হৃদয়ের কথা
হৃদয়ের কথা
অভিষিক্তা বসু
------------------
সেই কবে থেকে ডাইরির ভাঁজে ফোটো টা থাকতে থাকতে হলুদ হয়ে গেছে , তা পৃথ্বীরাজের মনেই নেই। আজ হঠাৎ বই এর তাক গোছাতে গিয়ে ডাইরি টা হাতে আসে। সব দিক থেকেই যেন রাজযোটক ছিল সংযুক্তার সঙ্গে ওর সম্পর্ক টা। কলেজে পড়া কালীন সকলে বলতো তোর তো ঐতিহাসিক প্রেম । এসব পুরনো স্মৃতি গুলো ওকে বেশ নাড়া দিয়ে যায়। মাঝে কেটে গেছে প্রায় ২০ টা বছর। তবু স্মৃতি স্মৃতি তে পৃথ্বী এখনও ঘুরে বেড়ায় ওর স্বপ্নময় বিলাসিতার প্রাঙ্গনে।
কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রথম দেখেছিল সংযুক্তা কে। গাঢ় নীল শাড়িতে কি অপূর্ব মোহময়ী লাগছিল ওকে। তেমনই ওর সুবিন্যস্ত অলক রাশি। যেন প্রাচীন নারীর কল্পিত অবয়বে এক অপ্সরা। তেমনই গজদন্ত বিকশিত মৃদু হাসি। অনুষ্ঠানে সংযুক্তার অসাধারণ গায়িকি মুগ্ধ করেছিল পৃথ্বী কে। কি অসম্ভব সুন্দর রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইলো । বন্ধুরা ধাক্কা না দিলে যেন ওর সুরের আবেশ টাই কাটছিল না। পৃথ্বী নিজেও ভালোই গায়, অন্তত বন্ধুরা তাই বলে। কিন্তু সংযুক্তার গান শুনে নিজেকে পৃথ্বীর খুব নগণ্যই মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল ওর নিজের আনকোরা সুরের তালে সংযুক্তার অপরিসীম স্নিগ্ধতা যেন সব কিছুকেই ছাপিয়ে যায়।
সে বছরই কলেজের শেষ বছর পৃথ্বীর । শেষ বছর টা পৃথ্বীর শুধু সংযুক্তা কে দেখে দেখেই কেটে গেছিল। কখনও কলেজের ব্যলাকনি তে বান্ধবীদের সাথে হাসি ঠাট্টায় মগ্ন, কখনও একান্তে লাইব্রেরীতে নিজস্ব বিষয়ের অতল সাগরে নিমজ্জিত। যত দেখেছে তত বেশী মনের অসীম আকাশে প্রেমের ভেলা ভাসিয়েছে। কিন্তু বরাবরের মুখচোরা পৃথ্বী কখনই বলে উঠতে পারে নি সংযুক্তা কে তার মনের কথা। শুধুই আড়ালে -আবডালে আলোর ধুপ ছায়া রঙ্গে মোড়া সংযুক্তার সাথে ওর মনের অপ্রকাশিত শব্দেরা একে একাই কথা বলে যেত।
কলেজের পর বাবার সবচেয়ে অপছন্দের বিষয়, পৃথ্বীকে তার সাধের গান টা খুব চাপে পরেই ছেড়ে দিতে হয়েছিল। পৃথ্বীর বাবা শহরের নামকরা সার্জেন। তাই তিনি কখনই চান নি যে ছেলে অন্তত ডাক্তার না হোক, কিন্তু গায়ক কখনই হতে পারে না। তাকেও চিরাচরিত প্রসিদ্ধ কোনো পথেই হাঁটতে হবে। বাবার সাথে এই বিষয়ে মনোমালিন্য চরম আকার ধারন করলে যেদিন পৃথ্বী ওর সবচেয়ে প্রিয় গীটারের তার গুলো ছিঁড়ে , সেটা স্টোর রুমে রেখে দিয়েছিল , সেদিন টা ছিল ওর জন্য জীবনের সবচেয়ে কষ্টের দিন। ছেলে বলে হয়তো চিৎকার করে কাঁদতে পারে নি, পৌরুষ আটকে ছিল কিনা। ছেলেরা কাঁদে না , ছোট থেকেই এটা শুনে বড়ো হয়েছে সে। কিন্তু যন্ত্রণায় অন্তর টা একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল, তার খোঁজ তো কেউ রাখে নি। ঘরের দেওয়ালে অজস্র পুরস্কার ও মানপত্র গুলো কে বাক্স বন্দী করেছিল চিরদিনের জন্য। আগুনের লেলীহান শিখায় এক লহমায় নিক্ষেপ করেছিল ওর এত দিনের সমস্ত সুর- তাল -ছন্দের তালিম এর খাতা গুলি। জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মাঝেই ছাই হয়ে যাচ্ছিল ছোট - বড়ো মিউজিক কোম্পানির থেকে আসা প্রস্তাবের বার্তা বহনকারী চিঠি গুলো। কেউ ছিল না পাশে । সেদিনের মতন একা আর সে কখনও হয় নি। তার সেই শত শর বিদ্ধ যন্ত্রণার ভাগীদার সে কাউকে করে নি। কিন্তু তবুও বাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের স্বপ্নের বিজয় মাল্য সে ছিনিয়ে আনতে পারে নি।
ভেবেছিল সংযুক্তা কে যেদিন নিজের করে পাবে , সেদিন ওর সব টুকু দিয়ে ওর স্বপ্নের জগত ভরিয়ে দেবে। সবটাই কষে রাখা হিসেবের মতই এগোচ্ছিল। পি এচ ডি করার সময় ইউনিভার্সিটির মোরাম বিছানো পথে কৃষ্ণচূড়ার ঝিরিঝিরি পাতার ফাঁকে আর হলুদ হয়ে আসা রাধাচূড়ার রঙ এ লুকিয়ে লুকিয়ে পৃথ্বী চেয়ে চেয়ে দেখত সংযুক্তা কে।অনন্ত যৌবনা এই যুবতীর সুবাসিত আতরের গন্ধে পৃথ্বী যেন এক মদির কল্পনায় ভেসে থাকতো সর্বক্ষণ । দেখা – অদেখার পলক ছুঁয়ে মনের অতলে রূপ কথার নায়িকার মতন মগ্ন হয়ে থাকতো সর্বক্ষণ।
মায়ের কাছে নিজের প্রথম প্রেমের এই মৃদু মন্দ বেদনার প্রকাশ করেও ছিল সে। মা এর কথায় বাবা ওদের সম্পর্কের প্রস্তাব টা নিয়ে গিয়েছিল সংযুক্তার বাড়িতে। প্রথমটায় সবটাই ঠিক ছিল। পৃথ্বীর ততদিনে নেট পাশ করে কলেজের চাকরী টা পেয়ে গেছে। কিন্তু সংযুক্তা তখনও তার মনের এই অনন্ত প্রেমের খনির খোঁজ জানে না। পৃথ্বীর বাবার সংযুক্তা কে দেখে মনেও হয়েছিল যে তার ছেলে অন্তত এই ব্যপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু আবার বাঁধ সাধল সংযুক্তার গান। তার অত সুরেলা গানে যেখানে তার নাম জপতে শুরু করেছে সকলে , অথচ তা পৃথ্বীর বাবার কর্ণগোচরই হল না। অনেক কষ্টে যখন তিনি তার ছেলে কে ওই গান নামক বিষয় থেকে দূরে নিয়ে আসতে পেরেছে, সেখানে কিনা বাড়ির বৌ গান গাইবে,এটা মানতে পারেন নি তিনি। আর বহু সাধনার ধন গান কোনোভাবেই বিসর্জন দিতে চায় নি সংযুক্তা। তার জীবনের সবটা জুড়ে রয়েছে সুরের মেখলা। সুরের জগৎ থেকে দূরে গিয়ে বড়লোক বাড়ির সোকেসে সাজিয়ে রাখা পুতুল হতে চায় নি সে। তাই কে এই পৃথ্বী তার খোঁজ নেওয়া তো দূরে থাক তার বাবার বয়ে আনা ছবি টাও তাচ্ছিল্য ভরে দেখতে অগ্রাহ্য করে সংযুক্তা। তার ধারনা জন্মায় যে বাবা সুরের সাধনা বোঝে না ,নিশ্চয়ই তার ছেলেও এর কদর করবে না। তার বিয়ের প্রস্তাব টাও মেনে নেওয়ার কোনো কারণ সে দেখে না।
অথচ অনন্ত কাল এক স্থবির প্রতীক্ষায় চাতকের মতন তার পথ চেয়ে থাকলো এক পুরুষ। পৃথ্বীর ইদানিং নিজেকে ভীষণ অমেরুদণ্ডী বলে মনে হয়। কোন দিনই সে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মনের কথার প্রাধান্য দিতে পারলো না , না নিজের কথা টুকু সংযুক্তার কাছে পৌঁছাতে পারলো। সেবারের সেই প্রত্যাখানের পর অনেক চেষ্টা করেছিল একটি বার সংযুক্তার সাথে দেখা করে সব কিছু বুঝিয়ে বলার। কিন্তু সংযুক্তাও সেই সুযোগই দিল না। ওর বার বার মনে হতে লাগলো, সত্যি ইতিহাসের করুণ কাহিনির মতই ওর প্রেম টাও অধরাই থেকে গেলো।
আজ পৃথ্বী কলকাতার নামী ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, গবেষক। কত শত রঙ্গিন স্বপ্ন কে নিরন্তর ডানা মেলে উড়তে দেখে, দেখে নিজেদের ইচ্ছা নদীর ভেলায় ভেসে নিজের পছন্দের মানুষের সাথে নুতুন জীবনের পথে পা বাড়াতে। তার সব ছাত্র – ছাত্রীদের খুব কাছের মানুষ সে। সবার মনের গোপন ঠিকানার খোঁজ যেন তার ডাক বাক্সে ফেলা রয়েছে। যখনই কোন ছাত্র- ছাত্রী টি তার প্রেমিক কিংবা প্রেয়সীকে নিজের কথা বলে উঠতে পারে না, তখন সেই তাদের শিখিয়ে দেয় মনের কথা মনে রাখতে নেই। অথচ নিজের কথাই আর বলা হয় নি তার। বাবার চাপে পড়ে পরবর্তী তে বিয়ে তো করেছিল তাদের পছন্দ করা মেয়ে কে। তার কোনো অমর্যাদা সে করে নি। স্ত্রী – সন্তানের প্রতি কোনো অবহেলা সে কখনও করে নি। কিন্তু হৃদয়ের অন্তঃপুরে একজনের আসন চিরকালের জন্য তার মনের মন্দিরে গাঁথা হয়ে রয়ে গেছে। মনের গভীরে যোজন দূরত্বে সে আরাধনা করেছে , আজ প্রায় ২০ টা বছর ধরে। অনুভব করেছে সংযুক্তা দুষ্প্রাপ্য , আকর্ষণীয় তাই আর কাছে গিয়ে স্পর্শ করার বাসনা না নিয়ে শুধুই নিজের পূজা টুকু সঁপে দিতে চেয়েছে তার প্রেমিক হৃদয়।
আজো বুঝি কখনও একলা হলে পৃথ্বীর কাঁধ ছুঁয়ে দাঁড়ায় তার অলক্ষ্য প্রেয়সী সংযুক্তা।নীরবে বিনিময় হয় কত মান- অভিমান। মনে মনেই কত কথা বলে ওঠে পৃথ্বী, 'একবার কি আমাকে বিশ্বাস করা যেত না, আমাকে আমার কথা বলার সুযোগ টাই দিলে না । আমি তোমার ইচ্ছের মান রাখতাম, নিজের টা পারি নি তার আফসোস চিরন্তন, কিন্তু তোমার টা হারাতে দিতাম না।'
সিগারেটের ধোঁয়ায় কুণ্ডলী পাকিয়ে হাওয়ায় মিশে যায় শব্দ গুলো। পরিচিত অনেকের সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় আজকাল সংযুক্তার গান ভেসে আসে। সে এখন নামকরা গায়িকা, অনেক পরিণত, তবুও যেন ২০ বছর আগের মতই তন্বী এখনও। পৃথ্বীর মুঠোফোনের মিউজিক ফাইল টা কানায় কানায় পূর্ণ সংযুক্তার নতুন নতুন গানের এ্যালবামে। তেমনই একটা চালালো আজ সে। ওপারে তার সংযুক্তা গাইছে … ‘আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন …তোমাতে করিব বাস … ।' মনে মনে খুশিও হয় পৃথ্বী, এই ভেবে, যে, সে না পারলেও তার সংযুক্তা পেরেছে। দূর থেকে তার তো শুধু এই চাওয়া টুকুই বিশ্বপিতা শুনেছেন।
লৌকিক জগতের ঊর্ধ্বে উঠে পৃথ্বীরাজের অনন্ত কালের মর্ত্যের চারণভুমির রাজকন্যে সংযুক্তা তুমি তো সত্যি জানলে না , কতখানি গভীরে কেউ চেয়েছিল তোমায়। আজো চায়, শুধু আজ সমাজের আড়ালে , সকলের আড়ালে একান্তে নিজের মনের আঙিনায় একা একা বাস করে তোমার সাথে। তুমি কি জানো তার কথা? কখন যে এক মাঝ বয়সী পুরুষের গলগণ্ডে বয়ে যায় নোনা স্রোতের ধারা সে নিজেও বুঝতে পারে না। এতগুলো বছরের এই নির্জন তপস্যা মাঝে মাঝে কেমন যেন বাঁধ ভাঙ্গা আবেগে ভেসে যায় ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴