স্লিভলেস টপ/শুক্লা রায়
স্লিভলেস টপ
শুক্লা রায়
------------------
মেয়ের দিকে তাকিয়ে সুনীতা অবাক হয়ে যায়। "একি! এটা তুই কী পরেছিস?" মেয়ে সুপ্রিয়া ততোধিক অবাক হয় মায়ের রি-অ্যাকশন দেখে। "কেন? তোমার অত সমস্যা কেন? আর কারো মা তো এরকম করে না?"
সুনীতা এবার চিৎকার করে। "খোল বলছি, খোল! ওই জামা আগে খুলবি, তারপর বাইরে বের হবি।" মেয়ে একবার শেষ চেষ্টা করে, সেও চিৎকার করে, "মা!"
চাপা একটা স্লিভলেস টপ, তার সামনেটা এতটাই ডীপ যে না ঝুঁকতেই ক্লিভেজ দৃশ্যমান। আর এই পোশাক পরে মেয়ে কলেজে যাচ্ছে। সুনীতা জাস্ট ভাবতে পারে না। গনগনে মুখে আর একবার তাকাতেই মেয়ে ধীরে ধীরে ঘরে গেল। একটু পরে ওই জিন্সের সঙ্গেই একটা কুর্তি পরে টিপটপ হয়ে বের হল। ঠোঁটের কোণায় দুষ্টু হাসি। মনটা ভালো হয়ে গেল। মেয়ের দিকে তাকিয়ে সুনীতাও এবার হাসল। নরম গলায় বলল, "তাড়াতাড়ি ফিরিস মা। দিনকাল ভালো নয়।" বলতে গিয়ে মনে পড়ল মাও তাকে এভাবেই বলত। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুনীতা ঘরের কাজে মন দিল।
রাস্তায় নেমেই সুপ্রিয়া আগে দীপনকে ফোন করল। খানিকটা ন্যাকামো, খানিকটা প্রেম মিশিয়ে কথা শেষ করেই বাস ধরল। সোজা কলেজ। কলেজের কমনরুমে ঢুকে ফাঁকা দেখে চট করে আপারটা চেঞ্জ করে নিল। সকালের টপটা ভাঁজ করে সঙ্গে এনেছিল। এখন ওটা গায়ে উঠল আর গায়েরটা ব্যাগে চলে গেল। ততক্ষণে দীপনসহ আরো বন্ধু-বান্ধবরা চলে এসেছে। দীপনের সঙ্গে পরিচয় সেকেন্ড ইয়ারে উঠে। তার আগে সুপ্রিয়া সিঙ্গলই ছিল বলা যায়। একটু খুচখাচ প্রেম প্রেম হলেও একেবারে জব্বর প্রেম বলতে যা বোঝায় সেই ব্যাপারটা ছিল না কারো সঙ্গে। এখন দীপন আসাতে সুপ্রিয়ার সাজগোজও পাল্টে গেছে। একটু খোলামেলা পোশাক পছন্দ দীপনের। একটু আড়াল, একটু কাছে আসা চলছে। তবে এর মধ্যেই ওরা কয়েকজন দল বেঁধে বাইরে দুদিন কোথাও কাটিয়েও এল ঝপ করে। ছয় জনের দল। তিন বান্ধবী আর বয়ফ্রেন্ড। সুপ্রিয়া জানে ছেলেরা বেশিরভাগই সুযোগসন্ধানী। কিন্তু দীপন সেরকম নয়। ওর মতো সহজ-সরল ছেলে তো খুঁজে পাওয়াই কঠিন আজকাল।
সরস্বতী পুজোর দিন মেয়েকে দেখে তৃপ্তিতে বুক ভরে গেল সুনীতার। একদম সাদা ধবধবে শাড়িতে সুতোর কাজ করা কালো ব্লাউজ, সঙ্গে মানানসই কীসব গয়না পরেছে। আজকালের ফ্যাশন। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। এই মেয়েটা তারই মেয়ে, ভাবতেই গর্বে বুকটা ভরে ওঠে। "মা, আসছি!" মায়ের তাকিয়ে থাকা দেখে হাসতে হাসতে সুপ্রিয়া চোখের সামনে হাতটা নাড়ে। তারপর মাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খায়।
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল, রাত নেমে ঘন অন্ধকার আর কুয়াশায় ঢেকে এল চারদিক। যে রাস্তাটায় সারাদিন ছেলে-মেয়ের ঢল নেমেছিল হালকা শীত গায়ে জড়াতে জড়াতে সে রাস্তাও এখন সুনসান। বহু অপেক্ষার পরেও মেয়েটা ফিরল না। ফোন সুইচড অফ। মনটা কু ডাকছিল সন্ধের পর থেকেই। এখন যেন সেটা সত্যি হতে চলেছে। সুনীতা অস্থির হয়ে ওঠে। চেনাজানা বন্ধু-বান্ধব সবার কাছেই ফোন করল রমেশ, সুপ্রিয়ার বাবা। খোঁজ পেতে দীপনের নাম্বারটাও জোগাড় করল। সেখানেও ফোন গেল। না দীপন আজকে কলেজেই যায়নি। বাড়ির আশেপাশেই কাটিয়েছে। আসলে কিছুদিন হল সুপ্রিয়ার সঙ্গে একটু কাট কাট চলছে। এর মধ্যেই অনিন্দিতা ঢুকব ঢুকব করছে দীপনের জীবনে, কতকটা ঢুকেও গেছে বলা যায়। সুপ্রিয়ারও নাকি তাই। কিন্তু পরেরজন আসলে কে তার খোঁজ বন্ধু-বান্ধব এখনও কেউ আঁচ করে উঠতে পারেনি। নিজেদের ছাড়াছাড়িটা নিয়ে এখনও স্পষ্ট কিছু না বললেও দুজনেই পরস্পরের কাছ থেকে সরে গিয়ে নতুন বন্ধু নিয়ে ব্যস্ত।
সারারাত হয়রান হয়ে খোঁজ খবর করে ক্লান্ত মানুষগুলোর যখন চোখটা ভোরের দিকে একটু লেগেছে মাত্র, তখনই ফোন। পরিচিত একজনের কাছ থেকে। ভোর বেলা হাঁটতে বেরিয়ে ক্ষেতের পাশে কী একটা পড়ে আছে দেখতে গিয়ে সুপ্রিয়াকে দেখতে পায়। ইঙ্গিতে বোঝা গেল ওটা আসলে সুপ্রিয়ার ডেডবডিই। সুনীতা তখনই র্মূচ্ছা গেল। কিন্তু না, কাছে গিয়ে দেখা গেল প্রাণ আছে।
ফেসবুকটা খুলতেই সুপ্রিয়ার ক্ষতবিক্ষত শরীরের ভিডিওটা দেখতে পেল দীপন। ভাইরাল ভিডিও। ক্যামেরা ক্লোজ করে মেয়েটার শরীরের নানান ক্ষতস্থান দেখাচ্ছে, মায় গোপন অংশগুলি পর্যন্ত, তার সঙ্গে উত্তেজিত কন্ঠে ঘটনার বিবরণ। যাকে বলে একেবারে জবরদস্ত সঙ্গত। এ শরীর অবশ্য দীপনের অপরিচিত নয়, তবু খুঁটিনাটি সবটা দেখল। হাতজোড় করে সুপ্রিয়ার বাবার অসহায় কান্নাটাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। যতটা পারছে মেয়েকে আড়াল করার চেষ্টা করে চলেছে ক্যামেরার চোখ থেকে। কিন্তু সে চেষ্টা আদৌ কোনো কাজে লাগেনি চতুর ক্যামেরাম্যানের দক্ষতায়। এর মধ্যেই বিজ্ঞাপন পেয়ে গেছে চ্যানেলটি। দ্রুত ভিউয়ার বাড়ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেন্টস। পারলে জনতা এখনই এই নরপশুটাকে খুন করে ফ্যালে। কেউ কেউ তো গোপনাঙ্গ কর্তন করার সুপরামর্শ পযর্ন্ত দিচ্ছে। এত মানুষ ধর্ষণের বিপক্ষে। ভাবা যায়! অথচ তবু ধর্ষণ বন্ধ হবে না, তবু রাস্তাঘাটে মেয়েরা নিরাপদ নয় সবাই জানে। "কারণ ফেসবুকের আমরা আর বাস্তবের আমরা তো এক নই!" ফোনটা বন্ধ করে বিছানায় একটু হাত পা এলিয়ে পড়ে থাকে দীপন। তারপর ভিডিওর লিঙ্কটা হোয়াটসঅ্যাপ এ অনিন্দিতাকে শেয়ার করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ডায়াল করে। ফোন ধরে অনিন্দিতাই আগে কথা বলে, "ওই, তুইও দেখেছিস ওটা? আমিও দেখেছি। তোর এক্স। হি হি হি।" তারপর একটু থেমে গম্ভীর হয়ে গলায় একটু দুঃখ মিশিয়ে বলে, "ইস, কী অবস্থা রে মেয়েটার। রিলেশন করা ঠিক আছে, বাট ভাবা উচিত। বাট ছেলেটা কেমন, বাড়ি কোথায়। বাট। ইস।"
দীপনও হাসে। বলে, "হুম। ঠিক বলেছিস।" তারপর সিরিয়াস গলায় বলে, "কিরে আজকের প্ল্যান মনে আছে তো!" এবার কন্ঠে একটু আদর মিশিয়ে বলে, "আজকে না এলে আমি কিন্তু মরে যাব।" অনিন্দিতার গলাও অনুরাগে গাঢ় হয়। ফোনেই কিছুক্ষণ খুনসুটি চলে। তারপর বেরোতে হবে বলে দুজনে বাধ্য হয়ে ফোন রাখে।
মাসখানেক লাগল সুপ্রিয়ার পুরো সুস্থ হতে। সুস্থ হয়ে দেখল তার পৃথিবীটা পুরো পাল্টে গেছে। কোনো বান্ধবী আর তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে না। ফোন করলে সবাই কেমন এড়িয়ে যাচ্ছে। তার পরিবার থানা-পুলিশ কিছু করেনি। কিন্তু তাতে কী! জেরা করবার জন্য শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যা প্রচুর। নিত্য নানারকম লোক আসছে বাড়িতে। মেয়ে-পুরুষ। আকারে ইঙ্গিতে একটাই প্রশ্ন। কতজন ছিল। কীভাবে হল। কাউকে চিনতে পেরেছে কিনা। সুপ্রিয়া চুপ করে থাকে। চিনতে পারবে না কেন, সে তো খুব আপন ভেবেই কারো হাত ধরেছিল, অতি পরিচিত জন তার। চুপ করে থাকলে কী হবে! বুঝতে পারল একবার অসম্মান হলে নিজের বাড়িটাও আর লুকোবার জন্য নিরাপদ থাকে না।
সুপ্রিয়া যেদিন ওড়না জড়িয়ে ফাঁসিতে ঝুলল, সেদিন লোক জানল অল্পই। ওর মায়েরও চোখের নদী ততদিনে শুকিয়ে এসেছে। চুপচাপ সৎকার শেষ করে গোটা পরিবারটাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴