হে বন্ধু হে প্রিয়/বনানী গোস্বামী
হে বন্ধু হে প্রিয়
বনানী গোস্বামী
অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ।।
.....আমার রবীন্দ্রনাথ ঠিক এই শ্রদ্ধাসনে বসে আছেন - হৃদমাঝারে, স্বতন্ত্রতায়, আমায় জীবনদর্শনে জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন করে, বিশ্ব মানবতার মন্ত্রে দীক্ষিত করে, চলার পথের দিশারি হয়ে....আমি ঋদ্ধ হয়ে আছি... একান্ত আমার যে রবীন্দ্রনাথ !--আমার শয়নে, স্বপনে, জাগরণে আমার সাথে আছেন, আমার বোধে, আমার সমস্ত অনুভূতির সত্তায় ।
সরকারি বাংলামাধ্যমে পড়বার সুবাদে চোখ, কান- দুটো ইন্দ্রিয় সজাগ হয়েছিল প্রথম শ্রেণি থেকে তাঁর 'সহজপাঠ' হাতে পেয়ে। বিমূর্ত থেকে মূর্ত রূপ পেয়েছে মন অনাবিল আনন্দে। শিক্ষা গ্রহণের প্রথম ধাপ। প্রকৃত বন্ধু -শিক্ষাগুরুর পরশ পেয়ে।
পরবর্তীতে পাঠ্যবইয়ে যেসব কবিতা, গল্প কাহিনী পেয়েছি তার গভীরতা না মেপেই বেশ গড়গড়িয়ে পড়েছি; তাঁর গল্পগুচ্ছ, শ্রুতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্য এসব পড়া, শোনা, দেখা-তে সে সময় বড় আনন্দ হত(এখনও )। আর পঁচিশে বৈশাখ আসার মাসখানেক আগে থেকেই বিদ্যালয়ে, পাড়ায় পাড়ায় সংস্কৃতিতে (আমরা উপভোগ করেছি) -- কোনো উৎসুক দাদা,দিদির কঠোর প্রহরায় আমাদের খুদেদের নিয়ে চলত রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপনের মহড়া।
একটু বড় হলাম তাঁর রচিত নাটক রেডিওতে শুনেও।দেখে, শুনে পড়ার খিদেটাও চাগিয়ে তখন। হাতে পেলাম সঞ্চয়িতা, পেলাম গীতাঞ্জলি। উল্লসিত পৃথিবী আমার !আকাশ, বাতাস, গাছ, ফুল, পাখি, নক্ষত্র, নদী সব কেমন আপন মনে কথা বলা শুরু করল। চোখ মেললেই দেখতে পেলাম যেন। চোখে, মননে কেবল তৃপ্তির স্বাদ আমার।মহান দার্শনিক ও দূরদর্শী রবীন্দ্রনাথ কখন
শক্তপোক্ত ভাবে আমার হাত ধরে ফেলেছেন .....অন্তরমহলে শুরু হয়ে গিয়েছিল রবিযাপন অগোচরেই।
.....গীতবিতান ধরে ফেলেছি।পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে খিলখিলিয়ে হেসেছিও । কিছু গান শুনে শুনে মনে রেখে যে বেমালুম ভুল শব্দ উচ্চারণ করে ছোটবেলায় আমরা গাইতাম সমস্বরে।
গীতবিতান যখন সবসময় কাছে রাখা শুরু হল আমার, মনে ভালো লাগা লাইন গুলো পেন্সিল দিয়ে আলতো চিহ্ন করে রেখে পরে ডায়েরিতে তুলে রাখতাম। টেপ-রেকর্ডারে ভালো গাইয়ে শিল্পীর কণ্ঠে এরকম কত গান যে শুনতে শুনতে চোখ মুছেছি বিহ্বল হয়ে অলক্ষে ...যাত্রা শুরু হল 'আমি কান পেতে রই'-এর। কত রকম পর্ব রেখেছেন সঙ্গীতাঞ্জলির! সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোর সাথে একাত্ম হয়ে আছি! এ যে কী অমূল্য সম্পদ! তখন কলেজ জীবন।গীতবিতান বুকে রেখে আত্মশুদ্ধিকরণ শুরু।
.....আমার কাছে রবীন্দ্র রচনাবলীর ঐ মোটা বইগুলো তখনও অধরা (এখনও কিঞ্চিত ধরা)। ইচ্ছে শুরু। কাব্যগ্রন্থ থেকে এটা টেনে ওটা টেনে পড়ার উৎসাহ তুঙ্গে । চরিত্রগুলো সবসময় ঘিরে থাকে আমায়। নিজ মনেই কথা বলে চলি ওঁদের সাথে। অমিত রায়, লাবণ্য, গোরা, বিনোদিনী, এলা, নন্দিনী, ফটিক.....আরও কত...। যতই পড়ছি মন বলছে প্রভু ' আরো আরো দাও '। পাশাপাশি তাঁর রচিত পত্রাবলি আরও এক নতুন দিশা দেখাল।
এভাবে আজও যৎসামান্যই ধরতে পেরেছি বলে মনে করি। এ অতল মহাসাগরের এক এক বিন্দু জল নিয়ে চলেছি আজও!!! এক এক বিন্দু জল সিঞ্চনে প্রাণে ভরপুর হয়ে আছে আমার প্রাণশক্তি। আর ঐ গীতবিতান এখনও আমার মণিহার। আনন্দে, সুখে, দুখে, বিরহে, শোকে পরশপাথর সম। তাই বেলা-অবেলায় মনে পড়ে 'তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে কেউ তা জানে না' ! আমি চলছি তো চলছিই তোমার ডাকে জগতের সব ডাক উপেক্ষা করে.... তোমার প্রদর্শিত পথে-- হে প্রভু, হে বন্ধু, হে প্রিয় ....পরশখানি দিও!!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴