স্মার্টনেস/শুক্লা রায়
স্মার্টনেস
শুক্লা রায়
---------------
ভোরবেলা হাল নিয়ে যাওয়ার পথে পরেশ দেখে চার-পাঁচজন ছেলের একটা দল ব্যাগ-পত্তর নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। পরেশ একটু দাঁড়াল। তারপর হাঁক দিল, "কোথায় যাচ্ছিস রে সব?"
দলটা ততক্ষণে প্রায় ওর সামনে এসে পড়েছে। দেখেই বুঝল এরাও কেরালা যাচ্ছে কাজ করতে। বিনোদের ছেলে আর অসীমের ছেলেকে দেখে তো আকাশ থেকে পড়ল। "কি রে, তোরা নাইনে পড়িস না? বাইরে যাচ্ছিস যে, পড়াশুনার কী হবে?" বিনোদের ছেলে চঞ্চল হেসে বলে, "পড়াশুনা করে কী হবে কাকা? চাকরি-বাকরি নেই! পাশ করে সবাই তো সেই ঘুরেই বেড়ায়। শুধু শুধু সময় নষ্ট।" কথাটা ঠিক। রতনের ছেলেটার কেরালায় যাওয়ার ক'বছর হল! এর মধ্যেই বোনের বিয়ের সময় যে জমিগুলো বন্ধক দিয়েছিল সব ছাড়িয়ে নিল। এবার বাড়ি এলে নাকি হাফ ওয়াল ঘর দেবে। রতন বসে বসে বিড়ি ফোঁকে আর গল্প করে। সেদিন স্কুলের মাস্টারও বলছিল, স্কুল গুলোতে এখন উল্টো চিত্র, ছেলের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা বেশি। ছেলেরা সব রোজগারের ধান্দায় ভিন রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে। আসলে যারা গেছে তাদের কাছে এত এত গল্প শুনে অল্প বয়সেই ছেলে-পিলেদের চোখে কেমন টাকার নেশা লেগেছে। বড় কিছু করার থেকেও দামী বাইক, দামী ফোনের লোভ কমবেশি সবার ভেতর। অতএব দাও বিদেশ পাড়ি!
দুটো ব্যাচ টিউশন পড়িয়ে রঞ্জন বাড়ি আসে। একটু হতাশ ভেতরে ভেতরে। দিনের পর দিন একটা চাকরির অপেক্ষায় এত কষ্ট স্বীকার। হয় পরীক্ষা বাতিল নয়ত চোরা পথে আগেই সব লেনদেন হয়ে গেছে। বাবা তো আর এসব বোঝে না, শুধুই রাগ দেখায়। আর গ্রামে ছাত্র পড়িয়ে ক' পয়সাই বা রোজগার! হাতখরচটাই উঠে না। স্মল ফাইনান্সের একটা নতুন অফিস খুলেছে। এরা ঝকঝকে স্মার্ট ছেলে-মেয়ে খুঁজছে। রঞ্জন ভাবছে অফিসটায় একবার যাবে।
জমি বিক্রির টাকাটা হাত পেতে নিতে পরেশের বুকটা কেঁপে উঠল। বাপের আমলের জমি। নিজে এক কণা মাটিও কিনতে পারেনি। জমিতে আয় আর কতটুকু। অথচ বাজারে সবকিছুরই দাম বেড়েছে। তবু জমিটুকু বেচার কথা কখনো ভাবেনি পরেশ। ছেলে বলছে ওর কোম্পানিতেই তিন বছরে টাকা ডবল। ভেবে দেখল জমিতে যা আয় তার থেকে অনেক বেশি পাবে। তাছাড়া তিন বছর পরে আবার এই টাকাটাই ডবল করে নেওয়া যাবে। তবু শেষ সম্বল এই জমিটুকু বিক্রি করতে পরেশের বুকটা হুহু করে উঠল।
স্মল ফাইনান্স কম্পানিটাতে জয়েন করার সাথে সাথে রঞ্জনের ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল। বেতন ছাড়াও প্রচুর কমিশন। গর্ভমেন্ট রেজিস্টার্ড কোম্পানি। সাইনবোর্ডে পরিস্কার লেখা আছে। কাজের ধরণ অনুযায়ী ওকে পোশাক-আশাকও চেঞ্জ করতে হয়েছে। শীত, গ্রীষ্ম একই পোশাক। কোট, প্যান্ট আর টাই। পায়ে দামী শু। সবসময় চকচক করছে। ও যখন কোনো বাড়িতে গিয়ে বসে, পলিসি জোগাড় করতে, সব লোকজন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। চেনা-জানা মানুষজন বিশ্বাসই করতে পারে না। চোখে দেখেও। গ্রামেরই ছেলে। কী বড় চাকরি করে এখন। কপাল! প্রায় সবাই ওর কাছে টাকা রেখেছে। অনেকে ম্যাচুওরিটির টাকা পেয়েও গেছে। এতেই সবার বিশ্বাস আরো বেড়েছে। ওর সবচেয়ে বড় সাফল্য ওদের স্কুলের হেডমাস্টারকে রাজী করিয়ে একটা পলিসি করানো। এই পাঁচ বছরের নিরন্তর চেষ্টায় ও এই বিশ্বাসটুকু অর্জন করতে পেরেছে। টিউশনিগুলো সব ছেড়ে দিয়েছে। সময় কোথায়! সকাল হলেই নেমে পড়ে টাকা জোগাড়ে। কাজটা যেন নেশার মতো আষ্টেপৃষ্টে বেঁধেছে ওকে। প্রথম তিনটি বছর ওকে কঠিন লড়াই করতে হয়েছে। কিছুতেই লোককে বোঝানো যায় না। একজন তো বলেই দিল, "বাবা হে, বিশ্বাস করে এত কষ্টে জমানো টাকাটা দিই আর তারপরে কোম্পানি উঠে যাক। এই রিস্ক কে নিবে? তোর বাপের তো কিছুই নাই যে বিক্রি করে লোকের টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে।" কথাটা অপমানে লাগলেও রঞ্জন সেটা তার আচরণে প্রকাশ করেনি। এটা ওর কাজের শর্তের মধ্যেই পড়ে। তারপরেও হাসিমুখে একবার রিস্ক নেওয়ার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু সে ব্যক্তি রাজী হয়নি। তবে তিন বছরে যখন সত্যিই অনেকে ডবল টাকা পেল তখন নিজেই ডেকে তিন লাখ টাকা হাতে তুলে দিয়েছিল।
এ মাসে একসঙ্গে অনেকগুলো ম্যাচুওরিটির ডেট। আজকেই পাঁচটা ম্যাচুওরিটি আছে। সকাল সকাল খেয়ে বাইক নিয়ে অফিসের পথে বের হয়। আজকে আর ফিল্ডে যাবে না। কালকেই ও অনেক কালেকশন দিয়ে এসেছে প্রায় শেষ বেলায়। না দিলেও পারত। আজকে দিলেও হত। কিন্তু অত টাকা বাড়ি আনতে ভয় পায়। সেজন্য জমা করেই এসেছে। আজকে প্রচুর কাজ। এতজনের টাকার ম্যাচুওরিটি ওর হাত ধরে। ভেতরে ভেতরে একটু টেন্সড হয়। এখানে রঞ্জন ছাড়াও আরো এগারোজন ছেলে-মেয়ে ফিল্ডে কাজ করছে। প্রত্যেকের পারফরমেন্স ভালো। বেরোতে বেরোতে তবু দশটা বাজল। মাঝপথে যেতে না যেতেই অনিমেষের ফোন, "রঞ্জন তুই কোথায়?"
ও তাড়াতাড়ি বলে "এই তো মাঝপথে আসছি।" ও পাশের কন্ঠটা একটু ইতস্তত করে বলে, "অফিস বন্ধ দেখছি। তুই কিছু জানিস?" রঞ্জনের অবাক লাগল। উত্তর দেবার আগেই ও পক্ষ বলল "আচ্ছা, তুই আগে আয়।"
দুপুর বারোটা পেরিয়ে গেলেও অফিস আর খুলল না। রাতারাতি যেন উবে গেল সব। ওরা বারোজন, ওদের ঘিরে পলিসি হোল্ডার ও উৎসাহী জনতা। কন্টিনিউ ফোনে ধরার চেষ্টা করছিল উপরমহলের অফিসারদের। সব ফোন বন্ধ। যোগাযোগের সব সূত্রই বন্ধ। যত্ন করে মুছে ফেলা হয়েছে সবরকম চিহ্ন।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴