সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
25-June,2023 - Sunday ✍️ By- গৌতম চক্রবর্তী 555

স্থায়ী বসত গড়ে ইকো পর্যটনের গ্রাম বুংকুলুং/গৌতম চক্রবর্তী

 স্থায়ী বসত গড়ে ইকো পর্যটনের গ্রাম বুংকুলুং
গৌতম চক্রবর্তী

শিলিগুড়ি থেকে মাল্লাগুড়ি মোড় হয়ে দাগাপুর, নিউ চামটা, মোহরগাঁও গুলমা হয়ে শুকনা। শিমূলবাড়ি চা বাগান হয়ে সোজা গাড়িধুরা। গাড়িধূরা থেকে ডানদিকে লং ভিউ চা বাগান হয়ে সোজা পথটা চলে গেছে দুধিয়া হয়ে মিরিক। দুধিয়ার ওপারে পানিঘাটা নকশালবাড়ি। মধ্যিখানে বয়ে চলেছে বালাসন। গোকুল ছাড়ালেই আঁকাবাঁকা পথের শুরু। প্রতিটি বাঁক বড়ই বিপজ্জনক। সবসময় মনে হয় এই বুঝি মুখোমুখি সংঘর্ষ হল। কিন্তু পাহাড়ি ড্রাইভারদের কুশলতার প্রশংসা না করলেই নয়। গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে এরা ভীষণ নিয়মানুবর্তী। আমাদের বোলেরো ছুটে চলেছে। যাচ্ছি কার্শিয়ং এর পাহাড়ি গ্রাম ইকো পর্যটনের তীর্থক্ষেত্র বুংকলুং-কুলেনবাড়ি। চারদিকে পাহাড়, জঙ্গল, নদী, চা-বাগানের মাঝে এক অসাধারণ ঠিকানা ইকো গ্রাম বুংকুলুং। অনাঘ্রাত পর্যটনক্ষেত্র। দূরে পাহাড়ের গায়ে মহানন্দা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির হাতছানি। গোর্খা আর লিম্বু উপজাতিদের গ্রাম। পথের মাঝেই এসে পড়বে ময়ূরের ঝাঁক অথবা কালেজ ফ্লেজান্ট। আর অরণ্যের ঠাস বুনোট। দূরে বালাসন নদী। পাহাড়ের ধাপে সবুজ ধানের বাহার। অল্পচেনা এই গ্রামের নাম বুংকুলুং। এনজেপি থেকে মিরিক যাওয়ার পথে ১০ নম্বর ফটক থেকে ডানদিকে আঁকাবাঁকা পথ ধরে ১০ কিলোমিটার। জলপাইগুড়ি থেকে দুটি পরিবার মিলে পারিবারিক সফরে রওনা দিয়েছি এই ইকো গ্রামের বুংকুলুং ইকো হাটে। নাম বুংকলুং ইকো রিট্রিট। মঞ্জুর বাঁকে এসে একটু থামলাম। সিংভুলি, ফুগরি চা বাগানের রাস্তার ধারে দোকান ঘরটার পাশ দিয়ে মঞ্জু ডিভিশন। সামনেই মঞ্জুখোলা। মঞ্জুর কানন উদ্যান ঘেরা বিশ্রাম কক্ষের গোলঘর ছাতার মতো টোপর পরা। গাড়ি এক পাশে দাঁড় করিয়ে বিশ্রাম কুঞ্জে গিয়ে দেখি চা বাগানের মহিলা শ্রমিকরা বসে আছে। পাতা তুলতে যাবে। শীতকালে মঞ্জুতে ডিসেম্বরের শেষ থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পিকনিক প্রেমীদের তান্ডব নৃত্য। অন্য সময়ে চা বাগানের লোকজন ছাড়া কেউ আসে না। এমনকি যারা বেড়াতে আসেন তারাও খোঁজ খবর রাখেন না বা জানেন না মঞ্জু, বুংকলুং, নামসু এসব জায়গা কোথায়।

মঞ্জুকে বিখ্যাত করেছেন সুভাষ ঘিসিং। তাঁর নিজের গ্রাম, বাড়ি এবং প্রিয়তম জায়গা। রাজনীতির মানুষটার যে একটা শিল্পী মন ছিল মঞ্জু না এলে উপলব্ধি হতো না। মঞ্জুর মতই সৃষ্টি করেছেন অতিথি নিবাস রোহিণী টিলা। পাহাড় জুড়ে পিকনিক স্পট, ওয়েসাইড ইন। কানন বা উদ্যান যাই থাকুক না কেন, একটা শিবমন্দির বা জগদম্বার মন্দির অবশ্যই থাকবে। পুষ্প উদ্যান অবশ্য নষ্ট হয়ে গেছে। দেখলাম মন্দির, চারিদিকে চা বাগান, দু’পাশে পাহাড়। স্যাঁতস্যাতে বৃষ্টিভেজা পথে মঞ্জু চা বাগান, ঝোরা এবং জঙ্গলে কিছুক্ষণ হাঁটি, ছবি তুলি। আমাদের ছেলেরা ক্যামেরা এবং বাইনোকুলার নিয়ে পক্ষী পর্যবেক্ষণের বৃথা চেষ্টা করে। তারপর আবার রওনা দিলাম বুংকলুঙের দিকে। বুংকুলুং থেকে কুলেনবাড়ি যাব আমরা। আরেক ইকো পর্যটনে সমৃদ্ধ গ্রাম। আসলে এর আগেরবার কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রথমবার বুংকুলুং বেড়াতে গিয়ে ‘জঙ্গল ক্যাম্প’ এ নাইট স্টে করে পরদিন সক্কালবেলা লাগোয়া পাহাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সোনালি রোদ গায়ে মাখতে মাখতে ইকো পর্যটন গ্রাম হিসাবে কুলেনবাড়ির গল্প শুনেছিলাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০০০ ফুট ওপরে লিম্বু ট্রাইবদের গ্রাম বুংকুলুং এ সেবার আমরা পৌঁছেছিলাম দুপুর দেড়টা নাগাদ। আমাদের থাকার জন্য ব্যবস্থা করা ছিল জাঙ্গল ক্যাম্পে। দুটো পর্দা ঘেরা কটেজ। কিন্তু সেগুলোও সামান্য সিমেন্ট সামান্য কাঠ আর ভেতরে অনেকটাই শুধু পর্দা। মাঠে দুটো নর্মাল টেন্ট খাটানো। চারজন পার্টনার মিলে এই গ্রামের বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে তৈরি করেছেন ক্যাম্পের আদলে নাইট স্টে। আশপাশের বিভিন্ন স্কুলের ছেলেমেয়েদের এখানে নিয়ে আসা হয় প্রকৃতি চেনানোর জন্য। এই চারজন অশ্বিনী তামাং, কল্যাণ রাই, সত্যেন বরদেওয়া আর সঞ্জীব থাপা নিজেদের উদ্যোগে আয়োজন করেন এই ক্যাম্পগুলোর। ওঁরা নিজেরা থাকেন মিরিকে। বুকিং থাকলে এখানেই থাকেন। আমাদের সঙ্গেও থেকেছিলেন। ইকো পর্যটন নিয়ে লেখালেখি আমার প্যাশন বলে তখনই ঠিক করেছিলাম পরেরবার এলে বুংকুলুং এর সঙ্গে কুলেনবাড়িকেও যুক্ত করে নেব। 

সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের দুইদিনের এই উইক এন্ড সফর। মঞ্জু থেকে প্রায় ৬-৭ কিলোমিটারের কম নয় বুংকলুং। রাস্তার চরম দুরবস্থা। খানাখন্দ, পিচের ছালচামড়া উঠে গেছে। ক্রমাগত উৎরাই পথ বেয়ে পৌঁছে যাই সবুজ উপত্যকায়। মিরিক থেকে মাত্র ১৬ কিমি দূরে বাংলার সুন্দরী উপত্যকা বুংকুলুং। বুংকুলুং এর ব্যপ্তিটাই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। ছোট্ট ছোট্ট সাজানো রঙিন বাড়িঘর, সহজ সরল মানুষের সান্নিধ্য আর পাহাড়ের ঢাল এক লহমায় মনের মধ্যে স্থায়ী বসত গড়ে তোলে। পাহাড়ের কোলে বসানো বুংকুলুং গ্রামের চারপাশটা পায়ে পায়েই বেড়িয়ে নেওয়া যায়। বুংকুলুং থেকে কিছুটা উপরের দিকে চলে এলেই মহানন্দা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির কোলে ফেন্সিং দিয়ে ঘেরা বুংকুলুং জঙ্গল ক্যাম্প। কিন্তু এবারে আমাদের গন্তব্য বুংকলুং ইকো রিট্রিট। চা বাগান, জঙ্গল, দুই চারটে ঘরবাড়ি। শান্ত, নীরব, কোলাহলশূন্য ফুলে ফুলে ছবির মতো সাজানো গ্রাম বুংকুলুং। নিঝুম, নির্জন, অজানা, অল্পচেনা গ্রামের প্রতিটি বাঁকেই শুধুই বিস্ময়। গাছে গাছে পাখিদের কলতান। ময়ূর, গ্রে ট্রিপাই, ব্লু হুইসলিং থ্রাস, স্কারলেট মিনিভেট, গ্রিন ব্যাক টিট, স্কিমিটার ব্যবলার, কালেজ ফ্লেজেন্টদের সদর্প সমাবেশ। তবে পক্ষী নিরীক্ষণে ধৈর্য্য লাগবে। দুই মেয়েকে সাথী করে বুংকুলুং ইকো রিসর্ট চালাচ্ছেন পাহাড়ি এক কর্মঠ রমণী। অসাধারণ আতিথেয়তা সুস্বাদু লিকার চা এবং বিস্কুট দিয়ে। কোনরকমে লাগেজ রেখে চা খেয়েই চলে এলাম রিসর্টের পাশেই ইকো হাটের থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে এক লোহার ঝুলন্ত সেতুতে। এর তলদেশ দিয়ে বয়ে চলেছে বুংকুলুং ঝোরা যার স্থানীয় নাম মারমাখোলা। অদ্ভূত এক মায়াবী পরিবেশ। নদীর ধারে বেশ কসরত করে নেমে এলাম নিস্তব্ধ পরিবেশে মারমাখোলার বয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে। আহ হেভেনলি। ফটো সেশন সেরে লাঞ্চ ব্রেক। রাইশাক, ডাল, বেগুণী, ফুলকপির তরকারি, চিকেন খিদের মুখে যেন অমৃত। প্রায় প্রতিটি হোম স্টেতে খাবার মেনু মোটামুটি একই রকমের হয়। 

এতটা ভিতরে হলেও এই গ্রাম বেশ এগিয়ে শিক্ষায়। অধিকাংশ বাড়ি দারুণভাবে এস্থেটিক মেনে তৈরী। গ্রামের এক কোণে বুংকুলুং ইকো হাট। ফুলের রাজ্যে এই ইকো হাটে পাখিদের কলতান সারাটা দিন মনে দোলা দিয়ে যায়। চোখের সামনে এলবিজিয়ার ফুলে বি ইটারসদের নেক্টার নেওয়ার দৃশ্য সত্যিই অনবদ্য। ইকো হাটের পাশ দিয়ে সরু রাস্তা চলে গেছে গ্রাম হয়ে জঙ্গলে। মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই অদ্ভুত এক পৃথিবীর হাতছানি। পাখির চোখে উপত্যকার চিত্র ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হতে না হতেই চলে এল গাইড বীরু। সহজ সরল পাহাড়ি ছেলে। বীরুর সঙ্গে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম গ্যামন ব্রিজের দিকে। লোহার ব্রিজ পেরিয়ে চলে এলাম গয়াবাড়ি। রণপা পরা সুদীর্ঘ গাছের নীচে গয়াবাড়ি চা-বাগান। সবুজ মখমলি চা বাগানে গুনগুন গান গাইতে গাইতে শেষ বেলার টিপাই এর কাজ করছে গ্রামের মেয়ে-বউরা। চা-বাগান পেরোতেই বিশাল গ্যামন ব্রিজ। জঙ্গল ভীষণ নির্জন। পাখির ডাকে মুখর। রাস্তা মোটেও ভালো নয়। জঙ্গল পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম বালাসন নদীর কুলে। চা বাগান ধরে মিনিট তিরিশ হাঁটা দিলে বালাসন নদী। গ্যামন ব্রীজের উপর থেকে বালাসনের বয়ে যাওয়ার দৃশ্য ভোলার নয়৷ গাড়ি নিয়েও আসা যায়। তবে বুংকুলুং কিন্তু হেঁটে উপভোগ করার জায়গা। তাই গাড়ি নিয়ে সাইটসিং জাতীয় কিছু মনে না রাখাই শ্রেয়। সামনে নামসু গ্রাম। ডানদিকে আম্বোটিয়া চা বাগান। নামসুতে যেতে পড়ে মামরিং চা বাগান। তবে এই যাত্রায় আমরা যাই নি। অ্যাডভেঞ্চার-প্রেমীরা চলে আসতে পারেন নামসু। দু’পাশে গহীন অরণ্য, ঝোপঝাড় আর নীচে কুল কুল করে বয়ে চলা বালাসন নদীকে দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে সময় চলে গেল তা টের পেলাম না। গ্যামন সেতু তৈরি হবার ফলে কার্শিয়াং যাবার পথ আরো সুগম হয়েছে। কার্শিয়ং থেকে দুধিয়াতেও দ্রুত পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে। নামসু থেকে ফিরে আসি হোম স্টেতে। বুংকুলুং ইকো হাট এর ঘরগুলি বেশ পরিচ্ছন্ন। রান্নার স্বাদ অতুলনীয়। একেকটা ঘরে কমপক্ষে চার জন থাকা যায়। এতে খরচও কমে যায়। 

সকাল হল পাখির ডাকে। সকলেই ঘুমাচ্ছে। খুব ভোরে তাই একাই বের হলাম। যেদিকে তাকাই সবুজে যেন ডুবে আছে গ্রামখানা। এত নীরবতা কোথায় পাব? হালকা বৃষ্টি ভেজা ঘাস। ফুলের সুবাসে ভরপুর। বনজ গন্ধ। ডানদিকে হাঁসপোখরি গেস্ট হাউস। শব্দটি লেপচা ভাষার থেকে এসেছে যার অর্থ পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া পাথর। আমি তো ভাবছিলাম হাঁস আর পুকুরের সহাবস্থানে কিছু হবে বোধহয়। গ্রামটিতে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, ধান, মকাই সবই হয়। ফুলের জলসায় গ্রামটি উজ্জ্বল। জারবেরা, এন্থুরিয়াম, গ্লাডিওলাস, অর্কিড, বুনো ফার্ম। নানা রকমের গোলাপ, হলুদ, কলকে ফুল। পাহাড়িয়ারা পুষ্পপ্রেমিক। ঘরের বাইরে, বারান্দায়, রেলিঙে যেখানে সেখানে ফুল ফুটে থাকুক না কেন, কেউ ফুল ছেড়ে না, চুরি করে না। দেখলাম কমলা বাগান। সাথেসাথে দেখলাম বুংকুলুং ইকো গ্রামের ট্রাউট মাছ চাষের প্রকল্প। এখানে একটা এক্সক্লুসিভ চা ফ্যাক্টরি দেখার সৌভাগ্য হল। ইয়াংকি টি’। মালকিনের নাম ‘ইয়াংক রাই’, তাঁর নামেই ফ্যাক্টরির নাম। ১৫০ জন কৃষক। তাদের নিজস্ব জমি থেকে চা পাতা তুলে নিয়ে আসে এই ফ্যাক্টরিতে। এঁরা স্বামী-স্ত্রী দু'জনে মিলে, সঙ্গে শুধু ছ'টা ছেলে আছে লেবার হিসেবে, গড়পড়তা ৪০০ থেকে ৫০০ কেজি চা তৈরি করেন। আমাদের চা খাওয়ালেন। সেই চা নিয়ে এলাম খানিকটা। অপূর্ব গন্ধ তার। ইয়াংকুর হাসব্যান্ড ফুবি রাই এর আর এক শখ দেখে তো আমরা থ। কাঠ কেটে কেটে কী দারুণ যে সব জন্তু-জানোয়ার বানিয়েছেন। বিকেলবেলা ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেলে এই তাঁর বিনোদন। আদপে বংকুলুং একটা ঝুলন্ত উপত্যকা। শিলিগুড়ি থেকে ৩১ কিমি, কার্শিয়াং থেকে ২০ কিমি আর মিরিক থেকে ১১ কিমি দূরত্বে। এই লুকনো গ্রাম পর্যটকদের ভিড়ে ক্লান্ত হয়নি এখনও। আজ আমরা যাব কুলেনবাড়ি। তাই তাড়াতাড়ি রিসর্টে ফিরতে হবে। অনতিদূরেই ছোট্ট দোকানগুলি থেকে আলুর চপ সহ বেশ কিছু উপাদেয় ভাজাভুজি খেলাম৷ তবে পাহাড়ি মহিলাদের হাতে তৈরি মোমোর স্বাদ লা জবাব।

একটু বেলা করে ব্রেকফার্স্ট সেরে সবাই গাড়ি নিয়ে কুলেনবাড়ি বের হলাম। আমরা যাব জঙ্গল ক্যাম্পে। সেখান থেকে আমাদের সঞ্জীব বা অশ্বিনী গাইড করে কুলেনবাড়ি নিয়ে যাবে। আমাদের গাড়ি জঙ্গল ক্যাম্পেই থাকবে ড্রাইভার সহ আমাদের আবার বুংকুলুং নিয়ে আসার জন্য। যাব ট্রেকিং পথে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আমরা সঞ্জীবের সঙ্গে বের হলাম কুলেনবাড়ির পথে। কারণ ট্রেকিং পথের ধকল সকলে সামলাতে পারবে না বলে অনেকে রয়ে গেছে বুংকুলুং। পর্যটনের প্রাণকেন্দ্র সবুজ ডুয়ার্সের গা ঘেঁষে হিমালয়ের কোলে কুলেনবাড়ির ভোটের মানচিত্রে অবশ্য কোনও অস্তিত্ব নেই। এই ‘অস্তিত্বহীন’ হ্যামলেটটির জীবন কাহিনী অবাস্তবতায় ভরা। মানুষ যখন ভোটের অধিকার পায় না তখন রাষ্ট্রের কাছে সে অস্তিত্বহীন। ফলে তাদের বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়া নিয়ে তার দেশ তথা তারই জন্মভূমির কোনও মাথাব্যথা নেই। আর সেইজন্যে গুগল ম্যাপে সার্চ করলেও কুলেনবাড়ির কোন অস্তিত্ব নেই। এই পথ আমাদের দেখা কোনও রাস্তার মত নয়। যাঁদের ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতা বা অভ্যেস আছে তারা বুঝবেন হয়ত কিছুটা। এই রাস্তা প্রকৃত অর্থে কোনও রাস্তাই নয়। ফলে যানবাহনের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। শুধুমাত্র পদযাত্রা। একমাত্র কার্শিয়াং থেকে নীচু পথে পায়ে হেঁটে চলতে থাকলে তিন ঘণ্টা পর পৌঁছনো যায় এই গ্রামে। যেখানে জঙ্গল ক্যাম্পটা করা হয়েছে সেখানে পাহাড়ের একটা অংশ ক্রমশ ধস নেমে নেমে গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে। আর দু'একবার ঘটলে গোটা গ্রামটাই পড়ে যাবে। গাছ লাগিয়ে লাগিয়ে ওই এলাকা বাঁচানোর এক বড়সড় প্রক্রিয়ায় হাত লাগিয়েছেন এঁরা। তাতে কয়েক বছর হল ধসের প্রকোপ অনেকটা কম। দেখলাম সেই সুন্দর ট্রেক রুটটা নেমে গেছে বালাসন নদীর তীরে। দু’পাশে ঘন জঙ্গলে শুধু গাছ আর নীচে নদী ফুঁসছে গর্জন করে। 

বর্ষা যখন উত্তাল হয় তখন এই কুলেনবাড়ি বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি দ্বীপে পরিণত হয়ে যায় যার খবর আমরা কেউ রাখি না। মোটামুটি সত্তর জন মানুষ সহ ঊনিশটা পরিবার বুড়ো, বাচ্চা মহিলাসহ একলা হয়ে যায় গোটা পৃথিবী থেকে। তাদের নিয়ে মাথা ঘামায় না কেউই। যদিও কুলেনবাড়ি থেকে অনেকটা গেলে বালাসন নদীর ওপর একটা ব্রিজ দুধিয়ার সঙ্গে জুড়ে রেখেছে কুলেনবাড়িকে। কিন্তু বর্ষার সময় ওই একটি মাত্র ব্রিজ তলিয়ে যায় বালাসনের অনেক নীচে। সারা বছরের খাওয়া পরার জন্য ওই ব্রিজটার ওপর দিয়ে অনেকটা দূরের দুধে’ অর্থাৎ দুধিয়া ওদের বেঁচে থাকার একমাত্র রসদের জোগানদার। বর্ষায় সেটুকুও মুছে যায়। সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে বসে থাকতে হয় প্রায় চারটে মাস। এদের না আছে কোনও ভোটার কার্ড, না আছে কোনও আধার কার্ড, অর্থাৎ অস্তিত্বহীন। তাই ভোট উৎসবও হয় না এখানে। সত্তরটা মানুষের মধ্যে হয়ত গোটা পঞ্চাশ-ষাটজন ভোট দেবার মত। তাদের জন্য আবার বুথ? পড়ে থাক এভাবেই। যা খুশি হোক গে। নিজেরা বাঁচলে বাঁচুক, মরলে মরুক। ঊনিশটা পরিবার তো মাত্র। কুলেনবাড়ির শিশুরা ফুল হয়ে ফুটুক আর নাই ফুটুক, তাদের দেশে সবসময়ই বসন্ত। সবচেয়ে কাছের প্রাইমারি স্কুল কার্শিয়াংয়ের কেরাবাড়ি পায়ে হাঁটা তিন ঘণ্টার পথ। ছোট ছোট শিশুরা তাই পড়াশুনো শেখার সুযোগ পায় না। দুধিয়া বর্ষাকালে বছরে প্রায় মাস চারেক বন্ধই হয়ে যায়। তাই আট-দশ বছর বয়সে কুলেনবাড়ির আবার যখন শিশুরা যখন একলা হেঁটে চলার উপযুক্ত হয় তখন বাপমায়ের কেউ কেউ কার্শিয়াংয়ে পাঠায়। ক্লাস ওয়ানে ভরতি হয় ওই বয়সেই। কিন্তু বেশিরভাগের পক্ষেই বেশিদিন টানা সম্ভব হয় না। কারণ আদপে যাওয়া আসাটাই হয়, পড়াশুনো হয় না। তিন ঘণ্টা যাওয়া আবার তিন ঘণ্টা ফেরা। 

বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে দরবার  করায় নাকি ওখানে একটা প্রাইমারি স্কুল করে দেওয়া হয়েছিল এবং সেখানে একজন শিক্ষকও নাকি নিয়োগ করা হয়েছিল। তিন তিন ছ'ঘণ্টা পায়ে হেঁটে এসে শিক্ষার ফুল ফোটানোর দায়িত্বে সেই শিক্ষক অচিরেই নমস্কার জানিয়েছেন। অসুস্থ হলে কোনও চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। অসুখ যদি নিজে সারে তো ভাল, না সারলে কোনও যানবাহন নেই যা করে রোগীকে অন্তত দুধিয়া পর্যন্ত আনা যায়। কেউ যে এইসব এলাকার দিকে তাকিয়েও দেখে না খুব স্পষ্টভাবে তা বোধগম্য হয়। পাহাড় নিয়ে রাজনীতি রাজনীতি খেলা দেখলে এদের জন্য বড় কষ্ট হয়। ফিরে এলাম জঙ্গল ক্যাম্পে। কিছুক্ষণ থাকতে হল জঙ্গল ক্যাম্পে। কারণ চা না খাইয়ে কিছুতেই চাড়বে না। কাছেই আছে লিম্বুদের প্রার্থনাস্থল। গেলাম সেখানে। সামনে বিরাট মাঠ। ওখানে এখন পুজোআচ্চা অনেকটাই কমে গেছে। পুরোহিতরা আর বংশপরম্পরায় এই কাজ করছেন না। নতুন প্রজন্ম লেখাপড়া করে অন্যান্য চাকরি খুঁজে নিচ্ছে। তবু বয়স্ক যিনি আছেন তিনি এখনও আসেন। সকাল-সন্ধে প্রদীপ জ্বালান হয়। সারাদিন কিভাবে কেটে গেল বুঝতে পারলাম না। পরদিন সকালে সি অফ-এর সময়টা খুব মন খারাপ হয়ে গেল। ওরা এমনভাবে আগলে রাখলেন এই পুরো সময়টা যে মনে হল অনেক দিনের বন্ধুত্বের বিচ্ছেদ হচ্ছে।
শিলিগুড়ি থেকে চলে মিরিকগামী রাস্তার ১০ নং ফাটক। সেখান থেকে বুংকুলুং-এর দূরত্ব ১০ কিমি। এনজেপি থেকে বুংকুলুং ৫০ কিমি। গাড়িভাড়া ২২০০-২৫০০ টাকা। এখানে অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য রয়েছে সুন্দর টেন্ট। ছোট, মাঝারি, বড় টেন্ট। ভাড়া ৪ জনের ২৫০০ টাকা, ২ জনের টেন্ট ৮০০ টাকা। খাওয়া জনপ্রতি ৬৫০ টাকা। বুংকুলুং গ্রামে রয়েছে বুংকুলুং জঙ্গল ক্যাম্প (৯০৬৪৮১৭৮১২ / ৯৮৩২০৩৬০৫৩) ভাড়া ১৭০০ টাকা জনপ্রতি। থাকাখাওয়া সমেত। বংকুলুং-এ জাঙ্গল ক্যাম্পে থাকতে হলে কল্যাণ রাই (৯৭৪৯০৫৯৬৮১) কিংবা ওশান লেপচার (৯৯৩২৩৮৫৪৯৪) সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। 

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri