সম্পূর্ণতার খোঁজে/সৌরভ দত্ত
সম্পূর্ণতার খোঁজে
সৌরভ দত্ত
তুমি ঢেউ খেলানো টিনের চালে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনেছো? কী সেই ঝংকার! ঝনঝন ঝনঝন! অনর্গল! সরল রৈখিক শব্দ তরঙ্গ অবিরত! শোনোনি তুমি? কোনোদিনই শোনোনি? তাহলে তোমার জীবন অসম্পূর্ণ।
ও আচ্ছা, তুমি ছাদ পেটানো বাড়িতে থাকো? বা তোমার ছাদের ওপরের দিকটি তোমার ঘরের ওপর তলের মেঝে? সেই ওপর তলের যে ঘর, তার ওপরে আরেকটি তল, তার ওপরে..! মানে, তুমি আগাগোড়াই বহুতলের বাসিন্দা? তোমার জীবন কিন্তু সত্যি সত্যিই অসম্পূর্ণ।
তুমি কখনো এমন বাড়িতে থেকেছো বা এখনো থাকো যে বাড়িতে উঠোন আছে? আছে? তাহলে তো ঐ উঠোনের এককোণে তুলসীতলা আছে, সেখানে সন্ধ্যাবেলায় প্রদীপ জ্বেলে পুজো দেয়া হয়। উঠোনের আরেকদিকে পাটকাঠির দেয়াল আর খড়ের ছাদের গোয়ালঘর আছে না একটি? ঐ গোয়ালঘরের মাটির মেঝে গোবর দিয়ে লেপে দেওয়া হয় নিয়ম করে, তাই তো? আর ঐ গোয়ালঘরে থাকে গাঢ় খয়েরী রঙের গরু, ওর নাম লক্ষ্মী, ঠিক না? এ বাবা! এতসব কথা সম্মতিসূচক ভঙ্গিমায় শুনে শেষে কিনা এভাবে তুমি ঘাড় নেড়ে অসম্মতির ইশারা করছো? তোমার ঘরে উঠোন নেই? উঠোনই নেই, তার আবার তুলসীতলা আর গোয়ালঘর! কী বলছো? তাহলে তো অনিবার্যভাবে তোমার জীবন অসম্পূর্ণ।
শোনো না, বলছিলাম যে, তোমার গোটা বাড়ির চত্বর জুড়ে, এই কোণ সেই কোণ মিলিয়ে, গোটা সাতেক আম গাছ, গোটা তিনেক কাঁঠাল গাছ, পাশের বাড়ি আর তোমার বাড়ির সীমানা বরাবর যে পাঁচিল তার ঠিক ওপাশটায় প্রকান্ড একখানি জাম গাছ আছে বা কখনো ছিল? আমের মরশুম জুড়ে ভিন্ন চেহারার, ভিন্ন বহিরঙ্গের কত কত আম, বলো? তবে যা-ই বলো না কেন, কিছু আমে কিন্তু পোকা থাকতো, তাই না? আমের মিষ্টতার আকর্ষণ থেকে পোকাগুলো কিছুতেই পারতো না নিজেদেরকে দূরে রাখতে। ঠুকরে ঠুকরে পোকাগুলো ঠিক ঢুকে পড়তো আমের অন্দরমহলের গভীর থেকে গভীরতর অংশে। যে গাছের আম যত বেশি মিষ্টি, সেই গাছের আমগুলোতে পোকার নজর পড়ার সম্ভাবনা তত বেশি। আর কাঁঠালের কী খবর? প্রকান্ড প্রকান্ড সব গাছ ভরে ওপরে আর হাতের একেবারে নাগালের মধ্যে শুধুই কাঁঠাল, তাই না? বাইরে বেরোলেই গাছপাকা কাঁঠালের গন্ধে একেবারে ম ম করছে চারিদিকটা, ঠিক তো? আর পাকা কাঁঠাল ভেঙে আর খেয়ে, তারপর পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট যে বিচি, তা ভালো করে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নিরামিষ সবজিতে ব্যবহার করে মা-কাকিমার রান্নার পদের কৌলিন্য বাড়ানোর অদম্য প্রয়াস নিয়ে কী বলবে তুমি? কিছু বলার নেই, শুধু একরাশ পরিতৃপ্তি! আর তোমার ঐ বাড়ির সীমানা বরাবর তারজালির ঐ পাড়ের সেই সুবিশাল জাম গাছটি? শেকড়ের ভৌগলিক অবস্থানের কারণে গাছটি পাশের বাড়ির, কিন্তু ঐ গাছ থেকে ঝরে পড়া সিংহভাগ জামের অদ্বিতীয় ঠিকানা তো তোমার বাড়িরই এলাকা, তাই তো? ঠিক বলছি তো? আর জিহ্বা নীল করে দেয়া ঐ টক-মিষ্টি জামের টানে দুপুরের নিস্তব্ধতার সুযোগকে আশ্রয় করে কাছেপিঠের বস্তির অযাচিত বাচ্চাকাচ্চাদের দিব্যি ঢুকে পড়া বাড়ির চত্বরে আর সন্তর্পনে সংগৃহীত জামগুলো থলে ভর্তি করে নিয়ে দিব্যি ওদের কারোর কারোর বসে পড়া বিকেলের সাপ্তাহিক বাজারে, বিক্রি করে একটু পয়সা উপার্জনের আশায় বা নেশায়, ঠিক না? কী? ঠিক বলছি না? কী? কী বললে? এতকিছু শুনে শেষে কিনা বলছো পুরো কল্পজগতের কাহিনী এসব? কোনোদিনই এমন আম-কাঁঠাল-জাম আবহের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা ছিল না তোমার জীবন? সত্যি বলছো তুমি? তাহলে তো তোমার জীবন আক্ষরিক অর্থেই অসম্পূর্ণ!
তুমি যদি বড়বেলার মানুষ হও, তো তোমার ভাইবোন বা ছেলেমেয়ে, আর তুমি যদি নিজেই ছোটবেলায় বিরাজ করছো, তো তুমি নিজে - হ্যাঁ তোমাকেই বলছি! হুড়মুড় করে দৌড়াদৌড়ি করে লুকোচুরি, ছোঁয়াছুঁয়ি, দাঁড়িয়াবান্দা, এগুলো খেলেছো? মনে আছে, সূর্য যখন অস্তাচলে, আকাশের পশ্চিম দিকটায় যখন চরম বৈপরীত্যের সহাবস্থানরত স্নিগ্ধ অথচ আগুনে রূপ, ঘরে ফিরে হাত-পা ধুয়ে মায়ের দেয়া হালকা কিছু খাবার খেয়ে বিছানায় দুলে দুলে পড়তে বসার পর্বের সূচনা যখন আর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই, তার আগে পরিমরি করে শেষ মুহূর্তের ছোটাছুটি চলতো না কি গোটা মাঠের ঘাষজমি জুড়ে? কোনো দল ছোঁয়াছুঁয়িতে মগ্ন; কোনো দলের একজন হঠাৎ কখনো ধাপ্পাবাজের কবলে পড়ার একরাশ আশঙ্কা নিয়ে বাকিদের খুঁজে চলেছে চাপা উত্তেজনার লুকোচুরি খেলায়; কারোর কারোর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা দাঁড়িয়াবান্দার ফন্দি ফিকির সামলাতে গিয়ে! কী? কী বললে? ও আচ্ছা! এসবের নাম পর্যন্ত কোনোদিন শোনোনি তুমি? তোমার বিকেল কেন, সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যার টুকরো টুকরো প্রাপ্ত অবসর জুড়ে শুধুই অত্যাধুনিক মুঠোফোন? পার্থিব বাকি দুনিয়া একদিকে আর তুমি দিব্যি সময় কাটাচ্ছো তোমার ঝলমলে মুঠোফোনে? হয়তো জ্ঞানের পরিধির সাপেক্ষে নিজেকে আকাশছোঁয়া সমৃদ্ধ করে চলেছো প্রতিনিয়ত, কিন্তু শুধুমাত্র মুঠোফোনের অনুগত দাস হয়ে, তাই তো? সত্যিই এরকম তোমার হালচাল? জীবনকে যাপন করার এমনই তোমার প্রাত্যাহিক অনুশীলন? আরে বলছো কী তুমি? তোমার জীবন তো তাহলে তর্কাতীতভাবে অসম্পূর্ণ!
আচ্ছা বেশ! এবার আসি হ্যাঁ-বাচক ও না-বাচক কিছু স্পষ্ট জিজ্ঞাসাবাদে। কী বলছো? অনধিকার চর্চা করছি আমি? আরে বাবা তুমি কে হে অধিকার-অনধিকার বেড়াজাল সংজ্ঞায়িত করতে? বলো দেখি এবার এক এক করে!
সাইকেল চালিয়েছো?
বিকেলে খেলার মাঠে নড়াচড়ার সাথে সাথে মাথার ওপর মশাগুলো গোষ্টীবদ্ধ হয়ে যে তোমার নড়াচড়াকেই অনুসরণ করছে, তা খেয়াল করেছো?
দলবেঁধে সাইকেল চালিয়ে কাছেপিঠেই থাকা শান্তশিষ্ট নদীতে স্নান করতে গিয়েছো?
বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল-তেল-আলু-মশলা-ডিম জোগাড় করে শীতের সন্ধ্যায় ঘরোয়া চড়ুইভাতি করেছো?
শীতের রোদেলা দুপুরে উঠোনের একদিকে মাদুর পেতে একটানা অঙ্ক অনুশীলন করেছো?
শীতের দুপুরবেলায় ঘরের কাজকর্ম সেরে মা-কাকিমাদের একসাথে বসে গল্প করতে করতে উল বুনে সোয়েটার বানানো দেখেছো?
বর্ষাকালে কাছেপিঠেই থাকা ডোবা খালবিল থেকে নাগাড়ে ব্যাঙের ডাকের গুরুগম্ভীর শব্দ শুনেছো?
রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে তোমার বাড়ির জমির ওপর দিয়ে শতসহস্র জোনাকিদেরকে অবিরত ঝিকিমিকি আলো ছড়াতে দেখেছো?
ঘাসে জড়িয়ে জাপটে থাকা লজ্জাবতী গাছের পাতা ছুঁয়ে দেখেছো যে এক নিমেষে কীরকম লাজুক ভঙ্গিতে সে গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে?
স্কুলজীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে টিফিন পিরিয়ডে নরম তুলতুলে পাউরুটি পেয়েছো স্কুল থেকে?
মাটির মেঝেতে কাঠের ছোট্ট বেঞ্চিতে বসে ক্লাস করতে করতে টিনের চালের অজস্র ফুটো দিয়ে সূর্যের রশ্মি সরলরেখায় আসতে দেখেছো?
বড় ক্লাসরুমে মাঝবরাবর চাটাইয়ের যে অস্থায়ী প্রাচীর, তার ফুটো দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে এক চোখে পাশের ক্লাসের হালহকিকত বোঝার চেষ্টা করেছো?
বলো এবার! অগুনতি জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে দিলাম! কী বুঝলে বলো! বেশিরভাগই না-বাচক উত্তর? শুধু 'না' 'না' আর 'না', আর কালেভদ্রে হঠাৎ কখনো 'হ্যাঁ'? তাহলে কিন্তু নির্ঘাত অসম্পূর্ণ তোমার জীবন!
কী মনে হলো? একেবারে একপেশে সব কথাগুলো? চাঁছাছোলা? নির্দয়তার আস্ফালন? হতে পারে! হোক! হোক না! নিজের টুকরো টুকরো অনুভূতিগুলো এক এক করে লিপিবদ্ধ করার প্রয়াস ভিন্ন আঙ্গিকে, তবু নিজেকেও বলছি তো! একটি জীবন বা একটি জীবদ্দশা মানে তো একাধিক প্রজন্মের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থেকে যাপন করা বিচিত্র এক ঘটনাবহুল জীবন। কিন্তু হলফ করে বলা কি যায়, নিজের জীবনের পরতে পরতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা অন্য যেসব প্রজন্ম, এসব অনুভূতির সরাসরি সাক্ষী তারা? নিশ্চিত নই। সম্পূর্ণতা সহজলভ্য নয়। শুধু আভিজাত্যে-প্রাচুর্যে-ঐশ্বর্যে নয় সম্পূর্ণতা। সম্পূর্ণতা মেলে প্রকৃতিকে গায়ে মেখে। সম্পূর্ণতা মেলে সরলতাকে পাথেয় করে। সম্পূর্ণতা মেলে মাটির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে। তবুও দিনশেষে মনে হবে সবাই লক্ষকোটি মাইল দূরে পড়ে আছি সম্পূর্ণতা প্রাপ্তি থেকে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴