সেসব শীত গেল কোথায়/গৌতম চক্রবর্তী
সেসব শীত গেল কোথায়
গৌতম চক্রবর্তী
পৃথিবীর পাক খাওয়া নিয়মে প্রতি পৌষ-মাঘে শীত ফিরে ফিরে আসে। আসলে শীত মানে তো শুধু উত্তাপ কমে যাওয়া নয়, বরং শীত এলে আমাদের আনন্দের উত্তাপটা যেন অনেকটাই বেড়ে যায়। কারণ শীত তার ঝুলিতে উপহার নিয়ে আসে অনেক কিছুই। কিন্তু সেই শীত আর আসে কই? শীত বদলে গিয়েছে, নাকি সময়ের সঙ্গে আমিই বদলে যাচ্ছি? বদলে যাচ্ছে আমাদের বোধ! বদলে যাচ্ছে আমাদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা। বদলে যাচ্ছে আমাদের জীবনশৈলী। হয়তো। ফলে অতীতের স্মৃতি রোমন্থনে আমরা হয়ে পড়ছি নস্টালজিক। শীতকালে সন্ধ্যের পর কাঠকুটো বা পাতায় লাগানো আগুন গোল করে ঘিরেই আড্ডা জমে উঠত। সেই আড্ডায় উঠে আসত সেইদিনের শীতের তাপমাত্রা থেকে শুরু করে সিনেমা, রাজনীতি, রাজ্য, দেশ ছাড়িয়ে সময়ে সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের খবরাখবর। আধো অন্ধকারে শীতকে ঘিরে থাকা অনেকগুলো মুখ মানেই অনেক দৃষ্টিভঙ্গি, অনেক আদর্শ, অনেক স্বপ্নচারণ, অনেক আশাভঙ্গের গল্পগাথা। তাকে ঘিরে না থাকত কোন উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ, না থাকত বয়সের তারতম্য। শীতের আগুণ থাকা মানেই সকলের অবাধ যোগদান। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই জটলা আজ প্রায় চোখেই পড়ে না। যৌথ পরিবার ভেঙে, ফ্ল্যাটবাড়ি কালচারে আজকের শৈশব অনেকটাই সেই প্রবীণদের সান্নিধ্য হারিয়েছে। হ্যারি পটারের যুগে এসে হারিয়ে গেছে পরী ও দৈত্যেরাও। এখন একলা রাতে নরম কম্বলের ওমে শীতের সেই চেনা গন্ধ আসে কই?
ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে দিয়ে আগুন জ্বালানোর জন্য আমাদের ছোটবেলায় আসতো শীতকাল। আর তখন থেকেই তোড়জোড় শুরু হত শীতকালকে আমন্ত্রণের। সেই তখনকার শীতকালে ত্বকের যত্ন নেওয়া দিনে গ্লিসারিন সাবানের গন্ধে আমাদের বেঁচে থাকার গল্পগুলো আজ রূপকথা। স্নান করতে যাওয়ার আগে নারকেল তেল গলিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা রোদের কাছে, উনুনের পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। প্রতিবার ভাবতাম পুজোর আগে কুল খাবো না। কিন্তু শেষ রক্ষা হত না কিছুতেই। ইট দিয়ে কুল পাড়ার মজা ছাড়া যায়? যায় না বলেই পকেটে পকেটে ভর্তি থাকতো কাঁচা পাকা কুল। আচারের শিশির গায়ে রোদ পড়তো আর আমরা ছোটরা, খুড়তুতো, জেঠতুতোরা লোলুপ চোখে তাকিয়ে থাকতাম। আর ঠিক এই সময় ধীরে ধীরে বসন্ত পঞ্চমী' নামটি বুঝিয়ে দিত রং লেগেছে বনে বনে, ঢেউ জেগেছে সমীরণে। একদিকে সার্কাসের ট্র্যাপিজের খেলা দেখতে দেখতে মনে হতো জীবনের আসল রং খুব সম্ভবত অ্যাডভেঞ্চার, আবার স্কুল থেকে সরস্বতী পুজোর স্বেচ্ছাসেবক হবার প্রতিযোগিতাও ছিল জীবনের আর এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চার। মেয়েদের স্কুলে কে কে কার্ড দিতে যাবে এই নিয়ে কত রঙ্গরস! কাঁধে ব্যাগ, চুল উড়ছে, হিরো সাইকেলে চড়ে হাতল ছেড়ে হিরো হওয়ার বাসনাতে যেন দিগবিজয় করে ফিরতাম। গার্লস স্কুল থেকেও কেউ কেউ আসত মাঝে মাঝে। বুকের ভেতর কেমন একটা হত যা খালি চোখে দেখা যেত না। একটু উঁকিঝুঁকি, সামান্য চোখাচোখি। ঘুরে ফিরে তাকানোর পঞ্চমী প্রহর। নতুন শাড়ি সামলে নেওয়ার বয়ঃসন্ধি। আসলে প্রত্যেকের জীবনেই কিছু 'অকথা' থাকে। বন্ধুরা সে কথা জানবেই। স্কুলের পুজোর দ্বাদশ শ্রেণী। সারস্বত উৎসব। পরিবেশনের দায়িত্ব। সে আসে ঠিক। নিজের হাতে খেতে দিই। স্যার বলেন দেখে দিবি কিন্তু। হ্যাঁ দিই তো। প্রসাদের সঙ্গে সন্দেশ দিই। হাতে একটু ছোঁয়া লাগে। এক পলকে দুজনের দেখা। সে সময়কাল শীতকাল।
অশোকবাবুর কাছে পড়তে যাওয়ার সময় যখন সাইকেলের বেল বাজাতাম তখন সোহারই মোড়ের সেই সাদামাটা মেয়েটা, যার নাম ছিল বীণা, কেন যে ভালো লাগত আমিও জানি না, চোখের সামনে ঝুঁকে থাকা অবাধ্য চুল কানের পাশে তুলে রাখত। সে জেনে যেত এবং বুঝে নিত বেল বাজিয়ে যে আসছে পেছনে না তাকালেও দেখা যায় সেই আসা। আচ্ছা সাইকেলের বেলেরও কি মোবাইলের মত ভিন্নধর্মী রিংটোন ছিল নাকি? কোনদিন শাড়ি পড়তো, আবার কোনদিন সালোয়ার কামিজ। আমার এক বন্ধুর কাছে যখন বলেছিলাম শাড়ি পড়লে মেয়েদের বড় বড় লাগে তখন ‘প্রেমিকার বুকের সেফটিপিন' কবিতা লিখে ফেলে সেই কবি বন্ধু সাহিত্য মহলে জবরদস্ত মুরগী। শাড়ি আসলে খুবই সংক্রামক। আসলে আমাদের অনেকের জীবনের ভালোবাসার বর্ণমালার প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল এইসব শীত বিকেলে। আমরা মফস্বলের মাঠ জুড়ে স্বপ্ন ফেরি করতাম। হাফ সেঞ্চুরি অতিক্রম করা এই বয়সে ডাকাবুকো প্রেমিকের দলকে কেউ মনে রাখে কিনা এইকথা ভাবতে ভাবতেই ছোটবেলার মুগ্ধতা ভিড় করে আসে চোখের পাতায়। বাণী বন্দনার শীতসকালে অঞ্জলি দিতে গিয়ে হৃদয়ে অবাধ্য ছেলে কার মুখ ভেবেছিল মন কি তা জানে? মনের গতিবিধি বোঝা দায় যে। কত কবি বন্ধু ছিল সেইসময় আমার ক্লাশে তা কি জানতাম? কার মধ্যে কি সুপ্ত প্রতিভা আছে কি করে জানবো? বঙ্কিমচন্দ্রের বাবু পড়াবার সময় নির্মলবাবু মজা করে মদনকে বলেছিলেন ‘বলতো মদন, ‘মদন আগুণ কি’? মদন অবলীলাক্রমে বলেছিল ‘মদন আগুণ’ হল এমন আগুণ যা বালতি বালতি জল ঢাললেও নেভে না’। সেই মদন বাসন্তীকে চিঠি লিখল ‘পলাশ ও শিমূল পাশাপাশি / আঙ্গুলে শাড়ির খুট, লজ্জা…… ভালোবাসাবাসি’। এটা নিয়ে কয়েকদিন বন্ধুমহলের জমজমাট আলোচনা ক্রমে ক্রমে জমে ক্ষীর। মদন-বাসন্তীর এখন এক ছেলে এক মেয়ে।
এটা অস্বীকার করা যাবে না আমবাঙালির কাছে শীত বরাবরই এক ‘সুস্বাদু’ মরশুম। আমার ছোটবেলাতে দেখতাম তরতাজা সব্জিভরা বাজারে ঢুকলে বাবার খরচের হাতটা যেন বাগে আসতে চাইত না। আসলে এখন হাফ সেঞ্চুরি অতিক্রম করে নিজের মধ্যে বাবাকে খুঁজি আর বুঝি এই মরশুমে কেনার ক্ষমতা লাগাম ছাড়া হতেই হবে, কেন না শীত এসেছে যে। ফুলকপি কেনার পরে কই মাছ দেখলে গোটা গোটা বড়িসহ ফুলকপি আর আলু দিয়ে কইমাছের ঝোলের কথা ভেবে ঢোক গেলে না এমন নির্লিপ্ত আসক্তিহীন বাঙালি আছে কি ইহজগতে? কিংবা সেই ছোট্টবেলাতে আমার মায়ের বা এই পড়ন্ত সময়কালে আমার শাশুড়ি বা গিন্নীর (উল্লেখ করতে হল, নইলে লেখাটা পড়ানো যাবে না। আর আমার মধ্যে আমি? আর থাকব না হয়তো। তাই সাধু সাবধান!) মুলো, বেগুন, আলু, ধনেপাতা দিয়ে মৌরলার চচ্চড়ি যে প্রাণিত বাঙালি খায়নি তার তো বাঙালি জন্মই বৃথা। আবার কালজিরে ও পেঁয়াজ কুচি ফোড়ন দিয়ে ডুমো ডুমো করে কাটা চিকন বেগুন সহযোগে পাবদার ঝোল, নতুবা টাটকা সতেজ পিয়াজকলি দিয়ে ছোট চিংড়ির প্রিপারেশন খেয়ে কত ভিনজাতি পুরুষ যে বাঙালি শ্বশুরবাড়ি পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়েছে, হিসেব নেই। মাছেভাতে বাঙালি অনায়াসে দিনকতক মাছ ভুলে থাকতে পারে। কিন্তু সেও তো হওয়ার নয়। শীতকালের মাছ বাজার রুপোলি শস্যে ভরা। সুন্দরী মৌরলা, আদুরে কাজলি, লাবণ্যময়ী পাবদা, রূপসী বোরোলি, বিদুষী সরপুঁটি, দাপুটে কই, হ্যান্ডসাম কাতলা। সে আমার শৈশব থেকে আমার যৌবনকাল পর্যন্ত একই চিত্র। আর তাই বয়েলখানা বাজারে আমার মধ্যে আমিকে এখনও খুঁজে পাই।
শৈশবে লেড়ো বা খাস্তা বিস্কুট খেতে খেতে যখন বাবার হাত ধরে বাজারে যেতাম তখন দেখতাম শীত এলে ব্যাগে ঝলমল করত রূপসী ফুলকপি, চিরসবুজ তন্বী পেঁয়াজকলি, বার্মিজ রুবির মত গাঢ় লাল চকচকে অপরূপা টমেটো, ঝিনুক থেকে বের করা সবুজ মুক্তোর মতো মটরশুটি, সপ্তমীর চাঁদের মতো বাঁকা কচি সিম, ব্ল্যাকবিউটি বেগুন, লজ্জায় গোলাপী ফরসা নধর মুলো, পাটভাঙা তসরের মতো সজীব পালং, পরতে পরতে রহস্যময়ী বাঁধাকপি। কাকে ছেড়ে কার কথা বলি? আসলে বাঙালির কাছে আমিষ নিরামিষে তফাৎ যে খুব কম এই ঋতু সেটাই প্রমাণ করে দেয়। কিন্তু না, আধুনিক কৃষিব্যবস্থা ফসল ফলাতে এখন আর শীতের তোয়াক্কা করে না। শীতের নিজস্ব ফসল ফলছে সারা বছর, শীতের ফুলকপি এখন সারা বছর ধরে খাচ্ছি আমরা। সেই স্বাদ আর নেই। তাই খেতে বসে অতীত আর আজকের শীত ভিন্নতা লাভ করে আমাদের হৃদয়কে আরো ব্যথাতুর করে সুদূর অতীতে ফিরিয়ে দেয়। তবুও রবিবার কিন্তু বাজার ফেরতা ঠাসা ব্যাগে উঁকি দিয়ে আহ্লাদিত গিন্নি ফুলকো লুচি আর আলুর দমের সঙ্গে ঘন মালাইদার দুধে কফি নয়ত আদা দিয়ে কড়া ফ্লেভারের চা বানিয়ে আনে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴