয়াল জুড়ে ছড়িয়ে আছে, ন্যাপথালিনের গন্ধ, মায়ের কথা। "ট্রাঙ্ক ছোটো হয়ে যাচ্ছে ..... মা কোনওদিনই চুপচাপ ট্রাঙ্ক খুলতে পারেনা অথচ দেখো কত নিঃশব্দে আমি বড় হয়ে যাচ্ছি।" 'হলদিবাড়ি' কবিতায় 'আমাদের হাটের 'গন্ধটা', ''প্যাচপেচে কাদা", "গড়িয়ে আসা থেঁতলে যাওয়া আলু", "ধর্মের ষাঁড়", "কালোজিরে - পাঁচফোড়ন", "অর্শ - ভগন্দরের লিফলেট", 'গুগলি', "থলিতে ইঁদুর মারার ওষুধ" - এমন নানা স্বাদের উপাদান ও টুকরো টুকরো শব্দ - শব্দবন্ধ মিলে আস্ত সংগ্রামী জীবনগাথা নির্মাণ হয় কবির কলমে। কবিতাটির শেষে সামাজিক নির্মাণে 'আদর্শ' শ্রেণিবিন্যাসের কাঠামোকে সরাসরি প্রশ্নের মুখে রেখে কবি বলেন; "সস্তায় গ্লাসে গ্লাসে স্বাধীনতা বিক্রি হয়, ওটাই খুঁজছি তখন থেকে, ঐ অনেকক্ষণ ধরেই সস্তার মোটা চাল খুঁজে চলা আদিবাসী মেয়েটির মত।" "আমার বিড়বিড় করা কথাগুলি - ১" এ কবির কলম লিখছে, পৃথিবীর ক্রমশঃ "ছোটো হ'তে হ'তে" বোকাবাক্স থেকে এখন সোশাল সাইট, টেকনোলোজির কাছে দাসত্বে নিমজ্জনের কথা। চলছে, বাজারদরের ওপর ভিত্তি ক'রে, ভাব - ভালোবাসা আদানপ্রদান। দূরত্ব যেন সবচেয়ে বড় সত্য এখন। "একে অপরের শরীরে যতটুকু ভালোবাসা ছিল, ভাসিয়ে দিয়েছি সোশ্যাল সাইটে".....। 'শূণ্যতা'ই একমাত্র, যে ছেড়ে না গিয়ে আরো বেশী আঁকড়ে ধরছে শরীর - মন থেকে মাথা - হৃদয় - কন্ঠ। কবি বলেন "এই অপূর্ব বিছানায় আমি বিশাল শূণ্যতাকে জাপটে রয়েছি শুধু।" বয়ঃসন্ধির শেষ অংশে জটিলতার শীর্ষে পৌঁছে মৃত্যুচিন্তা লেখে "আমার বিড়বিড় করা কথাগুলি - ২" কবিতাটি। যেন "বাঁচতে হ'বে, বাঁচতে হ'বে" এমন দৈববাণী শোনা যায়। কিন্তু কীভাবে? সে ব্যাখ্যা নিবদ্ধ থাকে কেবল "বিড়বিড় করা কথায়" বা কবির স্বগতোক্তিতেই, "অথচ বেঁচে থাকাটা আমার কাছে, ইয়ার্কি ছাড়া আর কিছু নয়।" "বিড়বিড় করা কথাগুলি" - এর তৃতীয় পর্বে ব্রতকথা দিয়ে কবি মনের মত ক'রে ইচ্ছেপূরণের 'প্রেমিক' ছবি আঁকেন। তিনি বলেন, বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত তাঁরাই, "যার চালের ফুটো দিয়ে গড়িয়ে নামে সংসার.... তাদের আমরা প্রেমিক বলে চিহ্নিত করি।" এরই চতুর্থ পর্বে, ব্রতকথা লিখতে গিয়ে মির্জা গালিবকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছেন কবি। অনুপ্রেরণার আদর চাদরে শরীরে মেখে নিচ্ছেন; "তবু ইদানীং আমি সব কিছু ভালো লাগাতে শিখেছি, প্রতিটি ঘটনাই আসলে গালিবের কবিতার মত।" আমার 'আমি' কে আলাদা ক'রে রেখে, দূর থেকে প্রেম চশমায় জীবনকে দেখতে যেন ঠিক সেই স্বপ্নের অপ্সরার মত, যে নারীর ওপর অভিমানী হয় মন, মৌনতার খেলা খেলতে ইচ্ছে হয়। এই মৌনতাও ঠিক বয়ঃসন্ধির ব্রতকথা যেন। সেই জীবনই যখন আর নেই "ফুলের মত", তখন প্রেমিক থেকে কবি কখনও 'বাবা', আর তারপরেও কখনও হয়তো জীবনকে হারিয়ে ফেলে মৃত্যুর মত সুস্পষ্ট বিচ্ছেদী গান বাজতে থাকে, 'মার্গ' কবিতায়; "শুধু স্বপ্ন দেখব - আমার প্রথম লেখা প্রেমপত্র তুমি দূরে বসে পড়ছ, পাতার কোণে জমা শিশির বিন্দুর মত টলমল করছি আমি।" "এইসব চুপথাকা" তে 'কৃষ্ণকলি' গাইতে গাইতে কবির ব্রতকথা বলে, "ওহে কৃষ্ণাঙ্গী মেয়ে, তোমার দিকে দৃষ্টি দিইনি কখনও। তুমি দিদিমণির মত ভালোবেসেছ শাসনের আড়ালে, চশমার আড়ালে।" বাহ্যিক মৌনতার ভেতরঘরের ছটফটানি লেখে কবির প্রেম। ঠিক যেন মুক্তবেণীর মত খেলে বেড়ায় কৃষ্ণকলির "পিঠের 'পরে"। যে কবিতায় "বিড়াল চলে গেছে", সেখানে সবটুকু ছেলেবেলাকে আর স্মৃতিকে খুঁচিয়ে তুলতে থাকে, "রান্নাঘর থেকে" বারবার ভেসে আসা "পাঁচফোড়নের গন্ধ", কিংবা এমন শব্দ - বাক্যবন্ধ; "মা এখনও মাছ কোটেনি বলে বিড়ালেরা শুধুই চলে যায় আমায় ছেড়ে।" যে বয়সের পথের হাওয়ায় ভেসে চলেছেন কবি, সে বয়সে হঠাৎ খুব বড় হয়ে যাওয়া কিংবা প্রেমিক কিংবা সেই দুষ্টু মিষ্টি ছেলেবেলার ভোরে ফিরে যেতে না পারা, নিজের মনকে ঠিকভাবে না জেনেই, ঠিক মনের মত প্রেমিকার খোঁজে, অন্তরমহলে নিরন্তর এক বাঁধনছাড়া উথালপাথাল; সেই সবটা নিয়ে কবির কলম, ইতিহাস - সত্য - বাস্তব - এই তেরঙা ফুলে নিত্য বিচরণী মালা গাঁথে; "বিড়ালের পায়ের দাগ আমাদের নেপোলিয়নের কথা মনে পড়ায়।" "মার্চ মাসের কবিতা - ১", মিষ্টি বাসন্তিক সকালের প্রেম লেখে; "আমাকে মনে করায় গ্রাম বিকেল হচ্ছে, গরুর ক্ষুরে ধুলোর মত ধূসর হয়ে যাচ্ছে সব। দেখছি কীভাবে বৃদ্ধ অন্ধ প্রেমিক, বৃদ্ধা প্রেমিকার হাত ধরে ভিক্ষা করছেন।" "মার্চ মাসের কবিতা - ২" কে ধরে নেওয়াই যায়, কোনো এক রঙের দিনের সন্ধ্যেকথার অগোছালো ছবি লেখা। ঠিক যেন ভাসা ভাসা দৃশ্যপটে ঘষা কাঁচের ক্যানভাস। মার্চ মাসের তৃতীয় কবিতা, এক দীর্ঘস্থায়ী 'চুপকথা'র ভেতর দিয়ে, না বলা আজীবনের সংলাপ রচনা করে, নিজের সাথে নিজে। অন্তর্মুখীনতা বারবার একা করলেও, তাকেই শক্ত হাতে আগলে নেওয়া,"অনেক সময় গেছে, যখন সারাটা সন্ধ্যা চা পান ক'রে কাটিয়ে দিয়েছি আমরা, কোনো কথা বলিনি বলে তুমি আমায় 'চুপ ক'রে থাকার উপায়' গিফট ক'রে চলে গেছ।" আঁকড়ে ধরা শৈশব স্মৃতি, প্রেম অথবা প্রেমিকাকে সুতীব্র ভালোবাসতে চাইবার ইচ্ছে আবারও ফিরে আসে 'শিল্পকর্ম' কবিতাতে। 'সংসার' কবিতার প্রতিটি নিঃশ্বাসে, যাপনে, গন্ধে, প্রহরে, ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়, মা, বাবা, প্রিয়বন্ধু, কাছের জন, সাথে প্রতিটি পাখির ডাক। ত্রিমাত্রিক ছোঁয়া আর অন্তর্জাত অনুভব একাকার হয় অবিরত; "এরপর অন্ধকারে সকাল হয়ে গেছে ভাবা পাখি ডাক দিলে ভোর, আর এখানেই বেঁচে থাকার মূলগন্ধ। পবিত্র আলোর মত ফুটে ওঠে।" "ভুল ক'রে অজস্র নারীকে ভালোবেসে ফেলেছি" কবিতাতে ব্রতকথাদের নিঃসন্দেহে বিরহ - সুরে বেঁধে ফেলাই যায়। ছত্রে ছত্রে লেখা আছে গলার কাছে আটকে থাকা কান্না, ছোট্ট পরাজয়, বিচ্ছেদ আর প্রত্নকথা; "অন্ধকার লেডিস হস্টেলে বৃষ্টি পড়ছে। কাঠের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছো তুমি। একা। আমার ছাতা হারিয়ে গেছে, যতটা মহেঞ্জোদারো।" "তোমাদের জন্য লেখা" কবিতায় সমস্ত সমাজ নিয়ন্ত্রিত একপেশে নির্মাণের মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে "ঘেমো শার্ট", "কালো ছোপের" আধময়লা গেঞ্জি, "মুখের ব্রণ" - ইত্যাদি ''জ্ঞাত অস্বাভাবিকতা'' আঁকড়ে কবি লেখেন, "আমি কোনওদিন পিঠে গীটার নিয়ে বেরোতে পারবনা, পারবনা কাঁধে ডি এসেলার ঝোলাতে।" দেখনদারি, আলগা চটকের বস্তুবাচকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, বুকের ভেতর বড় হয়ে যাওয়ার মোচড় নিঙড়ে, উদাসী হাওয়া গল্প লেখে। স্পষ্ট হয়, উত্তরোত্তর বাবা মায়ের বেড়ে যাওয়া বয়সের ছবি, ইলেকট্রিক বিল দেবার টুকরো অনুরোধ, কষ্টকথা; "বাবারা অনুরোধ করলে, বুকের ভেতর এক অদ্ভুত কষ্ট হয়, মনে হয়, কত তাড়াহুড়ো ক'রে বড় হয়ে গেলাম।" রাস্তাঘাটে নানা মুনির নানা মতকে ধুলো ঝাড়ার মত ক'রে ঝেড়ে ফেলতে ফেলতেও কোথায় যেন এক পরম ও চরম ঝেড়ে - ধুয়ে ফেলা বাকী থেকে যায়। তাই চলার পথে নানা মন্তব্যকে, 'রং'কে নিজের অজান্তেই গায়ে মেখে নেবার ছিটেফোঁটা হ'লেও কোনো 'ভয়' বুকে চলতে হয়। যে 'আমি'কে আমি চিনি আর যে 'আমি'কে ধারাবাহিক মিথস্ক্রিয়ায় বানিয়ে তুলছে এই সমাজ; নানান পারিপার্শ্বিক চাপে, অস্থিরতায়, সেই দুই 'আমি'কে বুকে ক'রে বেড়ানোর দ্বন্দ্ব - দোলাচলের ঝড়ের আওয়াজ লেখে এই "আমি এবং আমি" কবিতা; "এখন ইচ্ছে হ'লেও গেরুয়া পাঞ্জাবি পরতে খুব ভয় লাগে ..... কীভাবে লোকে আমাকে অবলীলায় কবি - বিজ্ঞানী - লেখক আর গিরগিটি বানিয়ে দেয়।" "চিরন্তন শতাব্দীর কবিতা" তে প্রেমের কিছু আশ্চর্য্য সার্বজনীন ধ্রুবসত্যকে তুলে ধরে কবির ব্রতকথা, যেন তা শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রবাহমান; "প্রতিটি প্রেমিকের এখন সুস্থ থাকা খুব প্রয়োজন কারণ, ছায়ার ভেতর থেকে উড়ে যাওয়া পাখিও জানে কতটা সংগীতময় প্রেমিকার মন ভালো করা।" "নভেম্বর মাসের কবিতা"য় ছত্রে ছত্রে ত্রিমাত্রিক অনুভবে প্রাক শীতকালীন ঝরা শিউলির গন্ধে, বৃষ্টি শেষের স্পর্শে, গন্ধে, রেশে, ভালোবাসা খুঁজে ফিরে ব্রতকথা লেখেন প্রেমিক কবি; "কোমড়ে অসি নিয়ে তারকা খচিত এক দুর্দান্ত পুরুষ! শিউলি ফুলের মত অক্টোবর ঝরে পড়ে।" দিদিমার "বলিরেখার কাছে হেরে যাওয়ার আতঙ্ক" কিংবা কখনও 'কাঞ্চনগাছ', 'জ্যোৎস্নারাত', 'পঞ্জিকা', "ভাঙা চশমা" - এই সবকিছুর সাথে জড়িয়ে থাকা ছেলেবেলা যাপন, দিদিমাকে আঁকড়ে থাকা রাত্রিদিন, ভোরের গল্পগাথায় "ভাঙা বাড়ি আর ভাঙা চশমার ভেতর মেয়েদের ব্রতকথার জীর্ণ পাতা" ভেদ ক'রে লেখা হয়, আরো কয়েক ছত্রের নতুন ব্রতকথা, যার নাম, "দিদিমা তোমাকে।" 'হাসপাতাল'এর বুকে বিন্দুতে বিন্দুতে লেখা হয়, "কপাল বেয়ে যতটা ঘাম তুমি নামিয়ে আনতে", "অসুস্থতার কথাগুলো কেন অপূর্ব বর্ণনায় তুমি পরিবেশন কর?" "কোমার ভেতরে থাকা প্রতিটি মুহূর্ত কী রকম হয়", "ছাতার বিষণ্ন রং হাসপাতালের বিছানার মত" - ইত্যাদি নানান নিখুঁত ডিসটোপিয়ান সময়ের ছবি; "হেঁটে চলা পথিকেরা আমার মাথায় অসুখ ঢুকিয়ে দেয়, আমি ওসব একদম পছন্দ করিনা," এমন অপছন্দদের জিইয়ে রেখেও ব্রতকথাদের জন্ম হয়। "প্রেম পর্যায়ের কবিতা"য় রবীন্দ্র সৃষ্টিকে বুকে নিয়ে বারবার কেঁদে উঠতে চায়, পুরুষ কবির প্রেমিক হৃদয়। সম্পূর্ণভাবে লজ্জাবস্ত্র পরিত্যাগ ক'রে, অন্তহীন অপেক্ষায় স্মৃতিছবিতে বুক ভাসিয়ে কবি লেখেন; "অভ্যাসবশে কেউ বৃষ্টির রাস্তায় নৌকা ভাসিয়ে দিলে কেন এখনও আমার উঠোনে জল দাঁড়িয়ে যায়?" 'চন্ডীদাস' কবিতাতে দেশভাগের যন্ত্রণায় আজও দগ্ধ হচ্ছেন কবি। কাঁটাতারের আঘাতে রক্তাক্ত হ'তে হ'তে মায়ের ভাষার ভালোবাসায় বিভোর হয়ে "সাতশো বছরের পুরোনো প্রেমিক" হ'তে চান তিনি। স্মৃতি - নস্ট্যালজিয়া ছবি হয়ে ওঠে "তালপাতা ও খাগের কলম নিয়ে মাটির দাওয়া।" যেন আরো ভালোবেসে যেতে পারেনা হৃদয়, এই অনুভবে নিজেই নিজেকে কখনও বিদ্রুপ ক'রে ওঠেন,"ভাষা প্রেমিকার প্রেমিক, অবলীলায় হেঁটে চললেন আমাকে বিদ্রুপ ক'রে..... আমরা জানি প্রেমিকা ছেড়ে গেলে মানুষ বোবা হয়ে যায়।" আর এই কবিতারই একরকম অংশবিশেষ হয়ে আসে, "ভালোবাসার শব্দ" কবিতাটি, যেখানে কবির ব্রতকথা আবারও ভালোবাসার গলা অবধি জলে শুধুমাত্র না ডুবে, বরং তাতে হাবুডুবু খেতে চায়, শুধুই বাহ্যিক - নির্মিত সৌন্দর্য্যে নয়, আমাদের চোখে যা কিছু কালো, ময়লা, অদেখা, ঘাড়, গোড়ালি, ছিদ্রকথা, সবটুকু নিয়ে বিপুল উদযাপনে মেতে উঠতে চায়; "ময়লা নিয়ে কেউ কিছু লিখতে চায়না। কারণ প্রতিটি বিশুদ্ধ মানুষ অস্বচ্ছ্ব প্রেম হাতে ক'রে রোজ বাড়ি ফেরে।" 'হেমন্ত' কবিতায় ধূসরতাকে চিত্রায়িত করতে, কবি লেখেন; "প্রতিটি পাখির ভেতর যেন এস্রাজের সুরের মত ছড়িয়ে গেছে ঋতুমতী না হওয়া হেমন্তের দুপুর।" পুরো কবিতা জুড়ে উঠে আসে কার্ত্তিকের ধূসরে সম্পূৰ্ণ নিমজ্জিত এক আস্ত মনখারাপের শহর, "রেসকোর্সের এদিকে এখনও রয়ে গিয়েছে ইউরোপিয়ান বাড়ি। ফাঁকা নির্জন একা একা বাড়ি - গাছের খসাপতা - বিলিতি আলোর শেষবিন্দু।" মনখারাপে মিলেমিশে উত্তরের ডুয়ার্স আর দক্ষিণের লালমাটি নিরবচ্ছিন্ন জুড়ে যায় এ'ভাবে, "আদিবাসী মেয়েদের চুলের গন্ধ, মাদলের শব্দ। অথচ চারপাশের ইউক্যালিপটাস সাদা মুখো সাহেবের মত। আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে, হাসতেই থাকে।" কতশত অদ্ভুত আশ্চর্য ভালো না লাগার বোঝাকে আমরা কেমন অবলীলায় বয়ে বেড়াই, "লোকে বলে এসব আঁতলামো।" "আরেকটি প্রেমের কবিতা" য় প্রেমের অনুভবে শরীরের ভেতরকার কাঁপনে ভাষা সঞ্চার করেন; "ফলের বীজ পেটের ভেতর চলে গেছে। শৈশবে মায়ের সাবধান বাণীর মত। সারা শরীর ফেটে বৃক্ষ বেরিয়ে আসতে চাইছে ধীরে ধীরে", ঠিক যেন "তুমি মায়ের মত ভালো" এই অনুভবের যথার্থ প্রকাশ। 'বাঘ' কবিতাটি এক অন্যরকম জীবন উদযাপনের কথা বলে, যেখানে, নিক্তি মেপে সমানে সমানে "এখন আর বাঘের কোনও ভয় নেই" সাথে "দরজা খুলে দিতেই দু'জনের ক্লান্ত চোখে সংসার সকালের সূর্য়ের মত ঝিলিক দিয়ে উঠল।" তাই এ' কবিতার পরিশেষে ব্রতকথা; "যেখানে রোজকার জীবন আমার বয়স বেড়ে যাওয়ার মতই দুঃখ ও আনন্দদায়ক।" "ঈশ্বরের পেনসিল" দিয়ে মানসচক্ষে একের পর এক আঁকা ছবি ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে ওঠে, কবিকথা প্রাণ পায়,"যেন ফুলছাপ চাদরের বিছানায় বসে ঈশ্বর। আমাকে পৃথিবী তৈরির ব্লুপ্রিন্ট দেখাচ্ছেন।" একটা আস্ত পৃথিবী তৈরি হয় চোখের সামনে, যা একান্তই কবির নিজস্ব। তাই তো বারবার আকাশ খুঁজে ফিরেও হঠাৎ হাওয়ায় কিছু ঘরোয়া আটপৌরে ভালোলাগা আসে, "মা মুখে ক্লিপ কামড়ে চুল বেঁধে নিচ্ছে খোঁপা ক'রে। ভাত বসাতে হ'বে।" 'ঘরবাড়ি' কবিতায় কবি বলেন, বাড়ি মানে যে শুধুই ইঁট, কাঠ, পাথুরে দেওয়ালে দেওয়ালে জুড়ে থাকা লোহার আটক, তা নয়, বরং, "মায়ের অসুখ হ'লে বাবা মায়ের অনেক কাছাকাছি চলে আসে।" এক অদ্ভুত পরিতৃপ্তি বুকে; "সেই ভেঙে পড়া দেওয়ালের ইটগুলো সাজিয়ে ঘর বানাই। ঘরের ভেতর এক আশ্চর্য বাড়ি তৈরি হয়। যেন সদ্য প্রেম হয়েছে তরুণ বাবা মায়ের।" বুকের মধ্যে হঠাৎ কোথাকার কোন্ এক শিল্পী নিজের মনের মত ক'রে গড়েন এক নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের ভালোবাসা - বারান্দা। "এই বেরঙিন আবহাওয়া আমায় রাজমিস্ত্রীর মত শিল্পী বানিয়ে তোলে।" "আকাশ ভরা সূর্য তারা" কবিতায় পার্থিব 'আমি'র সাথে মহাকাশ - বিশ্বব্রহ্মান্ডের সমস্ত গ্রহ - নক্ষত্রাদির মধ্যে মিশে থাকা 'আমি' কে মিলিয়ে দিয়েছেন কবি; "এই যে রাতের আকাশ, তারা, তুমি তো এখানেই মিশে আছো! ..... খোলা আকাশের নীচে ঘুমোবে, দেখবে তারার মাঝখানেই তুমি প্রাণ পেয়েছ।" "ঈশ্বরের পেন্সিল" কবিতার রেশ টেনেই "তীব্র ম্যাজিক" কবিতাতেও ঈশ্বরকেই সর্বময় কর্তা ও স্রষ্টা হিসেবে 'ম্যাজিশিয়ান' বলে বিশেষিত করেন কবি, "এই অলৌকিক ম্যাজিকের জন্য অবিশ্বাসীরাও, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস অর্জন ক'রে ফেলে।... স্নান সেরে উঠে আসেন স্বয়ং সুজাতা।" "করোনার দিনগুলি" র কবিতায়, কবির যেন নিরন্তর খুঁজে চলা, এক মেঘময় সন্তুষ্টির কারণ, ভালোবাসার কারণ, ভালোলাগা, ভালোথাকা কিংবা অন্য কোনও তৃপ্ত অনুভব। বন্দীদশায় থেকেও তাই কবি অপার্থিব আনন্দের স্বাদ খুঁজে নিতে পারেন প্রকৃতি প্রেমের উঠোনে; "আকাশের কাছে শুনেছিলাম, মেঘের রঙ যখন হয় গাঢ় লাল, তখন যে বাড়ির শিশুরা খেতে বসে মায়ের থালায়, তাদের ঈশ্বর - প্রাপ্তির কোনও প্রয়োজন হয়না।" মনের ঘরে উঁকি দিয়ে সহজেই পাড়ি দিতে পারেন, আপন হ'তে বাইরে; "৭৩ মোড়ের দিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে পড়ি কোনও কুয়াশা জড়ানো অলৌকিক চায়ের দোকানে।" গৃহবন্দীর ভেতর থেকে চলকে ওঠে এই শহরের জন্য অবচেতনের সব প্রেমগুলো। আশাবাদী উজ্জ্বলতায় লেখেন; "লজ্জায় রাঙা হওয়া ভুলে গেছি বলে নির্লজ্জের মতো আমি আনন্দিত হয়ে উঠি, বিশ্বাস করি, এই অতিমারী, আমাদের হত্যা করতে পারবেনা।" অন্যদিকে মৃত্যু মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে করোনা কালে হতাশার আগ্রাসন লিখিয়ে নেয়; "আমি ইদানিং ভাবি না, বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ কেমন অবলীলায় টপকে গেল, কোটি কোটি প্রেমের স্মৃতি হারিয়ে গেল তাদের সঙ্গে....।" "জানুয়ারি মাসের কবিতা" তে উপলক্ষ্য হয়ে ওঠে শীত, অন্য প্রেমের গল্পে কখনও "অলৌকিক বন্ধুত্বের ছেলেবেলা" দেখা দেয়, কখনও "চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙে যায়" কিংবা কখনও "সন্ধ্যার মৃদু অন্ধকারে এখানে এলে তোমাকে তীব্র রূপসী মনে হয়।" কবির ঈশ্বর ধন্য হন, যখন "শ্বেতপাথরের মেঝেয় গোলাপী আঁচল" মাখামাখি হয়। বস্তুমাত্রিক প্রেম যখন একটু একটু ক'রে আধ্যাত্মিক পরশ পাচ্ছে, শীতের মরশুমে "স্কার্ফের আড়াল দিয়ে কোয়োকার্পিনের গন্ধ, হাসপাতালকে পবিত্র ক'রে তুলেছিল।" এক আন্তরিক চাওয়ায় "তুমি কমলালেবু গন্ধ পাঠিও খামে ভরে।" "প্রেম বিষয়ক" কবিতায় ভালোবাসা উদযাপন সঙ্গে পরিণতির জয়গানে পবিত্র স্বর আর লজ্জা একাকার হয়ে যায় উজ্জ্বল - অনন্ত - জ্বলন্ত উচ্চারণে; "পবিত্র যেদিন লজ্জাকে বিবাহ করবে, সেদিন এক ঠিকানায় আমন্ত্রণপত্র আসবে আমাদের।" কিছুটা হতাশা, কিছুটা না পাওয়া, জীবনের ব্যথার সাথে যুঝে উঠতে না পেরে, সবটুকু শুধরে, শুরু থেকে ঢেলে সাজানোর ইচ্ছে পোষণ করেন কবি, 'বোধি' কবিতায়; "মানুষ হওয়ার সহজপাঠ দাও, দরকার পড়লে কিশলয় - নবগণিত মুকুলও, একটা সাদা খাতা কিনে নেব, আবার সব কিছু শৈশব থেকে শুরু করতে হ'বে।" ব্রতকথা থেকে দুঃখকথার শেষ বিন্দুটুকুও উছলে পড়ে উত্তাল প্রকাশে; "সারা শরীর গুলিয়ে ওঠে, বমি পায়, ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কী আশ্চর্য, ছোটো থেকেই শুনে এসেছি, পুরুষমানুষ কখনও কাঁদেনা!" অনেকটা কেঁদে নিতে পারলে কি বোধি ঘটতে পারে? এই প্রশ্ন নিয়েই অশেষের রেশ টেনে এগিয়ে চলে কবিতা, 'বোধি'। 'দূরত্ব' ভালোবাসাকে অসীম উচ্চতায় নিতে নিতে ছাঁচহীনভাবে বলছে "এই দূরত্ব থেকে ভালোবাসার রূপ দেখছি। দেখা যাচ্ছেনা। ভালোবাসার কোনো আকার নেই।" যে প্রেম 'আল্টিমেট', সর্বস্ব, সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রক, যার কাছে স্বেচ্ছায় বাধা পড়ে থাকা যায় অনন্ত আরামে, সেই তো স্পষ্ট উচ্চারণে জপতে পারে, "তুমি ভালোবাসলে ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতার মত সুন্দর লাগে। তুমি ছেড়ে চলে গেলে সততাকেও ভন্ডামি মনে হয়।" নিয়ন্ত্রিত থাকতে থাকতে ধারাবাহিক অস্তিত্ব খুঁজে চলা আপনহারা প্রাণ কখনও কেঁদে উঠে বলে, "আসা - যাওয়ার মাঝে গোত্তা খাওয়া, ঘুড়ি হয়ে আটকে আছি," এই যেন এক অদ্ভুত 'ভোকাট্টা' অনুভব, তাই টানটা থেকেই যায়। জলশহরের কথা, তিস্তাব্রীজ, করলাব্রীজ, বহতা নদীর জীবনগাথা, বারবার ঘুরে ফিরে উঠে আসে পাতার পর পাতা ব্রতকথায়। তৈরি হয় ছোটো ছোটো গল্প। অসীম উদ্দেশ্যের পথে সে গল্পে কখনও মিলন, কখনও বিচ্ছেদ। কিন্তু তবুও সবকিছুকে অতিক্রম ক'রে কোথায় যেন একটু একটু ক'রে বিচ্ছেদের পথেই হেঁটে চলি আমরা, আসা যাওয়ার পথ ধরে একেবারে একলা; আর তাইতো; "তুমি সারাটি পথ বলেছ বিচ্ছেদের গল্প। আমি সারাটি পথ বলেছি বিচ্ছেদের গল্প।" প্রচ্ছদপটের ওপর থেকে ধীরে ধীরে পৌঁছে যাই একেবারে নীচে, শেষ বিন্দুতে, বইয়ের পেছন মলাটে, আক্ষরিকভাবেই রঙ - তুলিতে মিলে যায়; "রাস্তা যেখানে শেষ হ'বে, সেখানে তিস্তা ও করলার মিলন হয়েছে।" এইভাবেই সবুজ - নীল নদীর শহর, জঙ্গুলে জলশহরের বুক চিরে কালে কালে প্রবহমান হোক, কবি রঙ্গন রায়ের কলম, কখনও ছকভাঙা অঙ্কে, কখনও ছাঁচ ঢালা, নিয়মমাফিক কিংবা নিয়ম ভেঙে বাঁধনছাড়া; শহর থেকে শহরে, দেশ থেকে দেশান্তরে। এমনই সতেজ - সহজ থাকুক মন, হাওয়ার মত। গতানুগতিক সামাজিক লিঙ্গের বাধ্যবাধকতাকে ছাপিয়ে কলম জুড়ে খেলা করুক মানুষের ব্রতকথা, ভাবনার অসীম উত্তরণে।
প্রকাশনা : শাঙ্খিক
প্রচ্ছদ : প্রমিথিউস বিশ্বাস
মূল্য : ৩০০ টাকা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴