সেই কথা/মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী
সেই কথা
মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী
সকাল থেকে সাজো সাজো রব। কাঠের বাড়িটার মাঝখানে মস্ত একটা হলঘর। সেখানে পার্টিশন দিয়ে তিনটে ঘর করা আছে। একটা বসবার, একটা ঠাকুরদা-ঠাকুমার, একটা ঠাকুরঘর। বড় বড় খাট পাতা। নবদ্বীপদারা সব স্যাটাস্যাট সরিয়ে ফেলছে। ঠাকুমা হাঁ হাঁ করে এসে বললেন, ঠাকুর রাখলে আবার সরায় নাকি? কে শোনে কার কথা! সায়েব বইল্ল, বলে সব সরিয়ে দিচ্ছে। বাবার কথাই শিরোধার্য্য। তারা কোথা থেকে চৌকি নিয়ে এসে পেতে স্টেজ বানিয়ে ফেলল। মাইক এসে গেল। শিল্পীরা হাজির। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের আসর বসবে। বাবা সকাল থেকে ধবধবে পাঞ্জাবী পরে পানের বাটা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সঙ্গীতের প্রসার ঘটানো তাঁর লক্ষ্য। বলছেন, আজ যাঁরা এখানে সঙ্গীত শুনতে আসবেন, তাঁরা প্রণম্য অতিথি। তাঁরা অন্নগ্রহণ করবেন এখানে আজ, আমরা ধন্য হব।
সন্ধে হতে না হতেই বিস্তর লোক আসতে লাগল। হাওয়ার আগে ছুটে গেছে মাংসভাতের খবর। ভেতরে একটা ঘরে খাবার জায়গা হয়েছে। রান্নাঘরে দাউদাউ করে উনুন জ্বলছে দুটো। মা-ঠাকুমা-বরদামাসি ঘেমে-নেয়ে একশা! অসীম বলশালী আমাদের ঠাকুরদাদার তখন শরীর ভেঙে এসেছে। তাঁর বয়স নব্বই পেরিয়েছে। বাবা তাঁর বৃদ্ধ বয়সের সন্তান। তিনিও উদ্বিগ্নমুখে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন।
গান শুরু হল আমার গান দিয়ে। সামনে বসে থাকা শ্রোতার দল এত হাত নাড়ছেন যে গাইতে অসুবিধে হচ্ছে। সেটা উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের বাহবা নয়! সত্যিকারের শ্রোতারা পেছনে। ভাই-বোনেরা ওদের গান গেয়ে এখানে এত ভিড় দেখে ভেতরের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবা গান শুনছেন, তদারকি করছেন, কিন্তু ঘেমে যাচ্ছেন ভীষণ! কারণ নিমেষেই উড়ে যাচ্ছে ভাত, মাংসে টান পড়েছে। কিন্তু সঙ্গীত থামছে না। সুখশ্রাব্য সঙ্গীত ও সুখাদ্য মিলে এক রসময় পরিবেশ।
দু-চারজন যাঁরা কোকরাঝাড় আর সাপটগ্রাম থেকে এসেছিলেন, রাতে ফিরে যাবার অভিপ্রায় রেখেছিলেন, তাঁরা অনুষ্ঠান শেষ করে, পেট ভরে খেয়ে স্টেজটাকেই বিছানা করে ঘুমিয়ে পড়ে নাক ডাকতে লাগলেন। আমার পিতা তাঁদের পায়ের কাছে মেঝেতে পাতা সতরঞ্জির ওপরে অকাতরে ঘুমোতে লাগলেন। তাঁর পায়ের কাছে তাঁর চিরসঙ্গী পোষ্য সারমেয়। খোলা দরজা দিয়ে মস্ত চাঁদের আলো এসে পড়েছে তখন। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। পথ ভুলে যাওয়া সাদা লক্ষ্মীপেঁচাটি বাবার মাথার কাছে স্ট্যাণ্ডের ওপর বসে ঝিমুচ্ছে। আমার ঘুমের ভেতরে তখন জলতরঙ্গের মূর্ছনা।
আজ সেকথা লিখতে বসে চোখে জলের প্লাবন!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴