সহজ উঠোনের বন্ধুদের প্রতি/শ্বেতা ভট্টাচার্য
সহজ উঠোনের বন্ধুদের প্রতি
শ্বেতা ভট্টাচার্য
চৈত্রের মাঝামাঝি লিখতে শুরু করেছি এই চিঠি। তোমাদের হাতে যখন পৌঁছোবে তখন হয় তো চৈত্রের শেষ বা বৈশাখের শুরু। বসন্তকাল চলছে, কিন্তু দখিনা বাতাস তো দূর অস্ত, বসনই গায়ে রাখা রীতিমতো দুষ্কর। কাঠফাটা জষ্টি আর তালপাকা ভাদ্র মিলিয়ে মিশিয়ে চামড়ায় জ্বালা ধরায়। মেদিনী যেন জ্বলন্ত কড়া! নদীপুকুর শুকিয়ে খটখটে। মাটি ফুটিফাটা। চৈত্রেই এই নিদাঘ, জ্যৈষ্ঠ কিংবা আষাঢ়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এই তাপমান? তাপমাত্রা যে উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে! আদৌ কি কোনো স্থিরমানে পৌঁছোবে পারদ? প্রত্যাবর্তন কি সম্ভব পূর্বের আরামপ্রদ অবস্থায়? জানো তো ভাঙ্গন একবার শুরু হ'লে তা ঠেকানো মুশকিল? স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো ক্রিয়াই প্রত্যাবর্তক নয়। সে ম্যাক্রোস্কোপিক স্তরেই হোক কিংবা মাইক্রোস্কোপিক! ঠিক তীর বা শব্দের মতো, একবার বেরিয়ে গেলে যেমন প্রত্যাবর্তন অসম্ভব!
যে মাছ স্রোতের প্রতিকূলে গতিশীল, তাকে স্রোতের অনুকূলে নিয়ে আসতে বল প্রয়োগ করা আবশ্যক। কারণ তার স্বতঃস্ফূর্ততা ওই প্রতিকূলেই, সেটাই তার অনুকূল। কিন্তু সে বলের সর্বোচ্চ সীমা কী? আর যদি তা প্রত্যাহত করা হয় পরিবর্তন কি তখনও স্থায়িত্ব পায়? না কি শীর্ষের ডগায় দাঁড়িয়ে থাকা পিরামিডের মতো অস্থির সাম্যে বিরাজ করে? অথবা গড়িয়ে যাওয়া গোলকের মতো নিরপেক্ষ সাম্যে থাকে?
ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলাই প্রকৃতির(nature) ধর্ম। শৃঙ্খলা তার প্রকৃতির (Characteristics) পরিপন্থী। তাকে শৃঙ্খলে বাঁধলে বা সুসজ্জিত করতে চাইলে মহাবিশ্বকে বহন করতে হয় তার দায়।
"আমাকে যে বাঁধবে ধরে এই হবে যার সাধন,
সে কি অমনি হবে।
আপনাকে সে বাঁধা দিয়ে আমায় দেবে বাঁধন,
সে কি অমনি হবে.."
নিশ্চয়ই জানতে চাইবে ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলা কী? প্রথমে বলি বিশৃঙ্খলা কী... দিন কয়েক আগে এক বিয়ে বাড়িতে যেতে হয়েছিল। যেতে হয়েছিল বলছি, কারণ জনসমাগমে আমি ঠিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। তবে নিকট আত্মীয় তো, তাই না গেলে ভালো দেখায় না। বাড়ি ফিরে দেখি কাজল ধেবড়ে গেছে, খোঁপা এলিয়ে পড়েছে, পোশাক অবিন্যস্ত। আমি কিন্তু বেশ আরাম বোধ করেছি। আরও বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছি রাতপোশাকে। ওই যে বিয়ে বাড়ির সাজগোজ ওটা শৃঙ্খলা আর বাড়ি ফিরে অবিন্যস্ত সাজ বিশৃঙ্খলা। বন্যজীবন থেকে ধীরে ধীরে সভ্যতার অগ্রগতি ক্রমহ্রাসমান বিশৃঙ্খলা। আর তার বিপরীত জীবন হ'ল ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলা। বিজ্ঞানের ভাষায় increasing entropy. প্রকৃতিও অগোছালো থাকতেই বেশী ভালোবাসে। ওই যে একটু আগে বললাম মাছের কথা। তাকে সবার সাথে চলতে বাধ্য করা হ'ল শৃঙ্খলা। আর আপন খেয়ালে চলা বিশৃঙ্খলা ; আর সদাসর্বদা তাকে শৃঙ্খলায়িত করতে গেলে মহাবিশ্বকেও তটস্থ থাকতে হয়। কিন্তু মহাবিশ্বও তো অভ্যস্ত ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলায়।
"শান্তিরে ঝড় যখন হানে
শান্তি তবু চায় সে প্রাণে"
এই যে গ্রীন হাউস গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইড -যার
বাড়াবাড়িতে উত্তাপ আজ মাত্রাহীন সেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসই কিন্তু অতি শীতল পৃথিবীকে বাসোপযোগী করে তুলেছে একদা। আর এই গ্যাস যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সহায়ক সে তথ্য কে দিয়েছেন জানো? সুইডিশ বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস। তার অবদান আজও সসম্মানে স্মরণ করেন বিজ্ঞানীরা। তার নামে নামাঙ্কিত হয়েছে বহু রসায়নাগার, গ্রহদের বিভিন্ন স্থান, পর্বত, অম্ল, ক্ষার। জলবায়ুবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। বাসস্থানের সংকুলান ঘটিয়েছে এই কার্বন ডাই অক্সাইড। কিন্তু নিউক্লীয় বিভাজনের কথা তো জানোই। নিয়ন্ত্রিত বিভাজন বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আর অনিয়ন্ত্রিত বিভাজন পরমাণু বোমা। নিয়ন্ত্রণ তো মানুষের হাতে বন্ধু! কাজে কাজেই যা ছিল আশিস, তা হয়ে উঠল আশীবিষের বিষ ।
পরমাণু বিভাজনের কথায় মনে এল (যা জানানোর লোভ কিছুতেই সংবরণ করতে পারছি না)...বৃহৎ পরমাণু যেমন ভেঙ্গে ফেলে অসীম শক্তি পাওয়া যায়। তেমনি হাইড্রোজেন আর হিলিয়ামের মতো ক্ষুদ্র পরমাণু জুড়েও নির্গত হয় প্রচুর শক্তি। যাকে বলা হয় নিউক্লীয় সংযোজন। সূর্য এবং আরও আরও নক্ষত্রের জ্বালানি এই হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম। এ-ও এক অপ্রত্যাবর্তক প্রক্রিয়া। ধাবমান ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলার দিকে। আর ঈশ্বরের কী অপূর্ব লীলা দেখো--এই সংযোজনের পূর্বে ভাঙ্গন অতি জরুরী। সংযোজনের শক্তি জোগায় এই বিভাজন।
ভাবনা বা দুশ্চিন্তা ততক্ষণ ক্ষীণ, অবনতি বা ভাঙ্গন যতক্ষণ বহিরঙ্গে ক্রিয়াশীল। কিন্তু সেই অতি- পরিবাহিতা (super conductivity) কখন সম্ভব, যাতে পরিবাহীর অভ্যন্তর চৌম্বক প্রবাহ (magnetic flux) মুক্ত থাকবে? সে ক্ষেত্রেও কিছু নির্দিষ্ট শর্ত, যথার্থ অনুঘটক কিংবা প্রভাবকের প্রয়োজন। আর ভাঙ্গন যখন অন্তর অঙ্গে দারুণভাবে অন্তঃরঙ্গ? তখন ভঙ্গুর, খণ্ডিত, সম্বন্ধবিহীন অংশগুলো অপসারীই হয়।(নিউক্লীয় বিভাজনের ক্ষেত্রে নিস্তড়িৎ নিউট্রন এবং অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র পরমাণুরা যেমন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে) তাদের অভিসারী করা সম্ভবপর হয় ধ্বংসের পরে। অস্মিতা তখনও বোধের বাইরে নয়। সেই অহমিকা বা তীব্র অহং-বোধ বর্জিত না হ'লে ক্ষুদ্রতম কণিকারা পরস্পর যুক্ত হয় না (নিউক্লীয় সংযোজনে যেমনটি হয়), আর এই অকপট, সহজ, সরল কণিকারাই দল বেঁধে নব নব সৃষ্টিতে অংশ নেয়। এই ভাঙ্গন বা বিভাজনই তাদের উদ্বুদ্ধ করে জোটবদ্ধ হ'তে। ধীরে ধীরে বিগ ব্যাং থেকে আবার অগ্রসর হয় বিগ ক্রাঞ্চের দিকে। এই সংকোচন বা বিগ ক্রাঞ্চই হয় তো "নিয়তি"... প্রতিটি সভ্যতা ফুলেফেঁপে ওঠার পর অবশ্যম্ভাবী এই নিয়তির দিকে এগিয়ে যায়। যেখানে স্কেলফ্যাক্টর শূন্য। সংস্কার বা modification বলতে এই শূন্যে পৌঁছে যাওয়াই হয় তো মূলকথা। সব ক্ষেত্রেই বুঝি এই শূন্যে পৌঁছানো আবশ্যক। ঢেলে ঘুঁটি সাজানো যাকে বলে। যা অবশ্যম্ভাবী, যাকে কখনই অস্বীকার করা যায় না।
ধ্বংসপ্রাপ্ত বহু সভ্যতার ক্ষেত্রেই দেখা যায় ধ্বংসের মূল কারণ নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে তীব্র অনীহা বা তীব্র রক্ষণশীলতা। উন্নতির শিখরে আরোহণ করার পর স্থবিরতা গ্রাস করে তাদের। প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনে ধীরে ধীরে নেমে আসে অবক্ষয়। আর এই অবক্ষয়ে ক্লান্ত দেশবাসী উন্নত জীবনের তাগিদে নিজস্ব ভূমি ত্যাগ করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। পেছনে পড়ে থাকে পরিত্যক্ত, শূন্য জনপদ নতুন আশায় বুক বেঁধে। আবার এক নতুন বিস্ফোরণের প্রত্যাশায়। এই সাদৃশ্য সবকালে, সবযুগে এবং আজও অব্যাহত....
ভালো থেকো বন্ধু। তোমাদের মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴