সুমনা দত্ত ঘোষ -এর আলোচনায় গৌরীশংকর ভট্টাচার্য -এর বই 'বুক পকেটে উত্তর বাংলা'
সুমনা দত্ত ঘোষ -এর আলোচনায় গৌরীশংকর ভট্টাচার্য -এর বই 'বুক পকেটে উত্তর বাংলা'
মুখবন্ধে "আমার কথা" লিখতে গিয়ে লেখক লেখেন, "আমার কিছু বেড়ানোর গল্প ইতিউতি ছাপা হয়েছিল। সেগুলি প্রদোষের উদ্যোগে একত্রিত করে বের হল 'বুক পকেটে উত্তর বাংলা'।
লেখকের এই উদ্ধৃতি থেকেই বোঝা যায় বইটি ভ্রমণ বিষয়ক। ১২৭ পৃষ্ঠার এই বইটির সূচিপত্রে রয়েছে-
ডুয়ার্সের পথে পথে
শিলিগুড়ি
হিমালয় পর্যটনের খোঁজে
পর্যটনসন্ন্যাসী গৌরীশংকর
ফিরে দেখার টানে চেনা পথে বারবার ফিরে ফিরে গেছেন লেখক। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে বনপথের পাঁচালী, চা বাগিচার দুর্গাপুজো, মধুময় মধুপুর, পানিয়ালগুড়ি, রাইমাটাং। ইতিহাস থেকে উঠে এসেছে নল রাজারগড়। চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষের 'মনের মানুষ' চলচ্চিত্রের শুটিং ও তাঁর গল্পকথা। স্মৃতির পথ ধরে এসেছে গোসানিমারি, মোয়ামারী। "মিলন মেলা রামকেলি" লিখতে গিয়ে চৈতন্য চরিতামৃত থেকে উদ্ধৃতি নিয়ে লেখক লেখেন,
'ঐছে চলি আইলা প্রভু রামকেলি গ্রাম
গৌর এর নিকটে গ্রাম অতি অনুপম তাহা
নৃত্য করে প্রভু প্রেম অচেতন
কোটি কোটি লোক আইলো দেখিতে চরণ।'
মহাপ্রভু চৈতন্য দেব নবদ্বীপ থেকে বৃন্দাবন যাওয়ার পথে এই রামকেলি গ্রামে দিন কাটান। যারা প্রাচীন গৌরনগরী ধ্বংসস্তূপ দেখতে যান ফেরার পথে কিংবা শুরুতে পবিত্র রামকেলি দর্শন করেন চৈতন্যভাগবতের শেষ খন্ডে চতুর্থ অধ্যায়ে রামকেলি গ্রামের উল্লেখ আছে তাও জানতে পারি লেখক গৌরীশংকর ভট্টাচার্যের এই বইটিতেই।
ডামডিম, ফগুরি, মালবাজার, গারো বস্তি রায়ডাক নেস্ট, শিশামারা, গন্ডার কুটির পাশাপাশি মোহময় মূর্তি -র সুন্দর বর্ণনা তুলে ধরেছেন তিনি।
লেখক এর কলমে উঠে এসেছে মোহর গাঙ, গুলমা, গজলডোবা, জংলি বাবার মন্দির এর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা । হিমালয় পর্যটনের খোঁজে পাঠকদের নিয়ে গেছেন নিঝুম তিস্তা ভ্যালির পথে। পাবুংয়ে করেছেন দিনরাত্রি যাপন। সেলিম হিলের পথে যেতে যেতে সেলিম হিলের নামকরণের কাহিনী তুলে ধরেন পাঠকদের কাছে। ফোদাং পাহাড়ের নিচে বা শিবায় শিবাখোলা শীর্ষক ভ্রমন বৃত্তান্তে লেখক তাঁর কলমের নৈপুণ্যে প্রকৃতিকে সুন্দর করে তুলে ধরেছেন পাঠকের দরবারে। লেখাগুলো পড়তে পড়তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ডুয়ার্স ও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন দৃশ্যপট। পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই ঘরে বসে লেখকের ভ্রমণ সঙ্গী হয়ে ওঠেন পাঠক।
এই বইটির বেশ কিছু দিক রয়েছে, যা উল্লেখ না করলে গ্রন্থ আলোচনা অর্ধ সমাপ্ত থেকে যাবে। বইটির পাতায় পাতায় পর্যটন কেন্দ্রের রঙিন ছবি বই পড়ার একঘেয়েমি দূর করে। দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে পর্যটন কেন্দ্রের নানা চিত্র। সাথে সে সমস্ত জায়গায় যাবার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদি এবং যোগাযোগ নাম্বার দেওয়া আছে। আমার বিশ্বাস ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য এই বইটি ভ্রমণের গাইড বুক হয়ে উঠবেই। বইটির আরও একটি ভালো লাগার বিষয় শেষ পর্যায়ে এসে ডুয়ার্সের বিখ্যাত কবি তথা সহজ উঠোনের কর্ণধার এবং সকলের প্রিয় কবি অমিত কুমার দে-র লেখা লেখক পরিচিতি। লেখক পরিচিতি লিখতে গিয়ে কবি, লেখক গৌরীশংকর ভট্টাচার্যকে "পর্যটন সন্ন্যাসী" হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বাস্তবিক অর্থেই তিনি সন্ন্যাসী, পর্যটনের টানে সহধর্মীনির হাত ধরে বারবার ঘরছাড়া হন। কবি অমিত কুমার দে লেখেন, "কলম যে কত শক্তিশালী ও দূরগামী হতে পারে গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। তাঁর জন্য তাঁকে কখনোই নিজের ঢাক নিজে পেটাতে হয়নি। তরাই ডুয়ার্সের কত অচেনা ও অজানা জনপদকে তিনি লেখার মধ্য দিয়ে আলোক বৃত্তে তুলে এনেছেন।"
বলাই বাহুল্য একজন বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক যখন অপর একজন বিখ্যাত লেখকের লেখার প্রশংসা করেন সেখানে আমার মতো নগণ্য মানুষের গ্রন্থ আলোচনা হয়তো অর্থহীন। তবুও বলি যারা এখনো বইটি পড়েননি, বিশেষ করে ভ্রমণ পিপাসু মানুষ বইটি পড়ে দেখুন। আমি আশাবাদী আপনাদের তৃষ্ণা অনেকটাই মিটবে। আর সম্ভব হলে বইটি বগলদাবা করে বেরিয়ে পড়ুন ডুয়ার্সের আনাচে-কানাচে। কোথায় যাবেন? কোথায় থাকবেন? কার সাথে যোগাযোগ করবেন ?---ভাবছেন, এই বইটিতে সে সবেরই রয়েছে সুলুক সন্ধান।।
চরৈবেতি ২
"বুক পকেটে উত্তর বাংলা"
লেখক :গৌরীশংকর ভট্টাচার্য
প্রকাশক: প্রদোষ রঞ্জন সাহা,
প্রকাশকাল: প্রথম সংস্করণ জানুয়ারি ২০২৩
আই এস বি এন ৯৭৮ -৮১ -৯৬১ ৩৪৫- ১-৮
মূল্য :২৫০ টাকা
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴