সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
20-August,2023 - Sunday ✍️ By- রাজর্ষি দত্ত 387

সাতচল্লিশ ছটাক/রাজর্ষি দত্ত

সাতচল্লিশ ছটাক
রাজর্ষি দত্ত

                                (১)
কলপাড়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসা ক্ষিতীশদা মুখ থেকে পেস্টের দলা থুক করে ফেলে বাঁদিকে তাকিয়ে বলে –‘কি ব্যাপার ? মানিকজোড় এই সাতসকালে?’ 

সন্ত, মানে দীপের বন্ধু লক্ষ করলো একটা মাছি ক্ষিতীশদার ঘাড়ের কালো একগুচ্ছ চুলে ভনভন করছে।দেখে কেমন একটা অস্বস্তি হয়।তার মধ্যে সে বলে ফেলে ‘ঐ যে, গত কালকের…’ 

‘উড়ে বাবা রে!’ ক্ষিতীশদার আওয়াজ অন্যরকমভাবে বের হয় মুখে ব্রাশ থাকায়।খাড়া উঠতে গিয়ে মালাইচাকি কটকট করে উঠেছে।হেলথ সেন্টারের দেয়ালে আঁকা হুইলচেয়ারের চিহ্নের মত দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ব্যাথার ঝাঁজটা গলা দিয়ে বের হয় –‘তোদের বলেছি না…একবার কথা বলতে হবে…প্রসাদের সাথে’!  
 
দীপ মুখটা করুণ করে বলে –‘এখনই বলুন না? আমার হাতে ছুটি নেই।পরশুই ফিরে যাব!’  

ক্ষিতীশদা এবার সোজা হতে পেরেছেন।ব্যাথাটাও আপাততঃ গেছে।‘ওঃ, জ্বালিয়ে মারলি তোরা!’ লুঙ্গির নিচের অংশ তুলে কোমরে গুঁজে নধর ভুঁড়িটায় বাঁ হাত বোলাতে বোলাতে কলঘরে ঢোকেন তিনি।সেখান থেকে শোনা যায় ‘গলগল,খ্যাক,থুঃ,ওয়াক’ ইত্যাদি প্রভাতী ধ্বনি।তারপর গলায় গামছা ঝুলিয়ে মুখ মুছতে মুছতে প্রসাদদাকে ফোনটা লাগিয়ে দীপের হাতে দিয়ে বলেন ‘নে, তুই আগে বল…’

‘এ আঁখে…ইয়ে কাজল…কয়ামত কয়ামত…’রিংটোন থামতেই ওপাশে বাজখাই গলা ‘শুয়োরের বাচ্চা,এটা কি ফোন করার সময় ?’ দীপ চমকে উঠে আর চুপসে যায়।

‘হয়েছে তো? এবার দে’ মোবাইল কানে ক্ষিতীশদার মুখ বিগলিত ‘হ্যাঁ রে ভাই প্রসাদ, একটু সময় প্রসাদ দে না! আরে আমাদের খুব পরিচিত…ঠিক ঠিক…যা বলবি ভাই…দ্যাখা হবে, ছাড়ি…’ 

গলার গামছাটা কোমরে বেঁধে একটা ফিলটার উইলস ধরিয়ে ক্ষিতীশদা বলে ‘এবার পায়খানা যাব –তোরা দুপুর আড়াইটায় পার্টি অফিসে চলে আয়-’

                            (২)
ল্যাটা মাছের ঝুরি রান্নাটা মা ভাল করে।বেশ টকটক, ঝাল ঝাল।দীপ দুপুরে খেতে বসে শুনছে মায়ের ঘ্যানঘ্যান–‘লোকে বলে বড় ছেলে বুদ্ধু হয়, ছোট গুলান চালাক।আমার কপালে হইছে উল্টা! তোর দুই দাদা এত্ত শয়তান!এদের মানুষ করতে তোর বাবাকে কম কষ্ট করতে হইছে,অ্যাঁ ?ভাইবে মইরে যাই, পুরা আট কাঠা জমি পোমোটারে বায়না কইরে দিছে – জমিটা কার?তোর বাবার না?  একবার পর্যন্ত জানায় নাই রে! বংশের কুলাঙ্গার দুইটারে পেটে ধরছি।’দীপের মার গলা ধরে আসে,চোখের জল মোছে।  

‘আমিও তো কিছু জানি না, মা।’

‘তোকে তো মনুষ্যের মধ্যেই আনে না। না করছিস বিয়া, চাকরিটাও অমনি –’ 

‘বার বার এক কথা বলবে না তো...ব্যাঙ আমার!খেতে দাও।’  

গায়ে ফোসকা লাগে দীপের।কথাটা মিথ্যে নয়।কলকাতার একটা পত্রিকা আর তার পাক্ষিক ম্যাগাজিনের সাথে যুক্ত হয়ে যৎ-সামান্য কামাই। তাছাড়া টিউশন পড়ানো, অনলাইনের টুকটাক কাজ করে লড়ে যাচ্ছে গত কয়েক বছর।অথচ ওর দুই দাদাই ওয়েল এস্টাব্লিসড।একজন ইন্দোর, অন্যজন খড়গপুরে পোস্টেড।ওরা দুজনেই এই মফস্বলের বাড়িটা ঝেড়ে ফেলতে চাইছে।কিন্ত ওদের বাবা কালিশঙ্কর প্রকাশ্যে বলেছেন –‘এ অসম্ভব, আমি বেঁচে থাকতে…’। তাই গোপনে চলছে হস্তান্তর প্রক্রিয়া। অনেকদূর এগিয়েও গেছে ব্যাপারটা।সেদিন প্রোমোটার এসেছিল কাগজে একটা সইয়ের জন্য।সবটুকু বলেনি,তবু পুরো অভিসন্ধি আঁচ করে কালিশঙ্কর আকাশ থেকে একেবারে তুষের আগুনে গিয়ে পড়েছেন।তাই ছোট ছেলেকে জরুরি তলব। 

অপমানে দগ্ধ, বিধ্বস্ত দীপের বাবার গলায় পোড়া কয়লার ধক- ‘পাবনার সোনাতলা গ্রামে আমাগো ভিটার কুলদেবতার মূর্তি তর ঠাকুদ্দা বস্তায় বাইন্ধ্যা, স্কন্ধে বইয়া আইনছিল।লগে ওই দ্যাশের মাটি ।এই বাড়িতে মন্দিরের ভিত প্রতিষ্ঠা হইল দ্যাশের মাটি ছিটাইয়া।তুলসীমঞ্চের মাটিও ওই দ্যাশের।হেইডা বুঝস তরা?’ 

এসব কথা দীপ জানেই। অগ্রহায়ণের এক তিথিতে বাড়িতে কুলদেবতার পুজো হয় বেশ ঘটা করে।প্রচুর লোক সমাগম হয় তখন।এসব দীপের বাবা তাঁর পেনশনের টাকা ভাঙ্গিয়েই করেন–কোন ছেলের কাছে হাত না পেতে।

বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসা বাবার নুব্জ অবয়ব আর ভাঙাচোরা মুখটি দেখতে দীপের আর ভাল লাগে না।ও বেরিয়ে পড়লো সন্তর বাড়ির দিকে।

                                (৩)
প্যাকেটের অর্ধেক রজনীগন্ধা মুখের ভেতর চালান করে দিয়ে প্রসাদদা এক ঝলক তাকালো-‘যা বলার বল জলদি। আমার হাতে সময় নেই। একটা মিটিং আছে…’

যা বা যেটুকু বলার ক্ষিতীশদাই জানায়। ‘তাছাড়া এই ছেলেটার বাবা আমার স্কুলের মাস্টার, একটু দ্যাখ না প্লীজ…’ 

‘শোন’,প্রসাদদা ফাইল, ব্যাগপত্র গোছাতে গোছাতে বলে ‘চেয়ারম্যানকে বলে কোন লাভ নেই। নটঘট যা হয়েছে চেয়ারম্যানের অজান্তে নয়।বরঞ্চ ও যার হিসাবে চলে সেই জগবন্ধুদাকেই ধরতে হবে। নতুন ডিসট্রিক্ট সেক্রেটারি জগবন্ধুদাই হচ্ছে–আগাম বলে দিলাম।কিন্তু…কিন্তু…কিছু লাগবে ভাই…’ 

দীপ বলে–‘টাকা লাগবে?’

‘উঁহু’ প্রসাদদা মাথা নাড়ে।আর পিচ করে একটা পিক ফেলে ডাস্টবিনটায়। 

‘তাহলে অন্যকিছু?বলে ফ্যাল!আটকাবে না…কি?’ক্ষিতীশদা দীপ আর সন্তর দিকে তাকিয়ে চোখ মটকান।

‘না রে বাবু! জগবন্ধুদা কোন উঠতি ছ্যাঁচড়া লিডার না যে টাকার বান্ডিল, সেভেন ফিফটির দুটো স্কচের বোতল বা ডবকা মেয়েছেলে পেলেই কাজ করে দেবে। দিনকালও বদলে যাচ্ছে।এরা এখন অন্য কিছু চায়।’

সবাই উৎসুক চোখে তাকায়।

‘এদের লাগে অনেক পাওয়ার।এদের লাগে ক্লিয়ার ইমেজ-পাব্লিকের সামনে।চাই সোশাল রিকগনিশন।এসবের পেছনে এরা পাগল…সাইকোপ্যাথের মতন…’ 

‘তোদের কপাল ভাল’ প্রসাদদা উঠে দাঁড়ান ‘আজ রাত আটটায় জগবন্ধুদার সাথে আমার অ্যাপো করা আছে।আলিশান রিট্রিট।ওখানে তোরাও আসবি।’ 

                                (৪)
ক্ষিতীশদা যাকে বলেছিল ‘কুত্তাপ্রেমী’, তিনি এখন বসে দেড় লাখের কালো সোফায়।ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, পাট করে আঁচড়ানো চুল, ক্লিন শেভড।পাশে সাদা রঙের জার্মান ল্যাব্রাডর।তিনি তাকালেন।চশমাখানি দামী অবশ্যই-কাচের রং সোনালি-ভেতরে উদাসী সাধুর ভাসা ভাসা চোখ।

‘বল, কি সমস্যা !’ একটা গাঢ় স্বর ভেসে এল।

কি অদ্ভুত ভদ্র গলা! মনে হয় যেন সব উজার করে এনাকেই বলা চলে।তাই বলতে বলতে দীপের গলায় কাঁপুনি এল…আবেগে চোখে জল এসে গেল…‘বাবা-মা আর কদিন বাঁচবে বলুন? কিন্ত সাতচল্লিশ ছটাক জমির উপর এই মন্দিরটা একটা বিরাট সেন্টিমেন্ট ! আমার দাদারা সেটা বুঝল না।মা বাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন-যদি আটকানো যায়।প্রোমোটার সেদিন কড়া ভাবে বলে গেছে – তারপর থেকেই ওরা যেন কেমন হয়ে গেছেন।’ 

‘কে প্রোমোটার?’ আবার মহেন্দ্রস্বর।

‘শরতের ভাইস্তা,ওর নামটা...নামটা…কি যেন?’ প্রসাদদা বলে।

‘ওকে আমার সাথে দেখা করতে বল’ জগবন্ধুদা ফিরলেন দীপের দিকে ‘তুমি কিসে আছ ভাই ?’

দীপ জানালো।

‘হুম, তোমাদের পত্রিকা আর ম্যাগাজিনটার নাম শুনেছি। বেশিদিন হয়নি…তবে এরমধ্যে বেশ নামডাক হয়েছে, তাই না? তো...তুমি আমার ব্যাপারে কিছু জান?’

প্রসাদদা বললো ‘ও কি করে জানবে দাদা? এখানে তো থাকেই না।বুঝলি দীপ-জগবন্ধুদার মত পশুপ্রেমিক এদিকে পাবিনা…পথচারী কুকুরদের জন্য উনি যা করেছেন তা ভাবাই যায় না !তোরা খালি কলকাতার কথাই হাইলাইট করিস…উত্তরবঙ্গেও যে এমন বিরল লোক আছেন…’ 

জলটা কোনদিকে গড়াচ্ছে দীপ একটু একটু আঁচ পায়।ও বলে-‘আর কিছু ইনফর্মেশন পাব প্রসাদদা?’

ক্ষিতীশদা উৎসাহ দেখিয়ে বলে–‘আরে আমি কালকেই তোকে নিয়ে যাব জগবন্ধুদার চ্যারিটিতে।সব দেখে নিবি ভাল করে।তারপর তোদের ম্যাগাজিনে জম্পেশ করে একটা আর্টিকেল ছাপিয়ে ফেল দাদার উপরে, ফটো-টটো দিয়ে।আলাদা কপিও রেখে দিস দাদার জন্য, সার্কুলেশন করতে হবে…এক-দেড়শোটা তো লাগবেই…’ 

জগবন্ধুদার অভয়বাণী গমগম করে ‘তোমার বাবা…মাস্টারমশাইকে বোলো নিশ্চিন্তে থাকতে। আমি তো আছিই…’ 

ফেরার সময় ক্ষিতীশদা একলা দীপকে বললো-‘হাঙরের পেটে যেত, এখন খাবে তিমি…ভালই! যাকগে… আর ভাবনা নেই…কালকের কাজটা ভুলিস না যেন…পুজোতে আসবি তো? তখন আমাকে, প্রসাদদাকে একটু খুশি করে দিস…হা হা…’   

                            (৫)
রাত সাড়ে নটা। মন্দিরের ঠাকুরঘরে হাল্কা নীল নাইটল্যাম্পের আলোয় স্থির কুলদেবতার মূর্তি। তাঁর দিকে পেছন ফিরে কালিশঙ্করবাবু বসে আছেন চাতালের নিচে সিঁড়িতে। দৃষ্টি রাতের মেঘহীন স্বচ্ছ আকাশের পানে। সপ্তর্ষিমণ্ডলের বশিষ্ঠ, মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলহ, পুলস্থ আর ক্রেতু –এই সাত ঋষি তারার রূপ নিয়ে আকাশের বুকে এঁকে দিয়েছে এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন! এই প্রশ্ন আদি অনন্তের।আবার এই ক্ষুদ্র গ্রহেরও, অগুন্তি পার্থিব ও জাগতিক প্রশ্নমালার।

কালিশঙ্কর ভেবেই চলেন। বুকে নদীর পার ভাঙ্গার নিঃশব্দ ধ্বনি। সাতপুরুষের ভিটে ছেড়ে, মায়ের কোলে, মেরুদণ্ড ভাঙা সর্বহারা উদ্বাস্তু পরিবারের সাথে ঠাঁই মিললো নতুন দেশে। তাদেরই মতন রিক্ত অথচ স্বাধীন দেশ! দুচোখে তখন দেশের আর নিজের স্বপ্ন মিলেমিশে একাকার।মন্দিরের জমিতে তাঁর বাবা ছিটিয়ে গেছেন ‘দ্যাশের’ মাটি। আসলে তা পূর্বপুরুষের খাঁটি রক্তের অংশ – চরিত্রের, সততার, ত্যাগের, সংকল্পের, শিক্ষার, সহিষ্ণুতার…। এ সব সম্বল করেই এগিয়ে চলা সময়ের হাত ধরে…
কিন্তু… তারপর ?

সব কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে গেল। কেন?
যে মাটির দানা আঁকড়ে রয়েছেন আজীবন তা আজ গলিত। বাতাবরণটা বদলে গেছে কুৎসিত আবহে। জুটেছে ব্যাঙ্গ, তিরস্কার, নোংরা অপমান।স্বপ্নের নিদারুণ ভাঙচুর। দেশের আর পরিবারের।তার মজ্জার ভাগ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন নিজের সন্তান বা অগুন্তি সন্তানসম ছাত্রবৃন্দকে। কেন?

‘বাবা, চিন্তা কোর না, সব যেমন আছে তেমন থাকবে।’

দীপ খেয়াল করলো না ভাবলেশহীন, নিরুত্তর বাপের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল কখন শুকিয়ে গেছে। সাতচল্লিশ ছটাক জমির উপর গড়া মন্দিরের কুলদেবতাই বুঝি দেখলেন সবটুকু!

শুধু দেখেই গেলেন? দেশমাতৃকার ভুমিকাতেও?

আকাশের বুকে সুস্পষ্ট প্রশ্নচিহ্ন তবু রয়েই গেল-রয়েই যায় !

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri