হলুদের গন্ধওয়ালা মায়ের আঁচল/কাঞ্চন রায়
হলুদের গন্ধওয়ালা মায়ের আঁচল
কাঞ্চন রায়
শ্রীচরণেষু মা,
তোমাকে হঠাৎ চিঠি লিখতে ইচ্ছে হল। কেমন আছ মা? আমার দশ বছরের ছেলে, তোমার আদরের নাতি কী বলে জানো? বলে, ঠাকুমা আছে তারাদের দেশে। সেই থেকে রাতে মাঝে সাঝে আকাশ যখন পরিষ্কার, তখন আমি ছেলেকে নিয়ে ছাদে গিয়ে উঠি। আকাশের দিকে তাকিয়ে আমরা তোমাকে খুঁজে বেড়াই। তারপর, অনেক রাতে ছেলে ঘুমিয়ে পড়লে আবার আমি একা ছাদে আসি। আকাশের দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনেক সময় মনে হয়, অনেক তারাদের ভিড়ে ওই তো তুমি! তুমিও আমাকে দেখছ! ছেলের মতো আমারও বিশ্বাস জন্মে গেছে। তুমি সত্যি সত্যি তারা হয়ে গেছ। তারাদের দেশে কী চিঠি যায় মা? কোনোদিন তোমাকে আমার চিঠি লেখার সুযোগ হয়নি। আজ আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখলাম তোমাকে।
জানো মা, অনেক সময় আমার বোকা হতে ভীষণ ভালো লাগে। খুব ছোটবেলায় তোমাকে আমি যখন জিজ্ঞেস করতাম, বল না মা, আমি কোথা থেকে এসেছি? তুমি বলতে, তোকে আমি কলাগাছের ঝোপে কুড়িয়ে পেয়েছি। অনেক বছর সেটাই আমার বিশ্বাস ছিল। কতদিন যে নিজের ভেতরে একথা লালন করেছি বলে বোঝাতে পারব না। ভাবতাম, ইস, মা যদি আমাকে ওখান থেকে কুড়িয়ে না আনত তাহলে কি হত? তুমি হাসছ মা? কিন্তু বিশ্বাস কর, কিছু মিথ্যার মিশেলে জীবনে যে রূপকথার জন্ম হয় তা সত্যি দিয়ে কখনও উপলব্ধি করা যায় না। আমার জীবনটা শুরুই হয়েছে রূপকথা দিয়ে, শেষটা যেন রূপকথা দিয়েই হয়। তুমি তারাদের দেশে ভালো থেকো মা।
জানো মা, আমি আজও তোমার শাড়ির আঁচলটা খুব মিস করি। তোমার সেই নুন হলুদের গন্ধওয়ালা আটপৌরে সুতির শাড়ির আঁচল। ঘেমে নেয়ে একশা, তোমার আঁচল। স্নান শেষে গা ভেজা, তুমি দৌড়ে এসে আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিতে। খাবার খাওয়া শেষে আবার সেই আঁচল। সেই অভ্যাসটা অনেক বড় বয়েস অব্দি থেকে গেছিল আমার। মুখ ধুয়ে গামছার বদলে তোমার আঁচল খুঁজতাম। কতদিন যে তোমার সাদা কাচা আঁচলে হাত মুখ মুছে দাগ ফেলে দিয়েছি। জানো মা, অনেক বড় বেলায় আবার ছোটবেলাটা ফিরে আসে। এখন আবার তোমার সেই আঁচলটা খুঁজে বেড়াই।
তুমি খুব ফুল ভালোবাসতে। আমাদের দুঘরের ছোট্ট বাড়ির সামনের এক চিলতে জায়গায় লক্ষীপূর্ণিমার দিন কত গাঁদা ফুলের গাছ লাগাতে। বলতে, পূর্ণিমায় গাঁদা ফুলের গাছ লাগালে ফুলগুলো চাঁদের মতো বড় হয়। আর ছিল সন্ধ্যামালতি, দোপাটি। সাদা ফুলের গাছ ছিল একটা।একবার রায় ডাক্তারের বাড়ি থেকে ডালিয়ার চারা এনে লাগিয়েছিলে। তাতে ফুল এলে তোমার কী আনন্দ মা। এখন আমার বাগান ফুলে ফুলে ভরা। তাতে কত রকমের ফুল। কত নতুন নতুন ফুলগাছ। কোনোদিন দেখোনি ওসব ফুল।
একবার আসবে মা আমার বাগানে। যখন সাদা আর গোলাপি স্থলপদ্ম ভরে থাকবে গাছে। যখন এক আকাশ তারার মতো শিউলি ফুটে থাকবে গাছে, আর টুপটাপ করে ঝরে পড়বে নিচে। গাছের নিচটা যখন শিউলির সাদা চাদরে মুড়ে যাবে আর বাতাসে শিউলির গন্ধ ভেসে বেড়াবে। আমি ওই সাদা চাদরে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারাদের ভিড়ে তোমাকে ডাকব। তুমি আসবে মা? বসবে একবার আমার পাশে? ফুলের সুবাসের ভেতর ওই আঁচলের গন্ধটা একবার পেতে চাই যে। আসবে মা?
ইতি -
তোমার আদরের হীরেমানিক
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴