সুকান্ত নাহা-র আলোচনায় রাজর্ষি দত্ত-র LEAF TWO AND BUD ONE
সুকান্ত নাহা-র আলোচনায় রাজর্ষি দত্ত-র LEAF TWO AND BUD ONE
হাতের কাছে চা বিষয়ক কোনও বই দেখতে পেলেই তা আমায় টানে। যেমন টানে চা বাগানের চা-গন্ধী মানুষ। চায়ের টানে তারা তখন হয়ে যান আমার চা-চা-তো ভাই, বোন অথবা দাদা। তেমনই আমার এক চা-চা-তো ভাই এবং বন্ধু হলেন রাজর্ষি দত্ত। যার লেখা একটি গল্প সংকলন LEAF TWO AND BUD ONE। ইংরেজিতে লেখা ৯২ পাতার এই তন্বী, ছিপছিপে বইটি হাতে আসতেই প্রথমেই প্রচ্ছদে চোখ আটকে গেল। চা-জীবনের সামাজিক স্তরবিন্যাস ও সংকটের প্রতিচ্ছবি দুটি পাতা এক কুঁড়ির গায়ে ভীষণ অর্থবহ হয়ে ফুটে উঠেছে। পাতা ওল্টাতে শুরু করলুম। ড্রায়ার মাউথ থেকে ঝরে পড়া গরম সিটিসি চায়ের গন্ধ নাকে এলো। এ যেন চা-মাটি-মানুষ (অনিচ্ছাকৃত ধ্বন্যাত্মক সাযূজ্য উপেক্ষণীয়)- এর অ্যারোমা মাখানো গার্ডেন ফ্রেশ প্রোডাক্ট। কোনও ফ্যান্টাসি, আরোপিত রোমান্টিসিজম এর ব্যাপার স্যাপার নেই। একেবারে চা বাগানের অন্দরমহলের কথা রাজর্ষি তুলে ধরেছেন পাঁচটি গল্পে।
LATENT DESIRE, গল্পে বুধুয়া নামের সেই ছেলেটি যে বাগানে পাতা তোলার কাজ করে, ঘরে অসুস্থ মাকে রেখে তাকে ঘরের কাজও করতে হয়। কিন্তু তার শিল্পী চোখ দুটি খুঁজে বেড়ায় সেই ছবি, যা সে এখনো আঁকতে পারেনি। প্রকৃতির মাঝে সে ছবি আঁকার রসদ খুঁজে বেড়ায়। পাতা তুলতে আসা রমণী, দূরে পাহাড় আকাশ সবকিছুই যেন তাকে টানে। সে ছবি আঁকে কিন্তু কিছুতেই তা যেন মনমতো হয় না। একদিন চা-ঝোপে আগাছা পরিষ্কার করতে করতে সে বাগানের একান্তে চলে যায় । হঠাৎ জঙ্গলের ভেতর খসখস শব্দ কানে যেতেই চোখে পড়ে একটি বিশালাকার শিং যুক্ত বর্ণময় সম্বর খুব কাছে দাঁড়িয়ে । কাছাকাছি জঙ্গল থেকে এসে ঢুকে পড়েছে চায়ের অরণ্যে। বুধুয়া প্রমাদ গোনে ,তার বন্ধুরা টের পেলে সম্বরটিকে নির্ঘাত মেরে ফেলবে। সে প্রাণীটিকে ঢিল ছুঁড়ে তাড়ানোর প্রচেষ্টা করে। মানুষের উপস্থিতি টের পেতেই সম্বরটি ফিরে তাকায় তার দিকে। দুজনে দুজনার প্রতি কয়েক মুহুর্তের বিস্ময়াবিষ্ট দৃষ্টিনিক্ষেপ। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেতেই বিদৎুগতিতে সম্বরটি হারিয়ে যায় জঙ্গলের ভেতর। বুধুয়াকে দিয়ে যায় যুগপৎ বিস্ময় ও তার প্রার্থিত স্বপ্নের ছবিটি।
পরের গল্প TACTICS AND PRACTICE. ছোট্ট এই গল্পে রয়েছে অবৈধ সম্পর্কের জেরে ঘটে যাওয়া একটি এবং সেই খুনকে কেন্দ্র করে রহস্যের ঘনীভবন। খুনি কে? চা-আধিকারিকদের টেনশন, মানসিক টানাপোড়েন। স্থানীয় ইউনিয়ন নেতাদের হুমকি। ম্যানেজারের ওপর চাপ সৃষ্টি। এমতাবস্থায় চা- বাগানের অন্দরে যা হয় আর কি, সেই গল্প খুব সহজ ভঙ্গিতে উঠে এসেছে যা পাঠককে টেনে রাখবে। শেষ পর্যন্ত খুনি ধরাও পড়ে যায়।
চা-জীবন ছেঁকে তুলে আনা সাহিত্যে হাঁড়িয়ার গন্ধ মিশে না থাকলে তা চা-সাহিত্য নয় বলেই মনে করি ব্যক্তিগত ভাবে। মদ্যপান চা-শ্রমিকের জীবনে অভিশাপ হলেও আদিবাসী সমাজে হাঁড়িয়া একটি পবিত্র পানীয়। সামাজিক অনুষ্ঠানে হাঁড়িয়ার উপস্থিতি কিছুদিন আগে পর্যন্তও একান্ত আবশ্যিক ছিল। কিন্ত যেদিন থেকে চা-সমাজে সস্তার মিথিলেটেড স্পিরিটের অনুপ্রবেশ ঘটলো, স্বাস্থ্যহানি ঘটতে শুরু করলো চা শ্রমিকদের। সামাজিক পারিবারিক জীবনে নেমে এলো বিপর্যয়। AN ALCOHOLIC গল্পে রাজর্ষি ফুটিয়ে তুলেছেন কীভাবে একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যায় যথেচ্ছ " হাঁড়ি-দারু" ( বাগানিয়া লব্জ) র কবলে পরে। গল্পে রঙ্গিলা নামক লাস্যময়ী মদ বিক্রেতার মদ্য ও মদালসা চরিত্রের প্রতি শিবলালের যুগপৎ আসক্তি স্ত্রী ফুলমণিকে ভাবিত করে তোলে। ফলস্বরূপ সংসারে নিত্য অশান্তি। নেশাগ্রস্ত শিবলাল স্ত্রীর প্রতি অত্যাচার করে। কাজে যায় না। পরিণামে কাজ থেকে সাসপেন্ড হয় শিবলাল। হাতে পায়ে ধরে শিবলাল কাজ পায় পুনরায়। তাকে বহাল করা হয় খালাসির কাজে। মাঝে আরো অনেক ঘটনার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে একদিন অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায় শিবলাল।
না, আর স্পয়লার দেয়া চলবে না। তবে এটুকু বলব বাকি দুটো গল্প BEHIND THE SCREEN এবং OFF TO SURVIVE- MIGRATION , গল্প দুটোই চমৎকার। শেষ গল্পটি হাল আমলে চা বাগানের একটি জ্বলন্ত সমস্যা , শ্রমিকের অপ্রতুলতা। কোথায় চলে যাচ্ছে এত শ্রমিক? কেনই বা যাচ্ছে? কীভাবে বাঁচবে শ্রমিক বিহীন চা-বাগান আগামীতে? এসব নিয়ে একেবারে GROUND REALITY র গল্প।
একটা কথা বলে রাখা ভাল, যারা ডুয়ার্স অথবা কাছাকাছি শহর, নগরে বসবাস করেন, আসতে যেতে চা-বাগান দ্যাখেন, কারো মননে আবার চা- নস্টালজিয়া খেলা করে অথবা " আমার মামা ছিলেন, আমার দাদু থাকতেন, আমি দু রাত কাটিয়ে এসেছি চা- বাংলোয়" সেই গোত্রের মানুষদের কাছে গল্পগুলো পড়ে মনে হতেই পারে এ আর নতুন কি, জানি তো ( যদিও তারা চা বাগানের অন্দরের হালফিলের অনেক খবরই জানেন না), সেই সমস্ত পাঠকের কথা ভেবে রাজর্ষি লেখেননি। এবং সেই কারণেই তাঁর ইংরেজিতে লেখা। যাতে বৃহত্তর পাঠকের কাছে বইটি পৌঁছতে পারে। সুখের কথা লেখকের সাথে কথা বলে জেনেছি, বইটি পড়ে আমেরিকা থেকে দুইজন পাঠক চা-বাগান সম্পর্কে উৎসাহিত হয়ে ভারতে এসে চা বাগান দেখতে চেয়েছেন। "এটাই আমার কাছে বড় পুরস্কার" জানালেন তিনি।
রাজর্ষি একজন চা-আধিকারিক। কর্মসূত্রে প্রায় ২০ বছর যাবৎ চা জীবনের সাথে যুক্ত। চা জীবনের তাত্বিক ও ব্যাবহারিক নানা বিষয়ে খুঁটিনাটি অনেক কিছু জানা সত্ত্বেও স্মিতবাক মানুষটি একটু যেন নিজেকে আড়ালে রাখতে ভালবাসেন। তবে তার দেখায় ও লেখায় যে কোনো 'জল' নেই বরং পুরোটাই সরাসরি 'বাঁট' থেকে আহৃত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাহিনির পাশাপাশি তথ্যও পরিবেশন করেছেন যা কখনো নিরস প্রবন্ধগন্ধী বলে মনে হয় নি। ফ্লেভারটা বজায় রয়েছে। পাশাপাশি নির্জলা সত্যটাও উঠে এসেছে।
আদ্যন্ত সাবলীল ইংরেজিতে লেখা বই। ছাপা চমৎকার। প্রকাশক NOTION PRESS, CHENNAI. ট্যাঁকসই ট্যাগাঙ্কিত মূল্য ১৯৯।
চা-মাটি- মানুষের জীবনের সম্পর্কে জানতে হলে বা অবাঙালি, প্রবাসী বন্ধুদের উপহার দিতে গেলে বইটি কিনতেই পারেন।
গল্প সংকলন: LEAF TWO AND BUD ONE।
লেখক: রাজর্ষি দত্ত। পাওয়া যাবে AMAZON এ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴