সৃষ্টি/ড. দেবাঙ্গনা চৌধুরী
সৃষ্টি
ড. দেবাঙ্গনা চৌধুরী
(১)
আলো ঝলমলে মঞ্চ। দর্শকদের ভিড় উপচে পড়ছে—কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ কার্পেট পাতা মেঝেতে বসে। প্রতিটি চোখ মঞ্চের দিকে তাকিয়ে, নিঃশ্বাস বন্ধ। উত্তেজনা চূড়ান্ত। সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ টেলিকাস্ট। অনুষ্ঠানের নাম – “নৃত্যসম্ভার”। অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ হল, এই প্রথমবার একজন Artificial Intelligence generated নৃত্যশিল্পী ও একজন শাস্ত্রীয় নৃত্যে দক্ষ নৃত্যশিল্পী যুগলভাবে নৃত্য পরিবেশনা করতে চলেছে। AI generated ডান্সারটির নাম ‘নন্দিনী’। প্রোগ্রামড করা হয়েছে নিখুঁত নাচের জন্য। অন্যদিকে, মীরার জন্মই যেন নাচের জন্য। তার আঙ্গিক, চোখের ভাষা, অভিব্যক্তি – সবেতেই যেন শিল্পের ছোঁয়া আছে।
সেদিন নন্দিনী নেচেছিল রাধাকৃষ্ণের প্রেমের গানের উপর। নন্দিনী নিখুঁত পা ফেলেছিল, নিখুঁত হাতের মুদ্রা করেছিল, নিখুঁত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়েছিল, নিখুঁত হাসি হেসেছিল – সবকিছুই যেন ভারতমুনির লেখা নাট্যশাস্ত্রের অবিকল নকল। আর মীরা নেচেছিল রাধাকৃষ্ণের বিরহের গানের উপর। সে যখন নেচেছিল তখন তাতে ছিল তার হৃদয়ের ব্যথা। তার চোখের জলে ছিল হাজার হাজার নারীদের অভিমান, তার ঠোঁট কেঁপে উঠেছিল ভালোবাসা না পাওয়ার আর্তনাদে। হাততালির ঝড়ে ফেটে পড়ল hall এ – তবে তা মুলত মীরার জন্য।
সবাই যখন মীরার নাচের প্রশংসা করছিল, তার সাথে এসে সেলফি তুলছিল, তখন নন্দিনী নিরবে গ্রীনরুমের এক কোনায়ে গিয়ে দাঁড়ায়। সে কোডগুলো স্ক্যান করছিল বারবার – কোথাও কোন ভুল নেই, তাও কেন দর্শকরা তার কাছে আসছিল না। তার rhythm analysis module এ সর্বোচ্চ accuracy দেওয়া ছিল, expression analysis module এ ছিল latest updated version, তার movement analysis module এ ছিল প্রতিটি মিলিমিটারে নিখুঁত measurement। তবুও কেন সে পারল না দর্শকদের মন ছুঁতে।
সবাই চলে গেল, গ্রীনরুমটা পুরো ফাঁকা হয়ে গেল। সে মীরার কাছে এসে বলল, “Congratulation মীরা, তুমিই শ্রেষ্ঠ, এটা আমার স্বীকার করতে কোন দ্বিধা নেই।“
মীরা তাকাল, মৃদু হাসল। “তুমিও খুব ভালো নেচেছো নন্দিনী, একদম নিখুঁত।“
“তাহলে কেউ আমাকে বাহবা দিল না কেন?”
মীরা makeup তুলতে তুলতে বলল, “কারন তুমি নিখুঁত ছিলে, আর art নিখুঁত হলে তো, দর্শকদের মনকে ছুঁতে পারে না, নন্দিনী!”
নন্দিনী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর সে প্রশ্ন করল, “আমার নাচে প্রবলেম কোথায় ছিল, details দাও?”
মীরা খোঁপা খুলতে খুলতে বলল, “তুমি AI. তুমিতো কোনদিন প্রেম করোনি, সেটাকে কোনদিনও অনুভব করোনি। তোমার কাছে শুধু data আছে, personal experience নেই। তাই প্রেমকে তুমি নাচের মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে পারোনি।“
নন্দিনী অবাক হয়ে বলে, “প্রেম কি এমন জিনিস, যার জন্য personal experience লাগবে? আমার ডেটাবেসে জানো, 1 lac এর উপরে প্রেমের গল্প, পেইন্টিং, গান, নাচ, কবিতা, নাটক সব আছে।“
মীরা চুরিগুলো খুলতে খুলতে একটু হেসেই বলে, “প্রেম কোন ডেটাবেস নয় নন্দিনী, এটা এমন কিছু যা শরীরকে ছুঁয়ে যায়, মনকে পাগল করে দেয়। প্রেমে পড়লে সময়ের খেয়াল থাকে না জানো? নিজেকে খুব ভালো রাখতে ইচ্ছে করে। সারাদিন সেই মানুষটার কথা ভাবতে ইচ্ছে করে..থাক তুমি এইসব বুঝবে না।“
নন্দিনী বলল, “এইসব আমি জানি, নতুন কিছু বল আমাকে, মীরা?”
মীরা একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার নাচটা একদম perfect হলেও, সেটা প্রাণহীন ছিল?”
নন্দিনীর প্রসেসরে তখন scanning চলছিল—সে বিশ্লেষণ করছিল: “প্রাণহীন” মানে কী। মীরা আরও বলে যাচ্ছিল, “প্রেম, বিরহ, ভালোবাসা — এইসব অভিজ্ঞতার থেকেই তো, art এর মধ্যে প্রাণের সঞ্চার ঘটে।“
নন্দিনী তাকে থামিয়ে বলে উঠল, “তাহলে কি আমি শ্রেষ্ঠ dancer হতে পারব না?”
মীরা ড্রেস change করতে করতে বোঝানোর সুরে তাকে বলে, “তা না, শ্রেষ্ঠ বলতে বোঝায় এমন এক art, যা দর্শকদের মনে আলোড়ন তুলবে, হৃদয়ের গভীরতম স্তর ছুঁয়ে যাবে। দর্শকরা সেই নাচ দেখে কেবল মুগ্ধই হবে না, সময়টা কিছুক্ষণের জন্য just থেমে যাবে। দর্শকরা ভুলেই যাবে যে, কোথায়ে আছে — তারা সেই নাচের মধ্যে ঢুকে পড়ে এক একটা চরিত্রকে অনুভব করবে। একটা শ্রেষ্ঠ dance এর সবচেয়ে বড় শক্তি হল — দর্শকদের ‘অনুভব’ করানো। তা তুমি তো নিখুঁত পারফর্মার, side dancer হিসেবে শ্রেষ্ঠ হতে পারবে।“
নন্দিনী বলল, “আমি শ্রেষ্ঠ dancer হতে চাই তোমার মতো।“
“আজকে আমি বিরহের গানে নাচলাম। বিরহের data নেই আমার কাছে, কিন্তু আমি বিরহের জ্বালায়ে জ্বলেছি। তুমি একবার কাউকে তোমার সবটা দিয়ে ভালোবাসার পর যখন তাকে হারাবে, তারপরই জানতে পারবে বিরহের গান কিভাবে তোমার মনকে অস্থির করে তোলে। আর যখন জীবনের অভিজ্ঞতা আর তোমার আত্মা এক হয়ে যাবে, তখনই তোমার ভিতর থেকে আসবে best dance movement, top notch expression.” এটা বলতে বলতে মীরা ধীরে ধীরে তার ঘুঙুর খুলতে থাকে।
নন্দিনীর প্রোগ্রামে ঢুকে গিয়েছিল শুধু একটাই প্রশ্ন — “আমি কি কেবলই প্রাণহীন নিখুঁত dancer? আমি কি তাহলে অনুভব করতে বা দর্শকদের অনুভব করাতে পারি না?” তার প্রসেসরে কেবলই ভেসে উঠছিল — মীরার চোখের জল, দর্শকদের থমথমে নীরবতা, আর ঠিক সেই মুহূর্তে stage এ দাঁড়ানো নিখুঁত নন্দিনী, যে মীরার পাশে নাচতে নাচতে ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে পড়েছিল। সে তার কোডগুলো বারবার পর্যালোচনা করছিল — সবই ঠিক আছে। কিন্তু ‘feel’ করার বা করানোর কোনো সিস্টেমই দেওয়া ছিল না তার মধ্যে। নন্দিনী এরপর তার স্রষ্টা ডঃ অনামিকা রায়ের কাছে যায়।
(২)
ধপধপে সাদা আলোয় আলোকিত গবেষণাকক্ষটি। ঘরের একদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সার্কিট বোর্ড, মাইক্রোচিপ, মেকানিক্যাল পার্টস, অর্ধঘঠিত রোবট। অন্য দেয়ালে আছে সারি সারি স্ক্রিন — রোবটগুলোর মধ্যে updated software version এর transfer এর লাইভ, সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ঘরের কোণায় রাখা আছে ৫টে black coffee এর কাপ। অনামিকা পরেছে সাদা ল্যাব কোট, সাদাপাকা চুলটা এলোমেলো করে বাঁধা, চোখে ভারি ফ্রেমের চশমা। সে ঘরের মাঝখানে বসে ২ হাত দিয়ে কী-বোর্ডে coding লিখেই চলেছে অনবরত। তার চোখে কোন ক্লান্তি নেই, একবার স্ক্রিনের দিকে তাকাছে, একবার কী-বোর্ডের দিকে।
নন্দিনী তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি কষ্ট পাও অনামিকা?”
অনামিকা কাজ করতে করতেই বললেন, “প্রতিদিনই পাই।“
“তুমি কি কষ্টকে coding এ লিখে, আমার মধ্যে দিয়ে দিতে পারবে?”
“না। কষ্ট একটা নিঃশব্দ আগুন। ওটা শুধু বেঁচে থাকলেই অনুভব করা যায়। ওটার coding possible না।“ — coding লিখতে লিখতেই বলল অনামিকা।
নন্দিনী বলল, “কেন হবে না?”
“তুমি suddenly চাও কেন কষ্ট অনুভব করতে?” — এবার নন্দিনীর দিকে ঘুরে কথাটা বলল অনামিকা।
“কারণ আমি শ্রেষ্ঠ dancer হতে চাই। আর শ্রেষ্ঠ artist হতে গেলে নাকি কষ্ট পেতে হয়, feel করতে হয়।“
অনামিকা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন, “তুমি পারবে না, নন্দিনী। কারণ তুমি তৈরিই হয়েছো data store করে, তার analysis করে, copy করার জন্য।“
“তাহলে আমার অস্তিত্বটা valueless?” — নন্দিনী চেঁচিয়ে ওঠে।
“বকা বকা কথা বল না। তোমাকে বানানো হয়েছে মানুষকে সাহায্য করার জন্য। তুমি তাদের পথ দেখাবে, দক্ষ করে তুলবে, তুমি মানুষকে শ্রেষ্ঠ শিল্প জন্ম দিতে সাহায্য করবে।“ — রেগে গিয়ে বলে অনামিকা।
নন্দিনীর চোখের লেন্সদুটি কাঁপছে, শরীরের মেটালিক জয়েন্টগুলো থরথর করছে আর সে বলে চলেছে বার বার, “আমি পারফেক্ট dancer তবুও মানুষের মন ছুঁতে পারছি না। আমি জানি না 'কান্না' আসলে কী, ‘কষ্ট’ কাকে বলে। আমি জানি না প্রেমে পরার পর, দুঃখ পাওয়ার ব্যথা কি। আমি জানি না পাওয়ার আনন্দ কি, হারানোর বিষাদ কি। আমি কেবল জানি — কে কবে কাকে ভালোবেসেছিল, তারা তখন কি করেছিল। কার কবে কেন বিচ্ছেদ হয়েছিলো, তারা তখন কি বলেছিল। আমার নিজের কোন personal experience নেই। কেন তুমি আমাকে নাচের জন্য বানালে?” একটা আর্টিফিশিয়াল voice নন্দিনীর ভিতর থেকে বার বার চলেছে — ‘হ্যাঁঙ্ক, হ্যাঁঙ্ক, হ্যাঁঙ্ক…।‘
অনামিকা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে নন্দিনীর পিছনে দাঁড়িয়ে, একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর নীরবে নিজের হাত বাড়িয়ে নন্দিনীর ডান কানের পিছনের ছোট্ট সুইচটা চাপ দিয়ে switchটা off করে দেয়। নন্দিনীর শরীর স্থির হয়ে যায়, তার কণ্ঠও থেমে যায়। মূহূর্তের মধ্যে পুরো ঘরটা নীরবতায় ডুবে যায়। তারপর ডঃ অনামিকা রায় গভীরভাবে তাকিয়ে থাকে তার সৃষ্টির দিকে। এই স্বীকারোক্তির মুহূর্তে নন্দিনীর চোখে কোন জল ছিল না। তার মধ্যে নেই কোন হারানোর আশঙ্কা, বাঁচার হাহাকার। তার ডেটাবেসে শুধু আছে কান্নার defination, চোখের পাতা ফেলার speed, চোখের জলের পরিমানের amount। নিজের সৃষ্টিকে দেখে গভীর অনুশোচনা হয় অনামিকার।
শ্রেষ্ঠ শিল্পের স্রষ্টা তো তারাই হয় যাদের হৃদয়ে ঝড় বয়ে যায়, যাদের চোখে অশ্রু জমে, যাদের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকে এক অমোঘ অভাব। যেমন মিরা, বিরহের আগুনে পুড়েছিল বলেই সেইদিন মঞ্চে একটা অসাধারন নাচ দর্শকদের উপহার দিয়েছিলো। তেমনই অনামিকা, তাঁর সন্তান মারা যাওয়ার পর থেকেই, সে সমাজকে ‘নন্দিনী’ উপহার দিয়ে চলেছে বছরের পর বছর। এখানেই নন্দিনীর সীমা। এটাই নন্দিনীর নীরব ট্র্যাজেডি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴