সময় তোমাকে/তপতী বাগচী
সময় তোমাকে
তপতী বাগচী
ও আমার প্রীতিভাজনেষু সময়,
অবশেষে তোমাকেই চিঠি লিখব বলে স্থির করলাম। চিঠি আজকাল আর লিখি কোথায়? রাস্তার পাশে এক বুক অপেক্ষা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কালো শিরস্ত্রাণে ঢাকা লাল ডাকবাক্স দেখলে হু হু বাতাসে উড়ে আসে বেশুমার স্মৃতিকণা। এখন অন্তরীক্ষ জুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে খামহীন খোলা অক্ষর। বুকের ভিতর গুঁজে রাখা গোপন হাতচিঠির মরসুমও তুমিই কেড়েছ সময়। মৃত মানুষের দেরাজ খুলে আবিস্কৃত তাড়া তাড়া চিঠিতে কত মান-অভিমান … কত না উত্তর না জানা প্রশ্নের উত্তর! আর কোনো পত্র-সাহিত্যও তো তুমি পাবে না গো সময়। চিঠিপত্রের পারলৌকিক ক্রিয়াদি তুমি সুসম্পন্ন করে ফেলেছো ।
তবু তোমায় লিখছি আমি। শোনো, তোমার কি ঘোর মানসিক সমস্যা চলছে এখন? থামাতে পারছ না তোমার আমিত্বের আস্ফালন। নামাতে পারছোনা তোমার তীব্র ক্রোধের ফণা।ভটানা চলছে তোমার যন্ত্রণার হাপুনাচ, সর্বাঙ্গে তোমার অজস্র জিজ্ঞাসাচিহ্ন বিঁধে বিঁধে আছে, বিভিন্ন বিন্যাসে।সেগুলোই এখন লক্ষণ তোমার, ইশারাও ।
আমি তোমারই সন্ততি। তোমার ইন্ধন। তোমারই হাতে গুঁড়ো হয়ে যাই,ফের গড়ে উঠি। তোমাকে বিশ্বাস করি। তোমাকেই ব্যক্ত করতে চাই। তবু তোমাকে চিনি না । তোমার ছবি আঁকতে যাই, বুঝি না তোমার কত রকম মুখ। ছুঁতে পারি না তোমায়। তোমার কত রকম প্রতিবিম্ব? চিরকালের তুমি, নাকি সমকালের তুমি- কে সত্যি? তোমার বাইরের উল্লাস, নাকি অন্তরের বিষাদ - কোথায় রইব কান পেতে? তুমি যে আবার আমার আগ্রহেরও মালিক। তাহলে আমি এত অক্ষম! সময়শাসিত বলে কোনো প্রতিস্বর লিখব না ! তুমি প্রাতিষ্ঠানিক বলে আমি অপ্রাতিষ্ঠানিক বলবনা ! তুমি খরস্রোতে বয়ে যাও,আমি তোমার পেটের ভিতর সুড়ঙ্গ-সম্ভব এলাকা খুঁজে নিই। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক এমনই অমোঘ-জটিল ।
ইতিহাস, যা তোমারই এক অঙ্গ, আজকাল তাকেই নাকি অস্বীকার করছ তুমি? নতুন করে তৈরী করে নিচ্ছ “সত্য”। তোমার চারদিকে থই-থই করছে অফুরন্ত সম্মোহক ইথার। তুমি ভেসে আছ এক ছদ্মবাস্তবের কোলে। একদিক উথলে উঠেছে প্রলোভনের চতুর হাতছানিতে, অন্যদিকে ছড়ানো হচ্ছে গোঁড়ামি, ভন্ডামি আর কুসংস্কার। কত যে অন্ধবিন্দু আলো দেখেনি এখনো, কত কত কাটাজিভ নেচে বেড়াচ্ছে, বাস্তু থেকে উৎখাত হয়ে কত মানুষ ভেসে যাচ্ছে অন্ধকারে! আর, তুমি! বসতি গড়েছ ‘সোস্যাল মিডিয়া’ নামক হৈ হৈ হট্টমেলায়।
শেষ অব্দি তবে কী তোমার ধর্ম? তোমার সভ্যতা কী? দর্শন? হয়তো এ জিজ্ঞাসার কোনো নিরসন নেই। তবু খোঁজ জারি রাখব আমি। কারণ যে তোমাকে পাঠ করতে চায়, দিবারাত খুঁজে বেড়ায় তোমার উচ্চারণ, বুঝতে চায় তোমার অকথিত সংলাপ, মুগ্ধতায়- বিস্ময়ে-যন্ত্রণায় অন্তর থেকে ব্যক্ত করে তোমার কথামালা, সে আমি। তোমাকে খুঁজতে গিয়ে, বুঝতে গিয়ে দ্যাখো কত না শিল্প রচনা করে গেছি আমি।ছবিতে ভাস্কর্যে সাহিত্যে আমি তোমাকে প্রশ্নই করে গেছি অনিবার। শুরুর সেই মহাপর্ব্ব থেকে আজ পর্যন্ত কোথায় রাখলে তোমার শাঁস? কার কাছে তোমার বিশ্বস্ততা ? আমাদের এই জল মাটির মায়া ভরা মায়াবসতি কেন ভেঙে দাও বারবার?
সব রহস্য ছিঁড়ে সামনে এসে দাঁড়াও। তোমার মুখ দেখি। তোমার দু’পায়ে অর্পণ করি আমার চিন্তা, বোধি, সংবেদন। আর বিভ্রান্ত করোনা আমায়। ভুল পথে নিয়ো না। আমার ভিতর সেই চেতনা জাগাও, যা আমাকে অন্ধকারেও মাথা উঁচু করে হাঁটতে সাহস যোগাবে। এইটুকু অনুরোধ।
বেশী আর কি লিখব? চিঠির উত্তর তাড়াতাড়ি দিয়ো। নীরব থেকো না। বড় চিন্তা হয়।
তোমার সর্বাঙ্গীণ কুশল কামনা করি।
ইতি
তোমারই ক্রীড়নক
বিস্মিত একাকী মানব
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴