সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
12-January,2025 - Sunday ✍️ By- সোমনাথ দত্ত 67

সোমনাথ দত্ত-র আলোচনায় মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য-র বই 'গভীর রাতে দিঘির ধারে'

সোমনাথ দত্ত-র আলোচনায় মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য-র বই 'গভীর রাতে দিঘির ধারে'

 শ্রীপান্থ'র পান্থশালা থেকে মিসেস হোয়াই আর মিস্টার বিকজ এসে বসেছেন। গোলটেবিলের তৃতীয় সদস্য মিস্টার হোয়াট। আজকের আলোচ্য, বাংলা পাঠকের হাল হকিকত। কাঁটা চামচে এক টুকরো ফিশফ্রাই বিলিতি কায়দায় মুখে পুরতে পুরতে হোয়াট সাহেব বললেন, "কী ভালোবাসছে ছেলে ছোকরারা পড়তে আজকাল?" উত্তর তৈরিই থাকে মি. বিকজের ঠোঁটে- "দেখুন মশায়, প্রেমের জয় চিরকালীন ছিল। সেই ভিক্টোরিয়ান আমলেরও আগে থেকে দেখে আসছি। তবে ইদানিং হাওয়া পাল্টাচ্ছে। পশ্চিমী কায়দায় এখানেও থ্রিলার আর অকাল্টের রমরমা..."। কথা মাঝপথেই রয়ে গেল। মিসেস হোয়াই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বাধা দিলেন, "না হে, এভাবে বললেই তো হল না। থ্রিলারের জনপ্রিয়তা সেদিনও ছিল। আর ভূতেদের উপদ্রবের কথা বাদই দিলুম না হয়। মোদ্দা কথা সমস্ত ঘরানারই একগুচ্ছ করে পাঠক ছিল। একা পশ্চিমের দোহাই দিলে তো হল না।

 মি. হোয়াট বেশ মজা পাচ্ছিলেন এতক্ষণ। সকৌতুকে চাইলেন বিকজ সাহেবের দিকে। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবলেন মিঃ বিকজ। গ্লাস থেকে সামান্য জল গিলে নিয়ে, একটু গলা ঝাড়লেন। 
" না, ইয়ে মানে, অকাল্টের বাজার যে রীতিমতো সরগরম, তা তো মানতে হবে। যা বেরুচ্ছে তাই হটকেক, নবীন প্রবীণ সব পাঠকই গিলছে গোগ্রাসে। তবে কারণ বলতে ম্যাডাম, আসলে এ সময়টা তো অনেক বেশি দর্শকের। নিষ্ঠাবান পাঠক আর সেরকম কোথায়। তাই সিনেমা সিরিজে যে কন্টেন্ট তারা দেখতে ভালোবাসে, বই পড়তে গিয়েও সেরকমই খুঁজছে। সোজা কথায়, সময় সবার খুব কম। সবার চাই অ্যাড্রিনাল রাশ!..." 

"তার মানে তুমি বলতে চাইছ, বাঙালির থ্রিলার, অ্যাকশানের চেয়েও ভৌতিক কন্টেন্ট দেখতে ভালোবাসে?" মিস্টার হোয়াটের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে বিদ্রূপ। মিসেস বিকজ মুখ দিয়ে কেমনতর শব্দ করে বললেন "বোগাস! আচ্ছা ওসব ছাড়ো। বল এত হটকেক যে বেরুচ্ছে, তা পড়ে কেমন লাগছে তোমার?"

সত্যি বলতে বিকজ সাহেব পড়েননি খুব বেশি। যা শোনেন এদিক সেদিক থেকেই। তবুও যতটা গুছিয়ে বলা যায়- 
"সত্যি বলতে ম্যা'ম, এই অকাল্ট সাহিত্য দু'ভাগের। এক তো পুরোনো ক্ল্যাসিক আর অনুবাদ সাহিত্য। যার প্রায় পুরোটাই আমাদের গথিক ভিক্টোরিয়ান ঘরানার। 

কিন্তু আজকাল যা জনপ্রিয়, তার অনেকটার মূলে আসলে এখানকার লৌকিক ভূতের গল্প। তাতে তন্ত্র, লোকাচারসহ আরও বহু মালমশলা যুক্ত হয়েছে পরিমাণমতো। সত্যি বলতে হাড় হিম করা ভয় দেখানোই যে তাদের প্রধান উদ্দেশ্য, তা পড়লেই বোঝা যায়। ভূত, প্রেতের বিচিত্র কারবার তাতে। আবার তন্ত্র, লোকাচার সব কিছুর নির্যাস মিশিয়ে ভয়াবহ আবহ তৈরি করা। বাস্তবের সাথে সম্পর্ক রাখতে এরা বদ্ধপরিকর নয়। অনেকটা মুখরোচক খাবারের মতোই। তাই প্রথম পাঠে উপভোগ্য মনে হয় খুব। কিন্তু সাহিত্যের মানে বা গুণে  বারবার পড়ার মতো কিনা জিজ্ঞেস করলে...." 

বিকজ সাহেব যাই বোঝান না কেন মিসেস হোয়াই বা মি. হোয়াট কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারেন না। দু'জনের মুখব্যাদান দেখে যা মনে হল, এ তর্কাতর্কি আজকের মতো শেষ হবার নয়।

তাই পেছনের টেবিল থেকে উঠে চলে এলাম। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। সোজা ঘরের বুকশেলফের সামনে দাঁড়িয়ে। ভাবতে ভাবতে বের করেই ফেললাম বইটা। মি. বিকজের যুক্তির হ্যাংওভার নাকি ঝকঝকে সুন্দর প্রচ্ছদ, কোনটা বেশি টানল বলা মুশকিল।

গত কয়েক বছরের বাংলা সাহিত্যে লেখক সুপরিচিত নাম। বিশেষত ছোটোগল্পে তাঁর মুনশিয়ানা সুবিদিত। চিরপরিচিত সমাজ, প্রকৃতি, মধ্যবিত্ত মানবজীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি তাঁর কলমে হয়ে ওঠে জীবন্ত। সম্পর্ক, পেশা, স্বপ্ন, আত্মমর্যাদার টানাপোড়েন সাধারণ জীবনকেও কতটা বিচিত্র করে তোলে, তার স্নিগ্ধ আখ্যান তাঁর লেখায় উঠে আসে বারবার। একটু আগেও তাঁরই 'চংক্রমণ' রাখা ছিল রিডিং টেবিলে, ঠিক 'মায়াকাজল' গল্পের পাতায় বুকমার্ক। 

মাঝপথে এই বই ধরতে হল। ব্লার্ব বারবার বলছে, 'গা ছমছমে' গল্প, 'হাড় হিম' করা উপন্যাস। তাহলে কি লেখক ভেঙে বেরোলেন তাঁর চেনা গৎ? প্রচ্ছদেও তো তেমন ইঙ্গিত পাচ্ছি। এবার কি তাহলে নেহাৎ আনন্দের খাতিরেই ভয়কে প্রশ্রয় দেওয়া? ভালোই তো, মন্দ কি? 

তবে একটু মন কেমনও করছিল না কি? সেই আবেগী, দরদমাখা লেখনী যদি মিস করি? যদি মিস করি বিশ্বাস, ভয়ের উর্ধ্বে উঠে বিশাখবাবুর মতো সাহস, বাস্তববোধ? (নক্ষত্র রাতের বন্দিশ, চংক্রমণ) 

এত ভাবনার দোলাচলে খুলে বসা হল প্রথম গল্প 'হাড়গিলা'র পাতা। যত এগোচ্ছিলাম, টের পাচ্ছিলাম, সেই লেখনশৈলীর সাথে লেখক সমঝোতা করেননি বিন্দুমাত্র, বরং তা ক্ষুরধার হয়েছে আরো। গল্প তাই এগিয়ে চলে স্বচ্ছন্দে, তিরতিরে একমুখী জলস্রোতের মতো। পাঠক হিসেবে এটাই তো প্রত্যাশিত।

তাই গল্পে জোর করে ভূত বা আপাত ভৌতিক উপাদানের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয় না শুরু থেকেই। বরং তারা আসে তাদের নিজস্ব ছন্দে, সহজাত প্রক্রিয়ায়, কাহিনির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েই। তাই পাঠককে শিরশিরে ভয়ের অনুভূতি না দিয়েও প্রথম গল্পই মনে জায়গা করে নেয় তার বিশেষত্বে, বিষয়বস্তুর অনন্যতায়। এই গল্প যতটা ভৌতিক তার চেয়েও বেশি জীবনবোধের। 

গল্পের শেষে এসে তাই বোঝা যায়, লেখক যুক্তিমনস্ক পাঠককে হেয় করেননি বিন্দুমাত্র। বরং তারও নিজের মতো করে ভাববার অবকাশ রেখেছেন। 

পরের গল্প 'মেমপিসি' ভয়ের আবহ তৈরি করে আরেকটু আগে থেকে। অভিনবত্বে নতুন না হলেও, ভাবনার জায়গা এখানেও রাখা হয়েছে, খুব সন্তর্পণে। তবে এ গল্পও নেহাত ভৌতিক নয়; প্রতিশোধের। ভালো মন্দ বিচার করার দায়ভার ছোটোগল্পে বরাবরই পাঠকের হাতে তুলে দেন লেখক। সে হিসেবে প্রত্যেকটা ছোটোগল্পই এখানে ভীষণ সার্থক। 

ভৌতিক আবহ বা ভয় একা সাহিত্যকে সম্পূর্ণ করতে পারে না। তাই বারোটা ছোটোগল্পের প্রায় কোনোটাতেই ভয় মুখ্য নয়। উপজীব্য হয়ে উঠেছে মানব চরিত্র, বহুবিধ আবেগ, মানব অনুভূতি। 

ঠিক যেমন মিসেস জাংব্লুথ অপত্য স্নেহে রাতে নিজের মধ্যে খুঁজে পান হারিয়ে যাওয়া পুত্র'কে (স্লেট); আবার কখনো কিবো তার ঠাকুরদা'র মুক্তির আশায় ফিরে আসে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত পাহাড়ি গ্রামে (প্রিমুলা); আর প্রকাশ স্ত্রী ভিক্টোরিয়াকে মৃত্যু পরবর্তী জীবনেও কল্পনা করে পরির বেশে, সে কি নিছকই কল্পনা? (আলোর পরি)

এক ডজন গল্পের প্রত্যেকটাই বিষয়গুণে উপভোগ্য। আবার 'রাজার অতিথি', 'রেনক্লাউডের কালো বাদুড়' এর মতো গল্পে ক্লাইম্যাক্স চমৎকৃত করে ভীষণ। 

ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে তিন বান্ধবী তৃণা, তন্বী আর তিতিরের অভিযান, বিচিত্র অভিজ্ঞতা। শেষ তিন গল্প 'গুমো', 'টংটঙ্গি', 'ভারাসোর ডায়রি'র প্রত্যেকটাই মনে রাখার মতো হয়েছে। বিশেষ করে শেষ গল্পে ইতিহাসের উপাদান এত সুন্দর করে এসে মিশেছে, যা সত্যিই অভিনব। পড়তে গিয়ে কোথাও ক্লান্তিবোধ আসে না।

 বইয়ের একমাত্র উপন্যাসের নামেই বইয়ের নামকরণ। তবে একে উপন্যাস বা উপন্যাসিকা বলাটা কতটা যুক্তিযুক্ত জানা নেই। একটিমাত্র প্রেক্ষাপট, সরলরৈখিক গল্প বলার ধরন, সীমিত কয়েকটা চরিত্র আর মূলত দু'জনের কথোপকথনের ওপরেই দাঁড়িয়ে এই উপন্যাস। আকারে বড় হলেও প্রকারে আর শৈলীতে একে একটা ছোটোগল্পের সাথেই তুলনা করা যায়। প্রায় এক সিটিংয়ে পড়ে ফেলার মতো এই গল্পের ভাবনা বেশ অভিনব। কাহিনির প্রায় শেষভাগে এসে একটা শিরশিরে ভয়ের অনুভূতি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক। পৌরাণিক চরিত্রের বা লৌকিক বিশ্বাসের অবতারণাও করেছেন সামান্য। যদিও তাকে দীর্ঘায়িত করেননি। ছোটোগল্পের মতোই তার আবেগ আর অনুভূতির প্রতি ঝোঁকটাই প্রাধান্য পেয়েছে এখানে। শেষভাগে এসে মনে হয়, হয়তো কাহিনীতে কিছু লজিক্যাল ফ্যালাসি ছিল। অথবা কিছু ঘটনা পাঠকের পক্ষে মেনে নেওয়া সহজ নয়। সেসব সত্ত্বেও এই উপন্যাস ভাষাগুণে বেশ সুপাঠ্য, সহজে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এক ডজন ছোটোগল্পের অধিকাংশই এর থেকে খানিকটা এগিয়ে থাকে, বিষয়বস্তুর গুণে। 

সব মিলিয়ে 'গভীর রাতে দিঘির ধারে' পড়ার পরে আরেকবার ঢুঁ মারতে ইচ্ছে হল গোলটেবিলের রেস্তোরাঁয়। ভাবলাম একবার গুঁজে দিয়ে আসি বিকজ সাহেবের হাতে। কিন্তু ততক্ষণে তেনারা উঠে চলে গেছেন। তবে যারা মি. বিকজের দলে তাদের জন্যে এই বইয়ের খোঁজটুকু থাকল না হয়। ধারণা কিছুটা হলেও পাল্টে যেতে পারে কিন্তু। 

আর লেখকের প্রতি আবদার (অনুরোধ নয়), তৃণা, তন্বী, তিতির সিরিজের আরো অভিনব সব গল্প চাই। সব মিলিয়ে সিরিজটা ভীষণ টানছে।

বইয়ের প্রচ্ছদের কথা নতুন করে বলার নেই। বাঁধাই, পৃষ্ঠা আর সম্পাদনা যথোপযুক্ত। 

মোদ্দা কথা, হরর পড়তে ভালোবাসুন আর নাই বাসুন, সাহিত্যগুণে স্বমহিমায় ভালোবাসতে বাধ্য করবে এই বই। ছোটো বড় নির্বিশেষে তাই সবার জন্যে অবশ্যপাঠ্য। একবার নয়, বারবার। 

বই: গভীর রাতে দিঘির ধারে
লেখক: মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য 
প্রকাশক: Patra Bharati 
মুদ্রিত মূল্য : ৩৯৯ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২৫৬

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri