সুনীতা দত্ত-এর আলোচনায় অমিত কুমার দে-র বই 'রাজেশ্বরী তুমি'
সুনীতা দত্ত-এর আলোচনায় অমিত কুমার দে-র বই 'রাজেশ্বরী তুমি'
ডুয়ার্স ভূমে রাজেশ্বরী
সুনীতা দত্ত
"তোমার সমস্ত জুড়ে তিলে তিলে আঁকলাম
আমার সমস্ত নদী সবগুলো বন
সমস্ত গোপন গুহা সমস্ত আকাশ
আমার অপেক্ষা আমি এঁকে দিই তোমার কাগজে"
অপেক্ষাকে এত সুন্দর এত নিখুঁতভাবে একে দেওয়া যায়, তার নির্মাণ একমাত্র কবি অমিত কুমার দে-র পক্ষেই সম্ভব। ডুয়ার্সের অন্যতম বিশিষ্ট একজন কবি অমিত কুমার দে। স্কুলবেলাতেই তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। পরবর্তীতে তিনি কর্মসূত্রে চলে গেছেন অন্য ঠিকানায়। তবে তাঁর সান্নিধ্য যখন যতটুকু পেয়েছি তাতে আমার লেখার বারবার নবজন্ম হয়েছে। তাই আজ উত্তরবঙ্গের একজন কবি হিসেবে তাঁকে নিয়ে বা তাঁর লেখা নিয়ে আলোচনা করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। অতীতে পত্রিকা ও সংবাদপত্রে তাঁর লেখা ছন্দ কবিতা পড়েছি। তখন থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম তাঁর লেখা শুধু আমাদের ধুপগুড়ি বা জেলা নয় সমগ্র সাহিত্য দরবারে একদিন নিজ প্রতাপে জায়গা করে নেবে। নিয়েছেও তাই। তাঁর "ছদ্মচাবুক" রচনা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ! তাঁর সাথে তাঁর সৃষ্টির সাথে বেশি করে একাত্ম হতে পেরেছি তার অন্তর্জাল মাধ্যম "সহজ উঠোনের" মাধ্যমে। "চিকরাশি" সাহিত্য সভা এক মিলনক্ষেত্র যেখানে আমার সৌভাগ্য হয়েছে বিশিষ্ট জনেদের সাথে পরিচিত হবার তথা তাদের সাহিত্য সম্ভার সম্বন্ধে কিছু জানার। "চিকরাশি" কবি অমিত কুমার দে সম্পাদিত এক বিশিষ্ট মাধ্যম যেখানে উত্তরবঙ্গের কবি সাহিত্যিকদের প্রতি বছর এক বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়। সাহিত্য ভূমিকে উর্বর করে তোলে তাঁর এই সম্মাননা জ্ঞাপন।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর সাথে ক্ষণিকের দেখা এবং কিছু কিছু স্থানে দীর্ঘ সময়ের সাক্ষাতেও তার অমূল্য পরামর্শ জীবন দর্শনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে সমস্ত কিছু পড়তেই পছন্দ করি তবে কবিতা আমার বিশেষ ভালোলাগার বিষয়। আজ তাই আমি কবির বিশেষ কাব্যগ্রন্থ "রাজেশ্বরী তুমি" নিয়ে কিছু কথা লিখব।
কবি তাঁর কাব্যগ্রন্থের মুখবন্ধে বলেছেন "হয়তো আমি থাকবো না, কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস বাংলা প্রেমের কবিতায় রাজেশ্বরী থেকে যাবে।" চিরকালীন আবহমান হয়ে নির্বিরোধ এক ঐতিহ্য সৃষ্টি করে যাবে এই রাজেশ্বরী সিরিজ। প্রতিটি কবিতায় কবি অক্ষত অক্ষরবৃত্ত দিয়ে পাঠকদের রাজেশ্বরীর প্রতি আকৃষ্ট করেছেন। কবিতাগুলো পড়তে পড়তে আমার কখনো মনে হয়নি কে এই রাজেশ্বরী? শুধু মনে হয়েছে কবি অন্তর দিয়ে রচনা করেছেন রাজেশ্বরীকে? যাকে তিনি অধিকারবোধে জীবনের প্রত্যেকটি স্তরে জড়িয়ে রেখেছেন। যার সাথে তাঁর মান-অভিমান, ভালোবাসা, নিঃসর্গ সব জড়িয়ে আছে। সত্যিই এই কবিতাগুলি কখনো হয়ে উঠেছে "নৈসর্গিক ক্যানভাস"। অভিমানে তিনি বলেছেন -"তোমাকে উড়িয়ে দিয়ে আমি হাঁটি শুনশান বিপর্যস্ত দিনে/ তবু এক অলক্ষ্য সুতোয় তুমি বেঁধে রাখো মৃত্যুর ঋণে।"
কাব্যগ্রন্থে তাঁর ছিল কবিতায় মুগ্ধ করে কয়েকটি লাইন - "তোমার বুকে রাজেশ্বরী নৌকো ছিল/ সব প্রতিকূল ভাসিয়ে দেবার উজান ছিল / স্রোতের সঙ্গে বোঝাপড়ার কথাও ছিল / আজ তাকালে সমস্তটাই কেমন যেন।" তাই কেমন যেন মন কেমন করা দিনে কবিতাটা আমার স্বস্তি দেয়। আবার এই প্রিয়তমা রাজেশ্বরী কখনো হয়ে ওঠে উত্তরের ডায়না, জলঢাকা অথবা কখনো ডুয়ার্সের পাখির কলতান। নিসর্গের একাত্মতায় ভেসে গিয়েও কখনো কবি লিখে ফেলেন, "আমি কলকাতায় এলেই/ মহানগর ডুয়ার্স হয়ে যায়।" কবি কখনো আবার রবীন্দ্রনাথ গাইতে গাইতে তাঁর মজবুত ব্যাগ রাজেশ্বরীর জন্য রেখে যান, পর্যটনে আবার সেই ব্যাগ নিয়ে বলে ওঠেন - "আমার অনন্ত পর্যটন চলে যাবে মৃত্যুর দিকে / তোমার গোছানো ব্যাগ কাঁধটায় আঁটো সাঁটো থাক।"
কবি শুধু এই কবিতায় নয় সমস্ত কবিতায় অনবদ্য। রাজেশ্বরীকে জাগিয়ে তুলে কখনো বলেছেন - "জেগে ওঠো জেগে ওঠো জেগে ওঠো রাজেশ্বরী/ তোমার প্রবল পুরুষ তোমার অপেক্ষায়।"
আর এই অপেক্ষাতেই কবির জন্য জেগে থাকে সমস্ত ডুয়ার্স। গরুমারা, জয়ন্তী সব জঙ্গল ভূমি সেজে ওঠে তার অক্ষর জালে। রাজেশ্বরীকেও আমন্ত্রণপত্র দিয়ে আসে। নিমন্ত্রণ থাকে অরণ্য উৎসবের। অরণ্য গর্ভে নিজেকে ভাসিয়ে রাজেশ্বরীকে নিসর্গ করে তোলেন। আমরা পাঠক কুল তাঁর এই আবহে ভেসে যাই। ভেসে যাই তাঁর রচনার মাদকতায়। রোমান্টিক কবি অমিত কুমার দে চির নতুন হয়ে ধরা দেন। আবার এই কবি তাঁর রচনাকে ছুঁয়ে সন্ন্যাস নিতে চান। তাই এই লাইনগুলো অনবদ্য হয়ে ওঠে - "আমাকে দিয়েছ তুমি চর্যাপদের শোক মন্ত্র গুলি / সেসব আমার থাক - অস্পষ্ট অন্ধকার শ্লোক -ভালো থেকো গৌতমী আমার।"
এই ভালো থাকাটাই মন্ত্র হয়ে তাঁর জীবনের অক্ষর ধাম রচনা করে যাক। আমরাও জড়িয়ে থাকি তাঁর রচনার সাথে, তাঁর সৃষ্টি হয়ে উঠুক বিশ্বময়- আকাশ বাতাস রঞ্জিত হোক প্রেমের মন্ত্রে। কারণ শেষ পর্যন্ত জীবনের শেষ কথা প্রেম। সমস্ত জীব জগত ভালোবাসার হিল্লোলে আপাদমস্তক মুড়ে রয়েছে। কবি আরও অনেক উৎসব রচনা করুন। তাঁর কথামৃত দিয়ে তৈরি হোক আরও রাজেশ্বরী নগরী। যেখানে বিরাজ করবে নিশ্চিত এক সঙ্গীতের রাগ যে রাগে হেলান দিয়ে সুখ সোপানে পৌঁছে যাওয়া যায়। কবির অক্ষর জুড়ে থাকবে সুগন্ধী। কবিতার লাইন বলে উঠবে -"সারা ঘর জুড়ে সুগন্ধি ধোঁয়া আর তোমার মেলোডি/ তুমি পুরনো পৃথিবীকে নতুন করে বুনে চলেছ, রাজেশ্বরী / আমি একটা মিছিলের শেষে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত ধূসর হতে থাকি।"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴