সুকান্ত নাহা-র আলোচনায় অর্ণব সেন-এর বই 'সময়ের গল্পচর্চা: নির্মাণ ও সৃষ্টি'
সুকান্ত নাহা-র আলোচনায় অর্ণব সেন-এর বই 'সময়ের গল্পচর্চা: নির্মাণ ও সৃষ্টি'
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন "সকল বয়সেই মানুষ গল্পপোষ্য জীব।" আধুনিক নেটপোষ্য মানুষও কিন্তু আদতে গল্পপোষ্যই। এই যে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, রিলসের ফুলে ফুলে ভ্রমরের মতো মানুষের নিয়ত ভ্রমণ, সেও তো ঐ গল্প খোঁজার তাগিদেই। সভ্যতার আদিপর্ব থেকেই মানুষ গল্প বলতে ও শুনতে ভালোবাসে। পরম্পরাগত ভাবে মুখে মুখে সেই গল্প প্রবাহিত হতে থাকে। হতে হতে তাতে পলি পড়ে। বিবর্তনের পথ বেয়ে কিছু কাহিনি মিথেও পরিণত হয়। চারণকবির সুরে রাজরাজরা, দেবদেবীর কাহিনি নির্ভর গল্প ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশ থেকে দেশান্তরে। ক্রমে ছাপাখানার আবিষ্কারের মাধ্যমে লিখিত আকারে গল্প, উপন্যাস, আখ্যান, উপাখ্যান, কল্পকাহিনি প্রকাশ পেতে থাকে। পাঠক জীবনরস ও রহস্যের সন্ধানে মুখ গোঁজে বইয়ের পাতায়।
কাহিনি সৃষ্টি ও নির্মাণ দুটি কি অভিন্ন? নাকি ঐ দুইয়ের মধ্যে বিরোধ ও ঐক্য দুইই বর্তমান। বাংলা ছোটগল্পের ভুবন যেমন বিস্তৃত তেমনি বিশ্বসাহিত্যের সমান্তরালে তার অবস্থান যথেষ্ট সমীহ আদায় করে নেয়। তেমনই বাংলাভাষায় রচিত কালজয়ী উপন্যাসের সংখ্যাও কম নয়। বাংলা ছোটগল্প ও উপন্যাসের ওপর বিশ্লেষণধর্মী লেখা ও গবেষণার কাজ নিরন্তর হয়ে চলেছে। উত্তরবঙ্গ তথা বাংলার সাহিত্য জগতে শ্রী অর্ণব সেনের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। এপার বাংলার বাংলা ভাষায় রচিত গল্প, উপন্যাস, গল্পকার ও ঔপন্যাসিকদের ওপর বিশ্লেষণধর্মী বহু লেখা তিনি লিখেছেন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়। সেই সমস্ত লেখা থেকে ঊনিশটি প্রবন্ধ একত্রিত করে বিগত ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়েছে একটি প্রবন্ধ সংকলন "সময়ের গল্পচর্চা: নির্মাণ ও সৃষ্টি"। এই সংকলনের প্রতিটি প্রবন্ধ বিশেষ মূল্যবান।
"এখন ছোটগল্প" ও "ছোটগল্পের ভাষা সময়ের ভাষা", শীর্ষক আলোচনার দুটি পর্বে তিনি খ্যাতনামা ও স্বল্প খ্যাত কথাকারদের বেশ কিছু বিখ্যাত গল্পের প্রকরণ, ভাষারীতি, একের সঙ্গে অপরের গদ্য নির্মাণের পার্থক্য নিয়ে ধরে ধরে আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, কমলকুমার মজুমদার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, বিমল কর, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মতি নন্দী, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায় থেকে হাল আমলের আফসার আহমেদ, আজিজুল হক, ভগীরথ মিশ্র, অমর মিত্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, মানব চক্রবর্তীতে এসে বাংলা গদ্যে চলন কীভাবে বদলেছে তা সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন। ক্লাসরুমে একজন দক্ষ বাংলা শিক্ষক যেভাবে পাঠদানকে ছাত্রছাত্রীদের কাছে রীতিমতো আকর্ষণীয় করে তোলেন, তেমনি আগ্রহী পাঠক বিশেষ করে গদ্যশিল্পীদের কাছে এই আলোচনা প্রতিটি ছত্রে মনোগ্রাহী হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে।
আলোচনা করেছেন জাঁ পল সার্ত্রের পাঁচটি গল্পে সার্ত্রের অস্তিবাদ নিয়ে, যা পাঠককে সমৃদ্ধ করবে। সেই সঙ্গে উঠে এসেছে গল্পের প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা।
গল্প উপন্যাসের আলোচনার সাথে সাথে অর্ণববাবু কিছু বিশিষ্ট গল্পকার ও ঔপন্যাসিকদের রচনাশৈলী সম্পর্কে নিবিড় আলোচনা করেছেন যা ঋদ্ধ করবে পাঠককে। যেমন "কলঙ্কিত সম্পর্ক: জগদীশ গুপ্ত আধুনিকতার অন্য ভাষ্য" নিবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে লেখক আলোর জগতের উল্টোপিঠে অন্ধকার অমানিশার কথা বলেছেন। এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি এক জায়গায় লিখছেন," ... তাঁর গল্পে উপন্যাসের নায়ক তাই অপনায়ক (anti hero) যার মধ্যে পূর্ববর্তী যুগের মহাকাব্য বা উপন্যাসের নায়কদের মতো উদারতা, মহত্ব, গৌরব এবং বিপুল সম্ভাবনা নেই, আছে খলতা, নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা আর মূল্যবোধের প্রতি উপেক্ষা।" জগদীশ গুপ্তের সাহিত্য সম্পর্কে যাঁদের সম্যক পরিচিতি আছে অথবা নেই তাঁরা এই লেখা পড়ে এই বিরল গোত্রের লেখক সম্পর্কে আগ্রহান্বিত হবেন।
ব্যতিক্রমী লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় স্বল্প পঠিত লেখক। তাঁর সম্পর্কে যারা তেমন অবহিত নন তাঁরা "সন্দীপন এবং সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী ও অন্যান্য" শীর্ষক আলোচনায় লেখকের গদ্যশৈলী সম্পর্কে জানতে পারবেন।
"সুবোধ ঘোষের ছোটগল্পে বহুমাত্রিকতা" নিবন্ধে অর্ণববাবু লিখছেন,"আসলে মনে রাখতে হবে সুবোধ ঘোষের এমন একটা নিজস্ব শৈলী গল্পের গদ্য ভাষায় প্রতিফলিত হয় যা চিনিয়ে দেয় অনিবার্যভাবে এক স্বতন্ত্র মাত্রার লেখককে।" এই আলোচনায় বেশ কিছু গল্পের ওপর আলোকপাতের সাথে সাথে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকেও সুন্দর ভাবে ছুঁয়ে গেছেন।
"আধুনিক ছোটগল্পের ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে বিমল করকে বাদ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া কঠিন।" প্রাবন্ধিক শ্রী সেন "ছোটগল্পে ভাষার আধুনিকতা ও বিমল কর" নিবন্ধে সাহিত্যিক বিমল কর সম্পর্কে বলতে গিয়ে দেখিয়েছেন ঠিক কোন জায়গায় সমসাময়িক গল্পকারদের চাইতে বিমল করের গল্প আলাদা। লেখকের সাথে বিমল করের ব্যক্তিগত আলাপ থাকায় তাঁর সাথে দেখাসাক্ষাৎ, আলাপচারিতার কথা যেমন এসেছে তেমনি তার রচনাশৈলী নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের উদ্ধৃতি টেনে লিখেছেন "বিমল কর বাংলা ছোটগল্পের নতুন রীতি শুরু করেন।"
"গল্প সন্ধানী বিমল মিত্র" নিবন্ধে আলোচনা করেছেন শরৎচন্দ্রের পর একটা সময় বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক বিমল মিত্রের সাহিত্য কীর্তি সম্পর্কে। এ পর্বে বিমল মিত্রের ছোটগল্পের চাইতে তাঁর উপন্যাসগুলো সম্পর্কে স্বল্প পরিসরে সুন্দর আলোচনা করেছেন। আমরা জানতে পারি মার্গসংগীতের ভক্ত বিমল মিত্র কীভাবে ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ ও ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের সংগীত থেকে প্রেরণা খুঁজে পেয়েছেন বৃহৎ উপন্যাস সৃষ্টির।
"রমাপদ চৌধুরী: ছোটগল্পে নিজস্ব ভূমিতে"
এই লেখাটি পড়ে জানা যায় মধ্যবিত্তের জীবনকে আতস কাচের নিচে ফেলে নিবিড় পর্যবেক্ষণের ভেতর দিয়ে সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী কীভাবে জীবনকে দেখেছেন। এ পর্বে তিনি অনেকগুলো গল্পের আলোচনা করেছেন। মানুষের মনের গভীর, জটিল বাঁকে লুকিয়ে থাকা গল্পসন্ধানী রমাপদর গল্প ও উপন্যাস কীভাবে সাহিত্যে একটি স্বতন্ত্র মর্যাদার আসন দখল করেছে তার অনুপুঙ্খ আলোচনাও করেছেন।
কথাকার সাধন চট্টোপাধ্যায়। যে নামটির সাথে বহু পাঠক অপরিচিত। অথচ নিছক পাঠক মনোরঞ্জনের রাস্তায় না হেঁটে যে গুটিকয়েক লেখক লেখালেখির ক্ষেত্রে যে
বিকল্প পথের সন্ধান করেছেন সাধন চট্টোপাধ্যায় তাঁদেরই একজন। লেখকের গল্পের শিরোনাম,"যখন পা দাঁড়িয়ে থাকে, জুতো হাঁটে" " মাছিদের কোন শ্রেণীশত্রু নেই" "নয় নৌকো আঠাশ ঘোড়া" --- গল্পের নামকরণই বলে দেয় গল্পকারের স্বতন্ত্র চেতনার কথা।
"পীযূষ ভট্টাচার্যের গল্পে বহুমাত্রিকতা" লেখাটিতে তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এই বিস্মৃতপ্রায় লেখকের সাথে।
"ইদানিং উত্তরের গল্পপাঠ" শীর্ষক নিবন্ধে তুলে ধরেছেন উত্তর বঙ্গের প্রথিতযশা গল্পকারদের লেখালেখির কথা। রচনাটি বেশ আকর্ষণীয়।
"অমিয় ভূষণ মজুমদারের কথাসাহিত্যে" নিবন্ধে 'লেখকদের লেখক', 'বিরল প্রজাতির লেখক', উত্তরবঙ্গের লেখক' ' উন্নাসিক লেখক' 'ছোট পত্রিকার লেখক আবার 'সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক' ইত্যাদি বহু বিশেষণে ভূষিত উত্তরের গর্ব এই সাহিত্যিকের গল্প উপন্যাস বিষয়ে বিশদভাবে লিখেছেন। না পড়লে তার বিস্তৃতি বোঝা যাবে না।
"নকশালবাড়ি আন্দোলন ও বাংলা উপন্যাস" প্রবন্ধে লেখক চমৎকারভাবে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ছুঁয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এই আন্দোলনকে উপজীব্য করে বাংলা সাহিত্যে কত গল্প উপন্যাসের জন্ম হয়েছে তার সুলুক সন্ধান দিয়েছেন।
"সময়ের গল্পচর্চা: নির্মাণ ও সৃষ্টি" গ্রন্থটি বর্তমানে যারা গদ্য সাহিত্য চর্চার সাথে যুক্ত তাদের এবং বাংলাভাষার কথাসাহিত্যিকদের রচনা, জীবনদর্শন ও তাদের সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে বিশিষ্টতা ও স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে আগ্রহী পাঠকদের মনোযোগ কেড়ে নেবে নিঃসন্দেহে। যেহেতু শ্রী অর্ণব সেন একজন বাংলা সাহিত্যের প্রাজ্ঞ শিক্ষক সুতরাং তাঁর রচনায় সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা যে তুল্যমূল্য রূপে বিশ্লেষিত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এ কথা না বললেই নয় যে সেই সমস্ত আলোচনায়, কথায় অহেতুক শিক্ষক সুলভ গাম্ভীর্য নেই। খুব সহজ ভাবে গল্পের ঢঙে তিনি আলোচনা করেছেন। আর সেই কারণে নিবন্ধগুলো পড়তে কখনো নীরস মনে হবে না। বিশেষত বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ও গদ্যকারদের এই আলোচনা গ্রন্থটি অবশ্যপাঠ্য বলেই মনে করি।
সময়ের গল্পচর্চা: নির্মাণ ও সৃষ্টি
লেখক: অর্ণব সেন
প্রকাশন: এখন ডুয়ার্স
দাম: ১৯৫ টাকা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴