হারিয়ে যাওয়া অ্যালবাম/নবনীতা সান্যাল
হারিয়ে যাওয়া অ্যালবাম
নবনীতা সান্যাল
ফেরাও ফেরাও তাকে;
ডাক দিয়ে যাও হে অলীক!
শূন্য হাত, জ্ঞান শূন্য --
যে ছোটে পথ, শুধু হারায়,
ছড়িয়ে যায়, হারিয়ে যায় -
এলোপাথাড়ি, দিগবিদি্ক!!
শনিবারের প্রায় বিকেল। সর্বজয়া স্কুল থেকে ফিরে আলনার কোণায় ব্যাগ রাখতেই বড় ঘরে এসে অপু বলল, 'ওরা কিন্তু আসবে সন্ধে বেলা'। 'ওরা মানে কারা?' অপু ফুটবল হাতে নিয়ে মাটিতে জাম্প খাওয়াতে খাওয়াতে বলল "-বাঃ,ভুলে গেলে? সকালে যখন পড়া ধরছিলে বললাম যে...!" সর্বজয়ার জোড়া ভুরু রামধনুকের মতো বেঁকে গেল। অপু আবার বলল, "আমরা ম্যাচ জিতলাম না...মর্নিং স্টার ... আমরা ঠিক করেছি প্রতি শনি আর রবিবার কারো না কারো বাড়িতে আমরা সেলিব্রেট করব.. কী করব আমাদের তো টাকা নেই.. যখন বড় হব...." সর্বজয়া তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন "ক'জন আসবে"? "সাত আটজন... মানে দশজনও হতে পারে!" -"বলিস কী?" হতভম্ব সর্বজয়া ছেলের মুখের দিকে মিনিটখানেক তাকিয়ে হাঁক দিলেন, "দুর্গা, এদিকে আয়.... ঠাকুরঘর থেকে আতপ চাল বের কর্ তো খানিকটা ..."। অপু বলল, "হ্যাঁ,হ্যাঁ...লুচি আর পায়েস করে দাও... তাতেই হবে.."। দুর্গা পাশ দিয়ে যেতে যেতে ভেংচে উঠল.. "ব্যস্, তাতেই হবে... মুখে মুখেই সব হয়ে যায় কিনা! শয়তান ছেলে... কোনো কম্মের না.. শুধু অর্ডার..."।
অপুর বল নাচানো মাথায় উঠল। সে সোজাসুজি দুর্গার সামনে এসে বলল, "তুই নিজে কী করিস... দুপুরে তোর রোজ ঘুমানো! অঙ্ক করার কথা না তোর? হাফ ইয়ারলিতে কত পেয়েছিলি অঙ্কে ভুলে গেছিস??" ব্যস্, আর দেখতে হল না ... লেগে গেল ধুন্ধুমার ... দেখা গেল বাইরের দরজার কাচ হঠাৎ ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। সেদিকে তাকিয়ে সর্বজয়া নিরুত্তাপ গলায় বললেন "যা পারো করোগে... নাহলে দরজা এমনই থাকুক। বাবা আসুক তারপরে যা হওয়ার হবে।" অপু দুর্গার দিকে বিপণ্ন তাকাল, দুর্গা বলল "চল্, হরিকাকুকে বলি গে.."। অপু বলল, "ইস্ আজকেই এরকম হওয়ার ছিল! দিদাও পিসিমণির কাছে গেল কাচও ভাঙল!" দুর্গার মনে পড়ে গেল অপু কিছুদিন আগেই শট্ মারতে গিয়ে দেওয়ালে টাঙানো ছবি ভেঙেছিল... বাবা অফিস থেকে আসার আগে ছবি মেরামত করে এনেছিল দিদাই। তক্ষুণি দৌড়ে দুই ভাইবোন হরিকাকুর কাছে গেল। হরি বলল, "তোমাদের এত জিনিস ভাঙগে্ ক্যান্? খাড়াও বিড়িখান্ ধরাইছি, যাইতেছি!! "অপু উশখুশ করে। দুর্গা ফিসফিস করে বলে,"খবরদার এখান থেকে নড়িস না কিন্ত!!
এরমধ্যেই বৃষ্টি নেমে পড়ল। অপুর তুতোদাদা শুভ ততক্ষণে আর একটা কাজ সেরে ফেলেছেন। সদরের কাঠের দরজার ওপরে একটা ছাতা ঝুলিয়ে দিয়ে এসেছেন। পাশের বাড়িতে কেউ গামবুট পরে কাজে এসেছিল, সন্তর্পনে সেটিও রাখা হয়েছে ঠিক ছাতার নিচে..। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ গেটের ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন। নিরামিষ হেঁশেল থেকে সে দৃশ্য দেখে ছোটদিদা বারবার বলছেন", কে ওখানে?ভেতরে আসেন, ভেতরে আসেন।" বৃষ্টির জোর বাড়ছে। প্রেসঘর থেকে ভেতরে এসে সেই হাঁকডাক শুনে বড়কাকা সেজকাকা দুজনেই ডাকছেন, "চলে আসুন, চলে আসুন।" কাঁঠালতলার নিচের ঘর থেকে মাসিমা দিদা বলছেন, "হেঁসেল উঠল ও ছোটোবউ"?
এদিকে কোত্থেকে একদলা সাবান এসে উপুড় হয়ে পড়ে আছে বড় উঠোনে! বুদবুদ উড়ছে। রাঙাপিসি মাছভাতের থালা হাতে নিয়ে উঠোনের ধারে এসে উবু হয়ে বসে বলছে,"যাহ্ সাবানটা আসল কোত্থেকে রে?"
বিকেল হতেই ঠাকুরঘরে হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছে ফুলপিসি। কথা বলতে না পারা ন'পিসি শান্ত হয়ে বসে তাকিয়ে আছে হারমোনিয়ামের রিডগুলোর দিকে। কার্ডবোর্ডের বাক্সে দুলছে সেজোপিসির করে দেওয়া গতবছরের ঝুলন! বিকেলে 'জওয়ান ভাইয়ো কে লিয়ে বিনাকা গীতমালা' শুরু হওয়ার আগের প্রিপারেসন -- চাঁটি মেরে রেডিও ঠিক করছে কুট্টিপিসি। মুক্তমঞ্চে আজ কুট্টিকাকার নাটক আছে- ঠিক যেন কটায়? কাকুমণি বাড়ি এসেছেন -ভিজে ভিজে ব্যাগ থেকে মৌরি লজেন্সের কৌটো বের করে বলছেন.. "কইরে কোথায় গেলি সবাই ?"
অদ্ভুত আলোকযানে বসে আছে দিনগুলো। পাতাবাহার আর মানিপ্ল্যাণ্টের জল চুঁইয়ে পড়ছে যেন সময়ের গায়ে। লালঘর, কালো সিঁড়ি, নীল সিলিঙ দেওয়া বাড়িটা মাঝেমাঝেই ডাক পাঠাচ্ছে... আর, বারান্দার কালো সিঁড়িতে বসে থাকা মেয়েটা বাবার এনে দেওয়া রঙ বেরঙের চুড়িগুলো হাত ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে শুধু শুধুই বলছে...."আসছি, আসছিইইই"!!!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴