সেই জঙ্গল কোয়ার্টার/গৌতম দে
সেই জঙ্গল কোয়ার্টার
গৌতম দে
এই ঘটনার প্রেক্ষাপট সেই সত্তর দশকের উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চল। বলাবাহুল্য উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চল তখন ছিলো অনেক বেশি গভীর এবং সবুজ ।বিশেষ কিছু বনাঞ্চলে এমন কিছু জায়গা ছিল যেখানে সূর্যের আলো মাটিতে প্রবেশ করতে পারত না। জঙ্গল ছিল ভয়ংকর পশুপাখির অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। এইসব অঞ্চলে মানুষের বসবাস ছিল খুব কম, এবং এমন কিছু বনাঞ্চল ছিল যেখানে বনদপ্তর ছাড়া সাধারণ মানুষের পায়ের ছাপ পড়তই না । তেমনি একটি জঙ্গল ছিল বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প। আজ পর্যটনের কল্যাণেঅনেকেই হয়তো জানবেন, রাজাভাতখাওয়া টিকিট কাউন্টার থেকে বক্সা যাবার জন্য প্রায় ৮-১০ কিলোমিটার একটি জঙ্গলকে অতিক্রম করতে হয় ।সভ্যতার এত অগ্রগতির সময়ও এই জঙ্গল এখনো তার নিজস্বতা ধরে রেখেছে। এখনো এই জঙ্গল রয়েছে সবুজ-গভীর -নিঝুম। রাজাভাতখাওয়ার চেকপোস্ট থেকে বক্সার পথে জঙ্গলের ধারে একটি জায়গা রয়েছে যার নাম ২৩ মাইল। সত্তরের দশকে সেখানে শুধুমাত্র বন বিভাগের একটি কোয়ার্টার ছিল আর তার সাথে ছিল একটি চেকপোস্ট। শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির ডিউটি থাকত এই চেক পোস্টে। আর এই কোয়ার্টারে থাকাটাই শুধু ছিল কাজ। এই কোয়ার্টারের চারপাশ ছিল জনমানবহীন, আর তখনকার দিনে না ছিল কারেন্ট, না মোবাইল, না টেলিভিশন, এমনকি রেডিও সেই সময় দামী বস্তু হিসেবে ধনী ব্যক্তিদের ঘরে শোভা পেত। এরকম একটা পরিবেশে, নির্জন ভয়ংকর স্থানে হিংস্র পশুপাখি, বিষাক্ত সাপের সাম্রাজ্যে একাকী এই কোয়ার্টারে থাকার কথা ভাবলেই যখন গায়ে কাঁটা দেয়, তখন এই কোয়ার্টারের ইতিহাস ছিল আরো ভয়ংকর।
এই কোয়ার্টার তৈরি হবার পর অনেক কষ্টে বুঝিয়ে এক নেপালি ব্যক্তিকে এখানে থাকার জন্য রাজি করানো হয়। তিনি মাস পয়লা রাজাভাতখাওয়া থেকে নিজের মাইনে এবং দিন পনেরোর খাদ্যদ্রব্য এবং পানীয় নিয়ে ঢুকতেন কোয়ার্টারে আর বিশেষ দরকার না হলে পনেরো দিনের আগে বের হতেন না। একবার প্রায় মাসখানেক হয়ে গেছে, উনি মাইনে তুলতেও যাননি বলে ওনার খোঁজ করতে এসে লোকজন আবিষ্কার করেন উনি কাঠের সিলিং থেকে ফাঁসি দিয়ে ঝুলে আছেন, আর ওনার গোটা দেহ পোকামাকড়ের খাদ্যে পরিণত হয়েছে। এর পর থেকে স্থানীয় লোকজন নাকি সেই কোয়ার্টার থেকে নানা রকম শব্দ শুনতে পেত। এমন অবস্থায় বনদপ্তরের সামনে এক বড় বিপদ এসে উপস্থিত হয় যে কে ওই কোয়ার্টারে থাকবেন। বনদপ্তর নিজের মতো করে খোঁজখবর শুরু করে, কিন্তু যারা ওই কোয়ার্টার সম্বন্ধে জানতেন তারা কেউই সেখানে থাকতে রাজি হচ্ছিলেন না। স্থানীয় রেঞ্জ অফিসারের হঠাৎ মনে পড়ে স্থানীয় এক যুবক গৌরের কথা। রাজাভাতখাওয়া নিবাসী বছর আঠারোর যুবক গৌরকে লোকে গোরা নামেই চিনত। ডাকাবুকো -সাহসী হিসেবে রাজাভাতখাওয়ায় তার পরিচিতি ছিল। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে প্রাইভেটে গ্রাজুয়েশন করার ফাঁকে সে তখন বনবিভাগে অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ করছে। সাথে কিছু ছোটখাটো টিউশনি করে চালাচ্ছে প্রায় পাঁচজনের সংসার। রেঞ্জ অফিসার সরাসরি প্রস্তাব দিন গোরাকে ওই কোয়ার্টারে থাকবার জন্য। গোরার সংসারে ছিল বিধবা মা, দুই ছোট ভাই এবং এক ভাগ্নে। মা ভাইদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও গোরা রাজি হয় এই প্রস্তাবে, কিন্তু তার শর্ত ছিল এর বিনিময়ে তার ভাইকে বন বিভাগে অস্থায়ী কর্মী হিসেবে নিযুক্ত করতে হবে। বাধ্য হয়ে রেঞ্জ অফিসার সেটাও মেনে নেন। এরপর মা, দুই ভাই-ভাগ্নে এবং দুটো পোষা গরু নিয়ে গোরা সংসার পাতেন সেই কোয়ার্টারে। প্রথম রাতেই গোয়াল ঘরের বাঁশের দেয়াল ভেঙে দুটো গরুকেই টেনে নিয়ে যায় বাঘের দল। এরপর থেকে প্রায় নিয়মিতভাবেই হাতির আক্রমণ,বাঘের আক্রমণকে উপেক্ষা করে প্রায় দু বছর সেই কোয়ার্টারে থেকে ডিউটি করেন গোরা। কিন্তু চাল ডাল লবণের লোভে কোয়ার্টারের রান্নাঘরে বারংবার হাতির আক্রমণ চলতে থাকার কারণে একটা সময় বনদপ্তর সিদ্ধান্ত নেন যে ওই কোয়ার্টার এবং চেকপোস্ট আর রাখবেন না।
আজও রাজাভাতখাওয়া থেকে বক্সা যাবার রাস্তায় দেখা যায় সেই কোয়ার্টারের ভগ্নস্তুপ । আজও স্থানীয় লোকজন সেই কোয়ার্টারের সামনে এলে দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে যান গন্তব্যের দিকে। কেউ কেউ আজও সেখানে নাকি অদ্ভুত কিছু আওয়াজ শুনতে পান। সেই কোয়ার্টার আর সেই সময়ের গল্প আজ স্থানীয় মিথ রূপে মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়।
তবে সরকার কথা রেখেছিল, গোরার চাকরি যেমন স্থায়ী হয়েছিল তেমনি তার ভাইয়েরও বন বিভাগে সরকারি চাকরি হয়েছিল এই অসম সাহসিকতার পুরস্কার স্বরূপ। আর গোরা অর্থাৎ গৌর দে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাহসিকতার সাথে, সাফল্যের সাথে বন বিভাগের চাকরি করে গেছেন। শুধু তাই নয় ১৯৮৭ সালে "বেস্ট ওয়ার্ল্ড লাইফ ওয়ার্কার" হিসাবে রাজ্যপালের কাছ থেকে পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴