সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
08-January,2023 - Sunday ✍️ By- বিমল দেবনাথ 418

সময়ও ডাকে…

সময়ও ডাকে…   
বিমল দেবনাথ   
############

পাহাড়ে কোথাও তুষারপাত হয়েছে। চালসাতেও কনকনে ঠান্ডা। অলস রাতে বৃষ্টি হয়েছিলো অল্প। ঘরের টিনের চালে শব্দ হয়েছিল। সুমি বিহার থেকে আসা ধুনি থেকে সদ্য বানানো লেপ ভালো করে টেনে-গুঁজে ভাঙ্গা ঘুম জোড়া লাগানোর চেষ্টা করে। শরভ সারারাত ছটফট করেছে। ও আগে এরকম ছিলনা। একবার শুলে মাটি। বিছানায় এক জন ছটফট করলে আর একজনের কি ঘুম আসে?  অন্ধকারে বোঝাও মুশকিল ঘুমের ঘোরে না জেগে ছটফট করে। প্রশ্ন করলে আরও বিপত্তি। আবার ঘুমোতে যাবার আগে চোখ খুললে সুমির বিরক্তির বাঁধ ভেঙ্গে যায়।      
কী হলো। সবে তো পাঁচটা বাজে। এই ঠান্ডায় এখনই উঠছ কেন? জানালার ফাঁক দিয়ে কেমন শিনশিন করে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে। মনে হয় বাইরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। কেমন যে বাড়ি বানিয়েছ। কয় মাসেই জানালার পাল্লা ফাঁক।   
এখন আর তেমন ম্যাচিউরড কাঠ আর কোথায় পাওয়া যায়… তুমি ঘুমাও। এই বলে শরভ বিছানা ছাড়ে, রুম ছাড়ে।        
একটা পাতিলেবু আধা কেটে নিয়ে গরম জলে মধু সহ মিশিয়ে খায়। দরজা টেনে বেরিয়ে পড়ে। বাইরে বেশ কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। কুয়াশা পড়েছে ঘন। শরভ গ্রামের শেষ প্রান্ত থেকে মুড়ে দেখে অশোকনগর। পুরো গ্রাম দেখা যায়না। কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে। হাওয়ায় চাদর ছিঁড়ে গেলে দেখা যায় ঘরের চাল আর গাছের মাথা। গ্রামের নামটি মনে হলেই শরভের মনে পড়ে কতগুলো কাটা গাছের কথা । কাটা গাছ মনে শিকড় ছড়িয়েছে  বাবার মুখ থেকে নগর পত্তনের কথা শুনে আর নগরের ইতিহাস পড়ে। রিফিউজি বাবা অবনী নাকি বলে ছিলো, “এত ফাঁকা জায়গা থাকতে বন কেটে বসতি কেন?” রোষানলে পড়েছিল অবনী । খড়কুটোর মত উড়ে গেছিলো সেদিন এক ছেলে ও বউ নিয়ে। কপাল জোরে মারা পড়েনি। হাতিডোবা জঙ্গল মহল থেকে পালিয়ে এসেছিলো পাথর-বালির এই ভূমিতে। মাস্টারদাকে আশ্রয় দিয়েছিলো তার আগে আসা আর এক রিফিউজি, যার নামে ভয় তার নামের অশোক-নগরে। ওপার বাংলার নামী মাষ্টার এপার বাংলার রিফিউজি। অবনী নিজের নেশায় পেটে ভাতে পড়াতে শুরু করে কলোনির ছেলে মেয়েদের। সেই ঘর সেই মাটি এখন সরকারি স্কুল। সেই স্কুল এখন পূর্ণ কলেবরে। বাবা চির শীত ঘুমে।               
শরভের দীর্ঘ শ্বাসে বেরিয়ে আসে যেন এক রাশ ধোঁয়া। শরভ হাঁটে, ওর সঙ্গে স্মৃতি হাঁটে পোষা কুকুরের মতো। কুয়াশা চিরে গেলে দেখে এখনো বেঁচে থাকা “মহাবাড়ির” সেগুন বন। অথচ ওর চোখের সামনে চলে গেছে চা বাগানের কত শাল বন। যা ছিল চা বাগানের জন্য পরিবর্তীত বনভূমির বন্যপ্রাণীদের আশ্রয় স্থল। কত দামী গাছ চলে গেছে বন থেকে, বনকে পাতলা করে। বাবার মতো প্রতিবাদ করতে পারেনি এতটুকুও। কলেজের সবল প্রতিবাদী হাত বন্ধক দিয়েছিল চাকরিতে-সরকারি নিয়মে। ততদিনে নিয়ম ভেঙ্গে বাবার বসত বাড়ি ঘিরে গড়ে উঠেছে ঘিঞ্জি গ্রাম। জায়গা থেকে জনবল বেশি হলে কি মাটির বল থাকে?  ইট পাথরের জঙ্গল হয়ে ওঠে। শরভের হই-হট্টগোল ভালো লাগেনা। বাবার বসত ভিটে বিক্রি করে বানিয়েছে নিজের বাড়ি। মাস ছয় আগে। গ্রামের শেষ প্রান্তে পুবের মহাবাড়ি সেগুন বনের দিকে মুখ করে। দুই কামরার বাড়ির বড় লিভিং রুম। সেখানে বানিয়েছে ছোটখাটো লাইব্রেরী। বাবার বইয়ের সঙ্গে রেখেছে নিজের বই। সব হারিয়ে পেয়েছে একটু ফাঁকা জায়গা আর মুক্ত বাতাস। তবে চালসার অন্য জায়গা থেকে ঠান্ডা বেশি। তাই শীতেও সুমির মাথা গরম।  
কুয়াশা ঠেলে চাঁদের মতো সূর্য উঠেছে কলাগাছের মাথায়। সুমি তখনো বিছানা ছেড়ে ওঠেনি। ওর যে আজকাল আর তাড়া নেই। মেয়ে এম এন সি তে কাজ করে। শরভেরও আর অফিস নেই। হাসি মাসি এসে ঘর-দোর পুঁছে বাসন মেজে চলে গেছে। রান্না ঘরটা এখনো রেখেছে নিজের কাছে। শরভ ফিরে এসে দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধোয়। লাল চা করে খায় এক কাপ। বাথরুমে ঢোকে। জল বন্ধ করে বলে  
দেখতো কার ফোন এলো।    
সুমির কাছ থেকে কোন শব্দ পায় না শরভ। আবার জল পড়ে। শোনা যায় শরভের বেসুরো গলার গান। সাড়ে তিন দশকের অভ্যাস একটুকুও বাদলায়নি। আবার  জলের শব্দ বন্ধ হয়  
কী গো, কার ফোন এলো?        
সুমির কাছ থেকে কোন শব্দ আসেনা। আবার শোনা যায় জলের শব্দ। স্নানটা বরাবর শরভ সময় নিয়ে করে। আবার জলের শব্দ বন্ধ হয়। শরভ বলে
ফোনটা বার বার বেজে গেল, ধরলেনা!     
জলের আর শব্দ হয়না। সুমি ভাবে ওকি সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছিলো? সবেতো সাতটা বাজে। সুমি বাধ্য হয়ে উঠে পড়ে। লিভিং রুমে পড়ার টেবিলে মোবাইল ফোনটা ফুল চার্জ হয়ে পড়ে আছে চার্জার সহ। মোবাইল খুলে সুমি দেখে একটাও মিসড কল নেই। সুমির দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে ওঠে। মনে হলো এক মেঘ কুয়াশা হু হু করে ঢুকে পড়লো খোলা দরজা দিয়ে।  বসে পড়ে সোফাতে। স্ত্রীহীন শরভের বাবাও এই রকম করতো। বলতো – বউমা শুনতে পাচ্ছ স্কুলের ঘণ্টা বেজে গেল। বড্ড দেরি হয়ে গেল… কোথায় কী ঘণ্টা। কিছুই শোনা যেত না। উনি শুধু শুধু ছটফট করতেন। তারপর আস্তে আস্তে… সুমি শিউরে ওঠে। ভাবে, শেষে কী শ্বশুর মশাইয়ের মতো ও ও… চোখের কোণ ভিজে ওঠে সুমির। ঘর মৌ মৌ করে ওঠে আফটার সেভ লোশনের পুরুষ গন্ধে। সুমি আঁচলের কোণ কামড়ে ধরে ঢুকে যায় রান্না ঘরে। ঘর বসানোর পর থেকে ও জানে সকাল সাতটা থেকে আটার মধ্যে শরভের আর এক কাপ চা চাই খবরের কাগজ  আর মোবাইল পড়ার সময়।  শরভ বলতো- আমাদের কাজে, সকালে ভালো খবর থেকে খারাপ খবর বেশি আসে। রাতের অন্ধকারে কোথায় যে কী ঘটে থাকে! তাই সকাল সকাল রেডি হতে হয়, সারা দিনের জন্য।       
শরভ সোফায় বসে। মোবাইলে অফিসিয়াল গ্রুপগুলো সার্চ করে। নতুন কোন খবর আর নেই। উসখুস করে। নিজেই একত্রিশ তারিখ রাতে অফিসের সব গ্রুপ থেকে একজিট করেছে। তবু কে যেন বার বার ডাকে। শরভ জানে এই ডাকে কিছু পাওয়ার নেই। এই ডাক সমুদ্রের আণ্ডার কারেন্টের মতো। টেনে নিয়ে যেতে পারে বিষাদের অতল তলে। শরভ কান বন্ধ করলেও মন বন্ধ করতে পারেনা।  
সুমি চা রাখে টি টেবিলে। সোফায় বসে বলে 
তোমার আজকাল কী হয়েছে জানিনা। শুধু ছটফট কর। ভালো করে ঘুমাতে পারিনা। কেন ওরকম কর? বাবার অবসরের সময় মা সঙ্গে ছিলেন না। আমি তো তোমার সঙ্গে আছি। আমাকে তো বলতে পার -তোমার কী হয়েছে।     
শরভ সুমির চোখে চোখ রাখে। সুমিও অনিমিখ তাকিয়ে আছে শরভের দিকে। শরভ কিছু বলতে পারেনা। অবসরের অফুরন্ত সময় ওকে সব সময় ডাকে। হঠাৎ ফাঁকা মাঠ হয়ে যাওয়া মনের ভিতরে কত কথা ঘরবাড়ি বানাতে চায়। সময় মাটি কাটার মতো মন কাটে। শরভ ভিতরে ভিতরে ছটফট করে। মধ্য পঞ্চাশের সুমি  কিশোরীর মতো চঞ্চল হয়ে ওঠে। শরভের শরীর ঘেঁষে বসে। বলে     
মনে আছে তোমার সেই গয়ানাথ বিদ্যাপীঠের কথা। সেই কৃষ্ণচূড়া গাছ। আমি বলতাম – আমি যতক্ষণ স্কুলের গেট পার হবো না, তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। আর তুমি তাই করতে। কী সেই ডাক! পরে টানা ছয় বছর সকাল ঠিক দশটার সময় দাঁড়িয়ে থাকতে সেই গাছের নিচে।      
সূর্যের নরম আলো পর্দা গলে পড়েছে সুমির গালে। বসন্ত বাতাস যেন লেগে যায় সুমির চোখে, মুখে। বসন্ত যে বয়স মানেনা। সুমি কৃষ্ণচূড়ার ফুলের মতো মিটিমিটি দেখে শরভকে। মন ডাকে মনকে। শরভ আবার ডাক শোনে। হাতে হাত ধরে হাঁটতে চায় ফাঁকা সবুজ মাঠে। খেলতে চায়, যে খেলা এখনো বাকি আছে খেলতে। দেখতে চায় সব কিছু যা দেখা হয়নি চার পা এক সঙ্গে ফেলে।  সময় যেন  ডাকে আয় আয়…    

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri