হাত পেতে নিয়ে চেটে পুটে খাই/অনিন্দ্য সেনগুপ্ত
হাত পেতে নিয়ে চেটে পুটে খাই
অনিন্দ্য সেনগুপ্ত
***************************
শুরুর শুরু :-
সলতে পাকানোর গল্পটা এমন- নূরের সঙ্গে কথায় কথায় হঠাৎই একদিন উঠে এল কলেজের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের বন্ধুদের রিইউনিয়নের কথা।জনা দশেক রাজিও হয়ে গেলাম আমরা।স্হান ঠিক হোল 'অবকাশ'- লাটাগুড়ির কাছেই লালপুলে।জঙ্গলের গা লাগোয়া শুনে আমারও প্রাণ গড়ের মাঠ।
'অবকাশ' :-
লাটাগুড়ি-বড়দিঘির রাস্তায় নেওড়া নদীর তীরে অমিত-স্বপ্নার স্বপ্ননীড় 'অবকাশ'।স্ট্যাটাসে তিনি রিসর্ট হলেও ওদের আন্তরিকতায় জগজিৎ-চিত্রা সিং বাজে -'এ তেরা ঘর, এ মেরা ঘর...'।বাবুই পাখি যেমন যত্ন করে তার ঘর বানায়,ঠিক তেমন করেই মাথা তুলেছে ওদের আশিয়ানা।সঙ্গতে আছে রাজাদা।আর অক্লান্ত পরিশ্রমে আনন্দ'রা যেন 'গল্প হলেও সত্যি'। 'অবকাশ' নিয়ে অমিতের স্বপ্ন প্রায় অপত্যতুল্য।প্রতিটি ঘরে কী সুন্দর সব ছবি এঁকেছে সে!ছোকড়া আদতে শিল্পী।তাই রুচিও তার ভিন্ন,খ্যাপামোর খুব কাছাকাছি। 'স্তব্ধতার গান' শুনতে চাইলে ওরা আছে হাত বাড়িয়ে,প্রাণ ভরিয়ে।
রিসর্ট থেকে হাত বাড়ালেই শেষবেলার হেমন্তের কাশবন আর দু-পা দূরেই নেওড়া নদী।দোতলার বারান্দায় বসলে হাতছানি দেবে পাহাড়, রেলব্রীজ আর নদী। ওপারে গরুমারা ফরেস্ট।সত্যজিতের দিব্যি, সেই আবহে অপু-দুর্গা মনে হানা দেবেই।
'উড়ুক নদী, ঝরুক নদী...একটি নদী...':-
রিসর্টে ঢুকে চা খেয়ে সবাই মিলে পৌঁছলাম এক নদীর ধারে,নাম তার নেওড়া। বন্ধুদের অনেকেই স্নান করল জল দাপিয়ে, সঙ্গে ফটো সেশন।ওদের দেখে জলে নামতে চাইছিল মন।এ নদীর ওপর দিয়ে গেছে এক রেলপুল।কোনকালে তার রং ছিল লাল, তা থেকেই এজায়গার নাম লালপুল।রেলপথ মালবাজার থেকে এসে এই ব্রীজ ধরে জঙ্গলের ভেতর উধাও হয়েছে লাটাগুড়ির দিকে।
'I go and come with a strange liberty in Nature, a part of herself...':-
নদী থেকে ফিরে দুপুরের খাওয়া খেয়ে শুরু হোল জঙ্গল ট্রেকিং। ব্রীজ পেরিয়ে জঙ্গলের পথ শুরু।গাছগাছালির নিঃশব্দতার মাঝে নিজের গলার স্বর সময়ে সময়ে বড় রুক্ষ শোনায়।ক্ষেত্রবিশেষে নিস্তব্ধতার অনুরণনও যে কত তীব্র হয়!সেই আবহে বিশাল,বিশাল গাছেদের মাঝে এসে দাঁড়ালে নিজেদের বড় ক্ষুদ্র মনেহয়।গাছেদের থেকে আজো আমরা মাটির পাণে চেয়ে প্রণত হতে শিখিনি।Introspection র জন্যই মাঝেমাঝে বনচষা হতে মন চায়।সফরে পুরো পথে আমাদের সঙ্গ দিচ্ছিল বিভিন্ন পাখির ডাক,ময়ুরের কেকা আর কীট-পতঙ্গের আওয়াজ।খানিক পরেই নদীর ধার থেকে পড়ন্ত বেলায় সূর্যরশ্মির কমলা আভা ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্য দেখতে পাওয়া এক অনন্য অভিজ্ঞতা!সে দৃশ্যের সম্মুখীন হলে মন মুক্তি খোঁজে রোজকার ক্ষুদ্রতা থেকে,দৈনন্দিন ক্লিশতা থেকে - দিগন্তজোড়া এমনই তার স্নিগ্ধ প্রভাব!আসন্ন সন্ধ্যেকে আহ্বান জানাতে চারধারে তখন অকৃত্রিম আয়োজন।আকাশে শুকতারা উঁকি মারা শুরু করেছে নিয়মমাফিক।অন্যদিকে আড়মোরা ভাঙ্গছে পূর্ণিমার চাঁদ,নেওড়ার শান্ত জলে আছড়ে পড়বে বলে।ছেড়ে আসা জঙ্গলের আবার সেসময়ে রূপ বদলে রহস্যময়ী হওয়ার পালা।পাখিরা জলদি ডানায় ফিরছে গাছেদের কোলে,নিশ্চিত আশ্রয়ে।আর ওদিকে নিকষ কালো জঙ্গলে নিঃসঙ্গ প্রদীপ জ্বালিয়ে এসবের ঠায় সাক্ষী থেকে যায় রেলের হলুদ এক বাতিস্তম্ভ।
'তোমার চোখে আলোকবর্ষ করবে যখন গান রচনা/তখন তোমার রাত্রি ছুঁতে আমার গানের কাঙালপনা ':-
জঙ্গল থেকে ফিরে চা-পকোড়া খেতে খেতে চলল আমাদের সান্ধ্য আড্ডা।ওদিকে লালপুলের ওপর মস্ত এক চাঁদ আস্তে আস্তে প্রহর বিস্তার করছে স্নিগ্ধ আভায়।নেওড়ার জলে তার সেই প্রতিবিম্ব ছলকে ছলকে উঠছে।সেদৃশ্যের এমনই অভিঘাত যে আনন্দ'কে নিয়ে রাতেই আবার ছুটলাম ব্রীজের দিকে। আনন্দ ভয় পাচ্ছিল লেপার্ডের কিন্তু আমি নাচার।ধীরপায়ে চলে এলাম ব্রীজের ওপরে,ঠিক মাঝখানে। আমাদের সেই নিঃশব্দ অবস্থানের সাক্ষী রইল বনজোছনা,হাতির ডাক আর চন্দ্রাতপ জলের অপার্থিব শীৎকার।সে দৃশ্যের নেশা এমনই যে ফেরার পথে মাতাল মন পথভ্রষ্ট হবেই।এ জোছনা গৃহত্যাগী, আর এই চাঁদ হুমায়ুনের, সিদ্ধার্থেরও।
আমাদের সান্ধ্য মজলিশ শেষ হতে না হতেই নৈশাহার প্রস্তুত।মেনুতে মটন বিরিয়ানি,সঙ্গে চিকেন চাপ।সুস্বাদু সেই রান্না খেয়ে আমরা প্রত্যেকেই মুগ্ধ।রাজাদা'র রান্নার প্রশংসা করতে করতে খাওয়া শেষে ঘরে ঢোকার আগে পরিষ্কার আকাশটার দিকে তাকাতেই মনে প্রশ্ন এল- শেষ কবে এমন স্বচ্ছ আকাশ দেখেছি যেখানে শুকতারা,সপ্তর্ষিমন্ডল,লুব্ধক কিম্বা এক আস্ত চাঁদ এমন সোহাগি হয়ে শিয়রে ছড়িয়ে থেকেছে?
'জাগে জাগে রাত ভোর হবে, ভোর হবে বলে...''
পরদিন ভোর থাকতেই হাঁটতে বেরোলাম ভোরের কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে চেয়ে।রিসর্ট ছেড়ে ক' পা হাঁটতেই সাক্ষাৎ পেলাম স্লিপিং বুদ্ধের।লালপুল থেকে তার এতটা রেঞ্জ যে দেখা যাবে ভাবনার বাইরে।সে সঙ্গে সূর্যরশ্মির ছ'টায় ক্ষণে ক্ষণে তার রং পাল্টানো!সহজে ভোলার নয় সে দৃশ্য।একটুপরে ব্রীজ পেরিয়ে আমরা আবার জঙ্গলের পথে।হঠাৎ দেখতে পেলাম এক বিশাল ময়ূর তার ভারী পাখনা মেলে পুরো নদীটা পার হোল আড়াআড়িভাবে।আড়মোড়া ভাঙ্গা তার খেচড় উড়াল স্মরণীয় হয়ে আছে আমাদের কাছে। গুটিগুটি পায়ে ট্রেন লাইন ধরে এগোতে গিয়ে চোখে পড়ল আরেক দৃশ্য - ভোরের সূর্যরশ্মির ছোঁয়ায় ট্রেনলাইনের ওপরে সারারাতের জমে থাকা শিশিরের বাষ্প হয়ে ক্রমাগত উড়তে থাকা।ওপরে পাতারাও তখন শিশিরের পরশে ঝুঁকে রয়েছে গাছে গাছে।লাইনের ওপর বসে পাখিদের লাফালাফি দেখে ফিরে এলাম রিসর্টের দিকে।হেমন্তের অরণ্যের সে ভোর এক স্নিগ্ধ পরশ নিয়ে জুড়ে থাকল চিরকালীন হয়ে।
'বিদায় পরিচিতা, এই বিদায়ের সুর/চুপিচুপি ডাকে দূর বহুদূর... '
জঙ্গল থেকে ফিরে সকালে রিসর্টে ঢুকতেই চা-বিস্কিট রেডি।ততক্ষণে অন্যরাও সবাই ঘুম ভেঙে গোলঘরে জড়ো হয়েছে।সেখানে বসে আবার এক প্রস্হ আড্ডা হোল।একফাঁকে সকালের টিফিন করে এবার ধীরে ধীরে ফেরার পালা।'আবার আসব' বলে অমিতদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম আমরা।পিছে পড়ে রইল অবকাশের আতিথেয়তা, অমিত-স্বপ্নার আন্তরিকতা, লালপুলের নির্জনতা আর অগুনতি স্মৃতির আনাগোনা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴