স্বার্থপর/ভুবন সরকার
স্বার্থপর
ভুবন সরকার
অর্ক,
একটু আগেই রাত দু'টোর ঘন্টা বেজেছে দূরে কোথাও। আমি তোকে লিখতে বসেছি। জানি রাগ হবি, হয়তো আমার কপালে বরাবরের মতোই লেখা হবে বেহায়া খেতাব। তা হোক। এত রাতে কেন হঠাৎ তোকে লিখতে বসলাম ঠিক দু আড়াই বছর পর? কেন জানি তোর কথাই ভীষণ মনে পড়ছে আজ। কেন যে তোকেই আমার সবচেয়ে নির্ভর- যোগ্য বলে মনে হচ্ছে ।
নির্ভরযোগ্য শব্দটা দেখে হাসছিস হয়তো! হাসবার মতোই কথা। আমি জানি আমাকে নিয়ে আজ আর তুই ভাবিস না। ভাবার কথাও নয়। তোর আমার সম্পর্কের সুতোটা আমিই ছিঁড়ে এসেছিলাম যেদিন, সেদিন স্বপ্নেও ভাবিনি এমন একটা সময় আমার আসবে যেদিন তোর কাছে আমাকে.......।
তোর বেকারত্বকে বিদ্রুপ করে আমি যাকে বিয়ে করেছিলাম বাড়ির চাপে সেটা আমার জীবনে আশীর্বাদ না অভিশাপ ছিল জানি না। শুধু এটুকু জানতাম পদস্ত সরকারি চাকুরে। আগের স্ত্রী প্রথম সন্তান প্রসবের সময় মারা যাওয়ায় দ্বিতীয়বার বিয়ে করছেন। তুই ভালোভাবে জানিস অর্ক, যে পরিবারে আমার জন্ম সেখানে মেয়েদের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্যই নেই। আমি না পেরেছি সেদিন তোর উপর নির্ভর করতে না পেরেছি এমন সম্পর্ক ফিরিয়ে দিয়ে সবার গলগ্রহ হয়ে থাকতে। অগত্যা সমস্ত অতীত নিজের হাতে মুছে দিয়ে শুধু মাত্র একজন স্বচ্ছল মানুষের হাত ধরে জীবনে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম। আমি কী জানতাম অর্ক, আমি যা চেয়েছিলাম তা ভুল করে চেয়েছিলাম। একবারও আমি বুঝিনি অর্ক, যে সুখের সন্ধানে আমি তোর আশ্বাসে বিশ্বাস না রেখে নূতন জীবন শুরু করতে চেয়েছিলাম তা কতবড় ভুল ছিল!
আমি চলে আসার পর বেসরকারি একটা কোম্পানিতে সেলস অফিসারের কাজে যোগ দিয়েছিস তুই। বাড়ির সবার ইচ্ছেকে প্রাধান্য না দিয়ে আজও অকৃতদার আছিস। আর আমি ?
বিয়ের দুটি বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বিধবা হলাম। বাইক এক্সিডেন্টে মারা গেলেন আমার স্বামী। সে শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আমার জীবনে ঘনিয়ে এল আরেক বিপর্যয়। এক মারণ ব্যাধি সিংহ বিক্রমে আমার শরীরে থাবা বসিয়েছে। জানি সময় ঘনিয়ে আসছে। যে কোন সময় .........। যে কারণে আমি তোকে আজ এতদিন পর চিঠি লিখছি তা তোকে জানানো দরকার। বিয়ের প্রথম বছরেই আমার একটি মেয়ে হয়েছে। আমার অবর্তমানে আমি চাইনা বাড়ির কসাইদের কাছে মেয়েটা থাকুক। আর আমার শ্বশুর বাড়ি? তাদের কথা না হয় নাইবা বললাম ।
আগামী মাসের তিন তারিখ আমি বোম্বে যাচ্ছি। টাটাতে। আমার একটা ছোট অপারেশন হবে। এর আগেও দুবার গিয়েছি। ডাক্তার আমাকে বলেই দিয়েছে সময় ঘনিয়ে আসছে। তীব্র যন্ত্রণায় আমি যখন চিৎকার করি বিশ্বাস কর অর্ক, মনে প্রাণে চাই, কিন্তু কেউ একজন নেই রে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অন্তত একবার আমাকে একটা কিছু বলবে। আমার স্বামীর এক বন্ধু মেয়েটাকে কোনো এক অনাথ আশ্রমে রেখে এসেছে। তোর আগের মোবাইল নম্বরটা তাকে দিয়ে রেখেছি। আমি যখন থাকব না সেই তোর সাথে যোগাযোগ করবে। জানি, আমার উপর তোর খুব ঘৃণা, রাগ। হওয়াটাই স্বাভাবিক। জীবনে ভালোবেসে সুখ দিতে পারেনি তোকে, আজ আরেকটা অসুখ তোকেই দিয়ে যেতে চাইছি। যদি পারিস ক্ষমা করিস অর্ক।
একটা কথা। না না কথা নয় বিশ্বাস। কেন জানি আমার মন বলে। কাউকে যা বলিনি আজ তোকে বলছি সেই একান্ত বিশ্বাস। মনে আছে তোর অর্ক, সেই বোশেখ মাসের কালবৈশাখী ঝড়ের বিকেল বেলার কথা? আমি টিউশন শেষে বাড়ি ফিরছি। কালো মেঘ আর প্রবল হাওয়ায় সেকি দাপট। কড় কড় শব্দে বাজ পড়ছে। আমি ছুটতে ছুটতে তোদের বাড়ির বারান্দায় এসে উঠেছিলেম। তুই দরজা খুলে আমাকে ঘরে ঢুকিয়েছিলি। আলো চলে গেছে। একটা অন্ধকার ঘর। আমি ঝড়ের ভয়ে লেপ্টে আছি তোর বুকে। বাইরে তখন কাল বৈশাখীর সেকি মাতন। আর ঘরের ভিতর এক বিছানায় আমরা দুজন।
ভোর হয়ে আসছে। বাইরে পাখিদের আওয়াজ পাচ্ছি। একদিন স্বার্থপরের মতো তোকে ছেড়ে এসেছিলাম, আজ আবার স্বার্থপরের মতো তোর কাছে অনধিকার....।
মেয়েটার ডিএনএ টেস্ট করে দেখে নিস আমার বিশ্বাস সত্যি কিনা? আর একবার ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখিস তোকে খুঁজে পাস কিনা?
এটাই আমার শেষ চিঠি। আর কোনোদিন তোকে বিব্রত করব না। যদি পারিস মৃত্যুপথযাত্রী এই অসহায় বন্ধুর অনিচ্ছাকৃত অক্ষমতাগুলোকে ক্ষমা করে দিস।
ইতি
স্নেহা
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴