সম্ভবামি যুগে যুগে/ভাস্বতী শ্যাম চৌধুরী
সম্ভবামি যুগে যুগে
ভাস্বতী শ্যাম চৌধুরী
যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাবের বহু পূর্বে প্রভু যীশু ধরা ধামে অবতীর্ণ হন।
সময়ের ব্যবধান হলেও এঁরা দুজনই ছিলেন ঈশ্বরের অবতার। কুমারী মেরির সন্তান বলে যীশুকে খ্রিস্টানগণ '"ঈশ্বর পুত্র'" বলে অভিহিত করেন। ঈশ্বরকে তাঁরা বলেন " স্বর্গস্থ পিতা"। যীশু নিজেও নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র বলেই ঘোষনা করেছেন "আমি এবং আমার স্বর্গস্থ পিতা এক।" উদার হিন্দুরা মনে করেন যীশু ভগবানেরই অন্যতম অবতার। শ্রীরামকৃষ্ণও সাধনার দ্বারা প্রত্যক্ষ করেন যিশু যথার্থই একজন ঈশ্বরের অবতার।গীতায় বলা হয়েছে যুগ প্রয়োজনে ভগবান ধর্মস্থাপনের জন্য মানবদেহ ধারণ করেন। সকল অবতারের ক্ষেত্রেই তাদের উপদেশ গুলির মধ্যে যেমন তৎকালিন একটা বিশেষ প্রয়োজন ও গুরুত্ব থাকে, তেমনি তাদের উপদেশের মধ্যে চিরন্তন ও সর্বজনীন গ্রহণীয় মূল্য এবং প্রেরণা থাকে, কারণ ঈশ্বর এক তাঁর বাণীও এক। শ্রীরামকৃষ্ণ, ও প্রভু যীশু দুজনেরই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আর্ত, অসহায়, দুর্গত মানুষের পরিত্রাণ সাধন। ওনারা ছিলেন ত্যাগের মূর্ত বিগ্রহস্বরূপ l
শ্রী রামকৃষ্ণ হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, শাক্ত, বৈষ্ণব বেদান্ত ইত্যাদি সব পথেই সাধনা করেছিলেন। উনি বোঝাতে চেয়েছিলেন সব ধর্মই এক, শুধু পথ আলাদা। সম্ভবত ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে শ্রী রামকৃষ্ণ খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে আগ্রহী হয়েছিলেন। তখন দক্ষিণেশ্বরে জনৈক ভক্ত শ্রীরামকৃষ্ণকে বাংলা ভাষায় বাইবেলের ব্যাখ্যা শোনাতেন। এর মধ্যে একদিন উনি দক্ষিণেশ্বরে তাঁর ভক্ত যদু মল্লিকের বাগান বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তাদের বৈঠকখানা ঘরের দেয়ালে মাদার মেরির কোলে যীশুর চিত্র দেখে তিনি ধ্যানে তন্ময় হয়ে যান, এবং অকস্মাৎ চিত্রটিকে জীবন্ত ও জ্যোতির্ময় রূপে প্রত্যক্ষ করে ভাব সমাধিতে চলে যান। এই দিব্য অনুভূতিতে তিনি তিন দিন অতিবাহিত করেন। চতুর্থ দিনে দক্ষিণেশ্বরের উদ্যানে তিনি দেখতে পান এক সৌম্যকান্তি পুরুষ তাঁর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তরে তৎকক্ষনাৎ ধ্বনিত হয় "ঈশামসি" প্রভু যীশু শ্রীরামকৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে তাঁর শরীরে বিলীন হয়ে যান। শ্রীরামকৃষ্ণ গভীর সমধিতে মগ্ন হয়ে যান এবং তখনই তাঁর খ্রিস্ট ধর্মের সাধনা সমাপ্ত হয়। এইরূপে অপর ধর্ম সাধনা করেই শ্রীরামকৃষ্ণ ঘোষণা করেন "যত মত তত পথ"!
পরবর্তীকালে অনেক খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরাও শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে যীশুকে প্রত্যক্ষ করেন যেমন বিখ্যাত পাশ্চাত্য মনীষী ও লেখক রোমাঁ রোলাঁ তাঁর রচিত "রামকৃষ্ণের জীবন"গ্রন্থে রামকৃষ্ণকে যীশুর কনিষ্ঠভ্রাতা বলে অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন । খ্রিস্টান ভক্ত উইলিয়ামস্ দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে এসে মুগ্ধ হয়েছিলেন, তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের ভিতরে যীশুকে প্রত্যক্ষ করেন। কলকাতা মেডিকেল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ডাঃ কোটস্ ঠাকুরের চিকিৎসা করতে এসে বলেন,"আজ আমি সাক্ষাৎ প্রভু ঈশামসিকে প্রত্যক্ষ করলাম।" আরো বলেছিলেন তিনি পারিশ্রমিক নিয়ে হাত কলুষিত করতে চান না। তার প্রাপ্য অর্থ ঠাকুরের সেবায় উৎসর্গ করেছিলেন। এইভাবেই অনেকেই শ্রীরামকৃষ্ণ ও প্রভু যীশু যে একই সত্তা তা অনুভব করেছিলেন। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃতের চতুর্থ অধ্যায় খ্রিস্ট ধর্ম, রামকৃষ্ণ ভাবাদর্শ এবং , বেদান্তের তুলনামূলক আলোচনা বর্ণিত হয়েছে।
প্রভু যীশু ও শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে অনেক দিক থেকে মিল পাওয়া যায়। প্রভু যীশু তাঁর ধর্ম আন্দোলনের জন্য ১২ জন পার্ষদকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর ভাব আন্দোলনের জন্য ১৬ জন পার্ষদকে সাথে করে এনেছিলেন। তাদের মধ্যে সারদানন্দ (শরৎ ) মহারাজ ও রামকৃষ্ণানন্দ (শশী) মহারাজকে ঠাকুর ঋষি কৃষ্ণ অর্থাৎ যীশু খ্রিস্টের দলের লোক বলে অভিহিত করেন । এনার দুই ভাই ছিলেন।
পরবর্তীতে দেখা যায় এনারা দুজনই যীশু অনুরাগী ছিলেন। সারদানন্দ মহারাজ লন্ডনে 'সেন্ট পিটার' গির্জায় গিয়ে সেন্ট পিটারের মূর্তি দেখে সমাধিস্থ হয়ে যান। রামকৃষ্ণানন্দ মহারাজ এত ভালো বাইবেলের ব্যাখ্যা করতেন যে খ্রিস্টান পাদ্রীরাও তা শুনে মুগ্ধ হয়ে যেতেন।
প্রভু যীশু নারীকে সম্মান দেখাতে বলেছিলেন। তাদের প্রতি কুদৃষ্টি দিলেই ব্যভিচারের অপরাধ হয়। ঠাকুর বলেছিলেন নারীকে মাতৃজ্ঞান করতে। ঠাকুর এবং যীশু দুজনই শত্রু এবং মিত্র সবাইকে ভালোবাসতে বলেছেন। কারণ সকলের মধ্যেই ভগবান আছেন। মানব কল্যাণের জন্য প্রভু যীশু ক্রুশ বিদ্ধ হয়েছিলেন।
ঠাকুরও মানব কল্যাণের জন্যই স্বেচ্ছায় গলায় রোগ ধারণ করেছিলেন , তিনি রোগসজ্জায় তাঁর পার্ষদদের একত্র করে,তাঁর ভাব আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।
যীশু খ্রিস্ট সঙ্গে রামকৃষ্ণ সংঘের আধ্যাত্মিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ১৮৮৬ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ অপ্রকট হবার কিছুদিন পরে নরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে আট জন রামকৃষ্ণ পার্ষদ আটপুরে প্রেমানন্দ মহারাজের বাড়িতে এক শীতের রাতে ত্যাগব্রতে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য ধুনি প্রজ্বলিত করেছিলেন । নরেন্দ্রনাথ তেজোদীপ্ত ভাষায় তাঁরগুরু ভ্রাতাদের সঙ্গে যীশুর মহান জীবন কথা আলোচনা করে, খ্রিস্টের ন্যায় মানব কল্যাণে প্রাণ উৎসর্গ করতে তাঁদের প্রবুদ্ধ করেছিলেন। পরে জানতে পারা যায় সেই দিনটি ছিল ২৪ শে ডিসেম্বর " ক্রিসমাস ইভ" যীশুখ্রিস্টের জন্মের প্রাকলগ্ন। এইরূপে রামকৃষ্ণ সংঘের সূচনা কাল হতেই ঈশ্বরাবতার রূপে যীশু সন্মানিত ও পুজিত হয়ে আসছেন। রামকৃষ্ণ সংঘের সন্ন্যাসীবৃন্দ আধ্যাত্মিক তত্ত্ব ব্যাখ্যা কালে যীশু খ্রিস্টের উপদেশ ব্যবহার করেন এবং খ্রিস্টের বাণীর সঙ্গে ভারতের সনাতন ধর্মের সত্যদ্রষ্টা ঋষিদের বাণীর সাদৃশ্য দেখতে পান। ভারতে ও ভারতের বাইরে অবস্থিত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের শাখা কেন্দ্রে খ্রিস্টের জন্ম উৎসব খুব সুন্দর ভাবে পালিত হয়।তাই বলা যায় রামকৃষ্ণ সংঘের সঙ্গে যীশু ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ,কারণ তাদের পথ ভিন্ন হলেও মত এক। এইরূপেই ভিন্ন ভিন্ন মত নিয়ে অবতার পুরুষেরা -
"ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে"।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴