সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon

হলং বাংলো নিজেই একটা ইতিহাস, একটা উজ্জ্বল স্মৃতি/প্রশান্ত নাথ চৌধুরী

হলং বাংলো নিজেই একটা ইতিহাস, একটা উজ্জ্বল স্মৃতি
প্রশান্ত নাথ চৌধুরী


উপরওয়ালার আমার উপর অসীম কৃপা। আমি চাকরি জীবনের একটা বিস্তির্ণ সময় জুড়ে উত্তরবঙ্গের পাহাড়, নদী ও জঙ্গলের পথে ঘুরেছি বছরের পর বছর। অবসরের পরেও আমার সেই আকর্ষন একটুও কম হয়নি। ইতিমধ্যে আমার বয়সের বেড়ে যাওয়ায় বিরাম নেই, কিন্তু আমি তেমন কিছু টের পাই না। নিজে আমল না দিলে কি হবে বাড়ির পাহারাদার পেছনে সার্চলাইট জ্বালিয়ে রেখেছে। পাহাড়াদারের পদার্পণের কিছু দিন আগে আমি তখন ইরিগেশন দপ্তরে চাকরি করি। ওরকম বিন্দাস অফিস ও মহোৎসবের চাকরি জীবন ক'জনের কপালেই বা জোটে? 
একদিন অলকের বাড়িতে ঠিক হলো অলক, ওর স্ত্রী পলি, বাসু ও আমি হলং বাংলোতে রাত্রি বাস করব। অলক দুটো রুমের ব্যবস্থা করেছিল। সেটা বোধহয় ১৯৭৬ সন। 
প্রথম ফাল্গনের উত্তর বঙ্গের বন থাকে ফুলে ফুলে ভরা। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, হঠাৎ কোথাও পলাশ আর জঙ্গলের ঝোপঝাড় ভরা থাকে ফুলে। তেমন এক ফাল্গুনের বিকেলে ডুকেছিলাম হলং বাংলোর জঙ্গুলে রাস্তায়। পথে সাদা মোজা পায়ে একদল বাইসন রাস্তা  থেকে বোকার মত দেখছিল দু-পেয়ে আগন্তুকদের । বাংলোর এলাকায় ঢুকতেই ছিল একটা কাঠের দরজা তারপাশে বিপুল একটা শিমুল গাছ থেকে হাওয়ায় উড়ে এল তুলো আর তুলো। মনে হয়েছিল আকাশ থেকে সাদা ফুলে অতিথিদের স্বাগত জানিয়েছিল নিস্তব্ধ অরন্য। 
দুটো ঘর বেশ সুন্দর, পরিচ্ছন্ন। পাশের জানালা দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের হলদে আলোয় পাখির দল বাড়ি ফিরছিল। ওরাও কেমন চুপচাপ। 
আমরা প্রচুর খাবার সঙ্গে এনেছিলাম। ফ্রেশ হয়ে ঘরে আসতেই চা বিস্কুট। আমরা নেমে এলাম বাংলোর সামনে। লবনের গর্তটার আশেপাশে কয়েকটা স্পটেড হরিণ, সদা চঞ্চল। তিনটে বিশাল বপুর হাতি হাল্কাচালে ঘুরছিল। সামনে থেকে বন্যপ্রাণ দেখার একটা অন্যরকম উপলব্ধি। 
একা একজন মহিলা নদীর পাড়ে বসেছিল। একটু পরেই এক ভদ্রলোক পাশে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বললেন 'আমরাও আজ দুপুরে এসেছি। খড়দা থেকে'। আবার ফিসফিস করে বললেন 'ওই যে আমার স্ত্রী, বোধহয় রাগ করেছে'।ভদ্রলোকের মুখ থেকে সুরার হালকা গন্ধ ভেসে এসেছিল। 
তৃতীয়ার  চাঁদের অনুজ্জ্বল আলোয় ভাসমান বনের গাছ পালা। একজন গার্ড এসে বললেন 'দোতলায় বসার ঘরে বসুন'। না চাইতেই আবার চা এলো। ময়ূরের কর্কশ ডাকে মাঝেমাঝেই আড্ডার সুর ভঙ্গ হচ্ছিল। ওই খড়দার নববিবাহিত দুজন, কোনায় বসে মৃদুস্বরে কথা  বলছিল। তবে মহিলা যথেষ্ট চুপচাপ। রাত নটায় ডিনার, যথেষ্ট ভাল রান্না ও পরিবেশন। বন্ধুরা একসাথে হলে যা হয় অনেক রাত হলো বিছানায় যেতে। জেগে উঠলাম তক্ষকের বীভৎস ডাকে। জানতাম , ওই বাংলোয় তক্ষক আছে কিন্তু তার ডাক যে এতটা ভয়ঙ্কর জানা ছিল না। রাত বাড়তেই টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল টিনের চালে সেই শব্দ বেশ রোমান্টিক। অন্যদিকে রাতে ময়ূরের ডাক একান্তই মর্মান্তিক। 

হঠাৎ লবিতে মহিলার কান্না আওয়াজ ও হালকা কথা কানে এলো। এরপর একটা ভারি শব্দ, তখন রাত আড়াইটে। বেশ ঠান্ডাও লাগছিল। ঘরের বাইরে এলাম। দেখলাম মহিলা ভীষণ ক্রুদ্ধ। হাতে ব্যাগ, বাইরে যেতে চাইছেন। বললাম 'নীচে চৌকিদার পাহাড়ায় বাইরে যেতে দেবে না। বৃষ্টি হচ্ছে,আর বাইরে আছে হিংস্র পশু'।  উনি রেগে বললেন' একটা লোক দুপুর থেকে সমানে মদ খেয়ে যাচ্ছেন। এ আমি বরদাস্ত করব না'। অনেক বোঝানোর পর মহিলা লবির সোফায় বসে রইলেন। আর ভদ্রলোকের তখন চূড়ান্ত নেশাগ্রস্থ। অবিরাম ক্ষমা চেয়ে চলেছেন। 
আমাদের পরদিন জঙ্গল সাফারি ছিল সকাল ছটায়। হাতির পিঠে রওনা দিলাম জঙ্গলের পথে। হাতির ছোট বাচ্চাটি চলছিল মার সঙ্গে। মাঝে মাঝেই বাচ্চা এদিক ওদিক চলে যায়। মা দাড়িয়ে পড়ে। অনেক প্রজাতির হরিণ, বাইসন, বন্যহাতি ও গন্ডারের সাক্ষাৎ পাওয়া গেল। আর সকালে যে কত রকম পাখি একটানা কিচিরমিচির চালিয়েছিল মনে নেই। বৃষ্টির জল ছিল গাছের পাতায়। টুপটাপ সেই জল গায় পড়ছিল। কত গাছের কত রকম রঙ,কত রকম গন্ধ। মনে হয় গভীর অরণ্যে গাছও কথা কয়। কি যে বৈচিত্র্য পূর্ণ সে সফর তা ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়। প্রায় দু ঘন্টা পরে ফিরেছিলাম। মাহুত বকশিশ নেয়নি 'বলেছিল সরকারি চাকরি করি বকশিশ নিই না'। 
বাংলোয় ফিরে শুনলাম খড়দা পার্টির সাফারি আমাদের সঙ্গেই বুকিং ছিল , তারা যায়নি। তখনও তাদের সাড়াশব্দ নেই, দরজা বন্ধ। 
বাংলোর কর্মীরা ওদের ডেকে তুলল নটায়। দেখা গেল ভদ্রলোক মেঝেতে কম্বলমুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। সকালে ব্রেকফাস্টের পর ঘর ছাড়তে হবে। ওরা অবশ্য সেদিনও থাকবে। আমরা আশেপাশে একটু ঘুরে নিয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে দেখি ওরা দুজন খেতে খেতে গল্প করছে। যেন এই বৃষ্টি এই রোদ। 
ফেরার সময় ওদের বলেছিলাম ' আবার দেখা হবে। মজায় থাকবেন'। মহিলা বললেন 'সমস্যা নেই ওর স্টক বেসিনে ঢেলে দিয়েছি'। আমরা হাত নেড়ে রওনা দিলাম। 
লেখাটা এখানে শেষ করলেই ভাল হতো।  আসলে এরপর লেখার কিছু থাকে না। কিন্তু কখন কোথায় কার সঙ্গে দেখা হবে বলা যায় না। 1978 এ শান্তিনিকেতন পৌষ মেলায় আমার সেচ দপ্তরের দিদি রত্না গাঙ্গুলীর সঙ্গে গিয়েছিলাম। দুদিন ছিলাম । সর্বক্ষণ মেলার আশেপাশে, কখনো কোপাই নদীর পাড়ে কখনও সাঁওতাল পল্লীতে। মেলায় সেবার দেখা হয়েছিল সত্যজিৎ রায়, সুচিত্রা মিত্র এবং কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। একদিন আমার দিদিটি মেলায় একটা চামড়ার উপর বাটিকের কাজ করা ব্যাগ দরদাম  করছেন। এক মহিলা পাশে দাঁড়িয়ে বললেন' মনে আছে, আমরা খড়দার'। উনার পরমবাধ্য স্বামী ভদ্রলোক আকর্ণ হেসে বললেন 'ভাল আছেন'? টুকটাক দু চারটি কথার পর বললেন ' একদম ছেড়ে দিয়েছি। তবে অনেক দিনের অভ্যাস মনটা আনচান করে'। বললাম 'আনচান করুক আর নয় কিন্তু'। উনার স্ত্রী বললেন' ভাল হয়ে গেছে। শাসন তো কম করিনি'। 

তারপরও হলঙে  সপরিবারে থেকেছি। ব্যাংকের বোর্ড মিটিং করেছি ওখানে , জেলা প্রশাসন ও বন দপ্তরের বদান্যতায়। মিঠু যখন আলিপুরদুয়ারের এম. এল. এ. তখন আমরা এক বিকেলে ওই বাংলোতে সন্ধ্যায় কিছুটা সময় সল্ট পিটের উল্টো দিকে নদীর ধারে হাতি ও গন্ডারের মুখোমুখি বসে চা পান করেছি। জীবন সায়াহ্নে ওই সব স্মৃতি উজ্জ্বল এখনও। হলং বাংলো গত ১৮ই জুন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, কত স্মৃতি আগুনে ছাই হয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। কেন এমন হয়? 

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri