সেই সব বুদবুদ/মধুমিতা দে রায়
সেই সব বুদবুদ
মধুমিতা দে রায়
উচ্চমাধ্যমিক বলে কথা, রাত জেগে ভূগোলের প্র্যাকটিকাল খাতা তৈরী করে চোখের দফারফা। টোপোশিট যে বড় সূক্ষ্ম কাজ। কিন্তু তাতে কী? ভালো নম্বর পেতে হলে খাতা হতে হবে নিখুঁত, তখনই হবে সকল পরিশ্রম সার্থক।
তবে এদিক ওদিক কান পাতলে শোনা যায় ওঁনার কাছে প্রাইভেট টিউশন না পড়লে নম্বর কম পেতে হবে। ওঁনার হাতেই যে নম্বর দেবার মালিকানা। হ্যাঁ, উনি আমার স্কুলেরই বিষয় শিক্ষিকা। কিন্তু সমস্ত খাতা সঠিক ভাবে তৈরী করলেও কি উনি তেমনটা করবেন?
অপর এক নামী বিদ্যালয়ের শিক্ষকের পরামর্শে অতি যত্নে তৈরী করতে লাগলাম আমার ভূগোল প্র্যাকটিকাল খাতাটি। কিন্তু কিছু কানে আসা কথা সত্যি প্রমাণিত হতে লাগল দিনকয়েকের মধ্যেই। স্কুলের প্র্যাকটিকাল করানোর ক্ষেত্রে ওঁর গাফিলতি ছিল চোখে পড়বার মতো। ভালো বন্ধু বলে যাদের মেনেছি, তাঁরাও ব্যক্তিগত ভাবে পাঠ নিয়ে ওঁর নির্দেশ পেয়ে জানাল, অন্যান্য ছাত্রীদের তাঁর বাড়িতে করানো প্র্যাকটিকাল খাতা দেখানোতে বারণ আছে। পর করে দিলেন ভালো বন্ধুদেরও।
গুরু ও শিষ্যের বন্ধন চিরন্তন। শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাঁদের প্রজ্ঞা এবং ভালোবাসায় সমৃদ্ধ করেন তাঁদের ছাত্র-ছাত্রীদের জীবন। একজন আদর্শ শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব না করে সকলকে সমান আন্তরিকতায় পাঠদান করেন। যে শিক্ষকেরা জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে তোলেন শিক্ষার্থীর মনোজগৎ এবং জীবনে সঠিক দিশা নির্দেশ করেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকাটা শিক্ষার্থীর অবশ্য কর্তব্য।
কিন্তু গুরু মাত্রেই কি তিনি শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারেন? সেই স্থান পাবার কী কোনো মাপকাঠি থাকতে নেই? স্বয়ং বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণদেবকে গুরু হিসাবে নির্বাচন করবার আগে বিভিন্নভাবে তাঁর পরীক্ষা নিয়েছিলেন। এবং তারপরই তাঁকে গুরু হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তাই একথা অনস্বীকার্য, শ্রদ্ধার আসনটি অর্জন করতে হয়, তা শুধু পদাধিকার বলে পাওয়া যায় না। আর পাওয়া গেলেও তা বজায় রাখা পদাধিকারীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
একবুক আশা নিয়ে, কত কত রাত জেগে, মন প্রাণ ঢেলে সাজানো খাতাটি নিয়ে পরীক্ষার সেই মুহূর্তে হাজির হলাম ওঁর সামনে। চেয়ারে গা এলিয়ে বসে মুখের দিকে তাকালেন, হেলা ভরে পাতা উল্টোতে লাগলেন, কখনো হাত আটকে গেলে মূখনির সাহায্য নিলেন। তাঁর হাতে আমার অতি যত্নে তৈরী খাতার অমন অনাদরে মর্মাহত হলাম। সমস্তটা দেখা হলে, কোথাও ভুল হয়েছে এমনটা বললেন না, বা বলতে পারলেন না। তাঁর বিরক্তি ভরে করা প্রশ্নের আশাকরি সদুত্তর পেলেন, সই করে দিলেন খাতায়।
এরপর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ পেল, যথারীতি ভূগোলের প্র্যাকটিকাল নম্বরে তাঁর কাছে ব্যক্তিগত ভাবে পাঠ নেওয়া ছাত্রীদের নম্বরের সাথে তথাকথিত অন্যান্য ছাত্রীদের নম্বরের বৈষম্য চোখে পড়ল। আশাহত হলাম আমরা।
শৈশব কৈশোরের কাঁচা মনে দাগ রেখে যাওয়া কিছু বিষয় বা ঘটনা বহু যুগ অতিবাহিত হলেও বুদবুদের মতো ভেসে উঠে মনে কখনো আনন্দের কখনো বা মনখারাপের রেশ রেখে যায়। তার সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর প্রতিও সেই অনুসারে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা বা অশ্রদ্ধা জাগিয়ে যায়। প্রতিটি ঘটনাই জীবনে কিছু শিখিয়ে যায়। শিক্ষকতা পেশায় পক্ষপাতিত্ব করা বাঞ্ছনীয় নয় তারই শিক্ষা পেয়েছিলাম, যা মেনে চলি আজও। আজ উঠোনে বসে বলতে ইচ্ছে হল একান্ত ব্যক্তিগত মনের এই কথাটি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴