মৌটুসী রায়ের নতুন কবিতার বই 'হৃদয় ভাঙার শব্দ'
আলোচক : অর্ণব সেন
মৌটুসী রায়ের নতুন কবিতার বই 'হৃদয় ভাঙার শব্দ'
'জেমস জয়েস' উপন্যাসটার প্রথম দিকে তাঁর একটি উপন্যাসের ফুটনোটে কবিতা বিষয়ে একটি ল্যাটিন প্রবচন অনুসরণ করে লেখেন : "The poem is made, not born / The poet is born, not made." একটু ভেবে দেখতে হবে এখানে পরোক্ষভাবে নির্মাণ ও সৃষ্টির সম্পর্কটির ইঙ্গিত আছে। রবীন্দ্রনাথও ১৯২০তে আমেদাবাদে Gujrati literary conference, Ahmedabad, India, in 1920 'Construction versus Creation' নামে একটি লেখা পড়েছিলেন।
মৌটুসী রায় রচিত "হৃদয় ভাঙার শব্দ" কাব্যের কবিতা পড়তে পড়তে ওপরের বহু-উচ্চারিত কথাগুলোই মনে পড়ল। আসলে কবিতা ও কবিতাচর্চার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের আন্তরিক সম্পর্ক।
এই কাব্যের কবিতাগুলিকে তিনি পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে দিয়েছেন, বুঝিয়ে দিয়েছেন যে প্রকৃতির ফুল, মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে কতটা গভীরভাবে মিশে আছে!
"হৃদয় ভাঙার শব্দ" কবিতাই এ কাব্যের ক্ষেত্রে 'হাওয়া মোরগ'-এর মতো কবির চিন্তাচারণা, শব্দ নির্বাচন, প্রকৃতির সঙ্গে হৃদয় বন্ধনের কথা বুঝিয়ে দেয়।
তাঁর কবিতাগুলিকে পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি ভালো লাগবে কবিতা প্রেমিকের কাছে । 'বিষণ্ণতার ফুলগুলি', 'শুধু পারিজাত', 'ঘুম ভাঙলেই ফোটে ফুল', 'একটা পথের খোঁজে'-এভাবেই কবি তাঁর হৃদয়ের অন্তঃপুরে প্রবেশের দরজা খুলে দেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কয়েক দশক আগে বিশ্বনাথ দাস সম্পাদিত উত্তরবঙ্গের কবিতা নিয়ে একটি সংকলনের ভূমিকায় লেখেন : "উত্তরবঙ্গের কবিরা প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষ ভাবে ব্যবহার করেন, কলকাতার কবিরা সেটা করেন পরোক্ষভাবে।" যান্ত্রিকতার কাছাকাছি থাকলে এটাই হয়।
"শুধু পারিজাত" পর্বে 'পারিজাত'-
"পারিজাত....
তুমি আমার না পাওয়া স্বপ্ন
তুমি আমার মেঘ, তুমি আমার আকাশ"
'ঘুম ভাঙলেই ফোটে ফুল' পর্বে 'অবশেষ' কবিতা যেন মনে করিয়ে দেয় বৃষ্টিহীন ধরণীর অন্তহীন প্রতীক্ষার তৃষ্ণার্ত আকুলতার কথা, যা মনে করিয়ে দেয়, এলিয়ট-এর 'The Waste land' (1922)-এর কথা - "...What branches grow / out of this stony rubbish?"
কবি লেখেন বাংলার বৃষ্টিহীন (হৃদয়হীন?) প্রতীক্ষার ছবি -
"বৃষ্টির প্রতীক্ষায়
থেকে থেকে
পত্রহীন হয় বৃক্ষ
থাকে শুধু
শাখা প্রশাখা
আর শিকড়
বৃষ্টি আসে যায়
বৃক্ষ থাকে পত্রহীন"
"একটা পথের খোঁজে" শেষ পর্ব তাৎপর্যবহ!
প্রকৃতিপ্রেমী মরমী কবিকে পথ খুঁজতেই হবে। না হলে কি হৃদয় ভাঙার শব্দই শুনবে মানুষ? কবিতার নাম 'নগণ্য' :
"চোখ তো সবারই আছে
দৃষ্টি থাকে কজনের"
শেষ দুটি চরণ বুঝিয়ে দেয়:
"দ্বিপদ তো সবারই আছে
পদচিহ্ন থাকে কজনের?"
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার 'ঐতিহাসিক', 'চেনা অচেনা', 'মহালয়া', 'অসহজ', 'জীবনগন্ধা', 'অবুঝ', 'কবি ও কবিতা', 'ভালোবাসার জন্য', 'ঠিক কতটা', 'ঋণী', 'পোড়াকাঠি' যথেষ্ট হয় না মনে হয় কবির কাছে। তাই লিখতে হয় 'সেই সব দিন'-
"আমি কোথায় পাবো তারে
আমার মনের মানুষ যে রে..."
অন্তহীন অন্বেষণের ভেতর দিয়েই তো মানুষের পথ খোঁজা। 'মিথ অফ সিসিফাস'-এ সেই অন্বেষণের কথাই শুনেছে মানুষ। মানুষের মনের মধ্যে আছে অদম্য উদ্যম! তাই সিসিফাস তার লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য প্রতিদিন হেরে গিয়েও আবার নতুন উদ্যমে পরের দিন পাহাড়ে উঠতে যায়। ব্যর্থ হয়েও উদ্যম হারায় না প্রত্যয়ী মানুষ।
'হৃদয় ভাঙার শব্দ'/মৌটুসী রায়/প্রকাশক: নৈষ্ঠিক অ্যাকাডেমি, নিশিগঞ্জ, কোচবিহার /মুদ্রণ: বিয়ন্ড হরাইজন পাবলিকেশন, থানা মোড়, আলিপুরদুয়ারের /দাম:২০০ টাকা
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴