সমরেশ মজুমদার : সাহিত্য রচনার বৈশিষ্ট্য/রাজর্ষি দত্ত
সমরেশ মজুমদার : সাহিত্য রচনার বৈশিষ্ট্য
রাজর্ষি দত্ত
গত ১০ই মার্চ ছিল কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের ৮০ তম জন্মবার্ষিকী ।‘কথাসাহিত্যিক’ এই উপাধি বোধহয় খুব বেশি লেখককে দেওয়া চলে না। এই ধারার প্রথম পথিকৃৎ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।আর এখন অবধি সেই ধারার শেষ বহনকারী উত্তরবঙ্গের গর্ব সমরেশ মজুমদার।
আমাদের বঙ্গ সাহিত্যের ভাণ্ডার অফুরান। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ (বন্দ্যোপাধ্যায় ও মুখোপাধ্যায়), তারাশঙ্কর ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল মিত্র, বিমল কর, সমরেশ বসু, বনফুল, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সঞ্জীব-বুদ্ধদেব-শীর্ষেন্দু-সুনীল-শংকর, প্রফুল্ল রায় থেকে আজকের স্বপ্নময় অবধি উপন্যাস আর ছোটগল্পের যে সম্ভার রয়েছে তা বিশ্বসাহিত্যে দুর্লভ। শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথ কেন, নোবেল স্বীকৃতি পেতে পারতেন আরও অনেকেই। যেমন সতীনাথ ভাদুড়ির ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ একটি বিরলতম উপন্যাস – আঙ্গিক ও বিন্যাসের দিক থেকে।
সমরেশ মজুমদারের সাহিত্য কমলকুমার মজুমদারের মত কঠিন তৎসম শব্দের বাতাবরণে ভরপুর নয়। তিনি অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতি, পরিবেশের পাতার পর পাতা অনুপুঙ্খ বর্ণনায় পাঠকদের পাঠকদের আবিষ্ট করে রাখেন না। চরম মানসিক টানাপোড়ন, বৌদ্ধিক সূক্ষ্মতা, ভাবের বিশ্লেষণ তাঁর রচনায় তেমন একটা পাওয়া যায় না।বরঞ্চ তাঁর লেখা সাবলীলভাবে মানুষের কথা বলে। তাদের সমস্যা ও সমাধানের রাস্তা দেখায়। অতিক্রম করে যাওয়া এক জনজীবন, যা ইতিহাসে স্থান পেতে চলছে আগামীতে–তার সাক্ষরতা বহন করে।
সমরেশবাবুর লেখার অন্যতম দিক অবশ্যই উত্তরবাংলা। এখানকার মাটির গন্ধ, মানুষের সুখ-দুঃখ তাঁর অসামান্য লেখনীতে বারংবার বিধৃত। সেখানে চা বাগানের গলিপথ, হাসিমারা টু জয়গাঁ হাইওয়ে, ধুপগুড়ি স্ট্যান্ড, রূপমায়া হল, গয়েরকাটার চায়ের দোকান, হাকিমপাড়া এসবের সাথে লেখায় স্থানীয় কিছু বাস্তব চরিত্রের আমদানি ডুয়ার্সের পাঠকদের মুহূর্তে একাত্ম ও নস্টালজিক করে তোলে।
উত্তরবঙ্গের মানুষ অথচ কলকাতার নগরকেন্দ্রিক জীবনকেও সুচারুভাবে গল্পগাথায় বিধৃত করেছেন এমন উদাহরণ খুব বেশি নেই। তাঁর লেখায় আমরা প্রায়শই পাই মুল্যবোধের ঠোকাঠুকি। প্রকৃতপক্ষে উনবিংশ, বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর মানুষকে যারা খুব সামনে থেকে দেখেছেন এক দ্রুত বদলে যাওয়া সমাজের প্রেক্ষাপটে তাদের লেখায় সেই ছাপ থাকবেই। এই সমাজ বদল যেমন শহুরে আবহাওয়ায়, পাশাপাশি দেখেছেন উত্তরবাংলার গ্রাম বা মফস্বলেও-দশকের পর দশক ধরে। অর্থাৎ সাহিত্যের ক্ষেত্রটি অনেক বিস্তৃত ছিল। সময় ও জনপদের নিরিখে।সংবেদনশীলতার তাড়নায় তিনি যেমন বার বার হয়ে পড়েছেন নস্টালজিক, আবার বিষয় নির্বাচনে বৈচিত্র্য আনতে অসুবিধা হয় নি। ধর্মীয়, ঐতিহাসিক বা গবেষণামূলক উপন্যাস লেখার দিকে ঝোঁক আমরা দেখতে পাই না। সামাজিক বিষয়েই তিনি সচ্ছন্দ ছিলেন –কথাশিল্পীরা যেমন হয়ে থাকেন। সংলাপ চরিত্র অনুসারে আটপৌরে কিংবা আধুনিক। ঝরঝরে ভাষায় রয়েছে নিজস্বতা (অন্য খ্যাতিমান লেখকদের মত), কাহিনীতে রয়েছে নাটকীয়তা, মোক্ষম বাঁক – একবার শুরু করলে একদম শেষে গিয়ে থামতে হয়। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, পুরোমাত্রায় সাহিত্য চর্চার পূর্বে তিনি নাটক লিখতেন, অভিনয়ও করতেন। তাছাড়া বাংলা সিনেমার ক্রিটিক হবার সুবাদে দেখতে হত প্রচুর সিনেমাও। ফলে কাহিনীর মোচড়গুলি তাঁর করায়ত্ত ছিল। যা পরবর্তীকালে বিভিন্ন চলচ্চিত্র, বিশেষত টিভি সিরিয়ালের গল্প বা চিত্রনাট্য লেখার ক্ষেত্রেও কাজে লেগেছিল। আবার উল্টোদিক থেকে বলা যায় তাঁর যে কোন উপন্যাস সিনেমা বা সিরিয়ালের উপযোগী, যেমন শরৎচন্দ্রের।
গাব্রিয়াল মার্কেজের মত ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ তিনি লেখেননি। তাঁর লেখা প্রোগোন্যাসটিকেশন, অনটোলজি বা হেটেরোটোপিয়ায় আচ্ছন্ন নয়। একজিসটেনশিয়ালিজম বা অস্তিত্বের সংকট উঠে এসেছে...কিন্ত তা বস্তুগতভাবে, ভাবের প্রাধান্য তুলনামুলকভাবে কম। সত্তার যে মুল প্রশ্ন-“আমি কে?”-ঠিক এইভাবে ভাবিত করে না। দার্শনিকতা আছে...হঠাৎ এক একটি লাইন বা অনুচ্ছেদ যেন দমকা হাওয়ার মত ভেসে আসে, বইয়ের পাতাগুলি উল্টে পাঠকের মনোজগৎটাকে বেশ কিছুটা এগিয়ে দেয়। এছাড়া সমরেশবাবুর লেখা বড় বেশি স্পষ্ট, সোজাসাপটা – কিন্ত তাই বলে সস্তা বলা যাবে না কোনমতেই।
প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাংরী জেনারেশন, যারা সমাজের নিম্ন সম্প্রদায়ের কুৎসিত জীবন সাহিত্যে এনেছেন, অশ্লীল শব্দ ও ভাষার উদ্ধত্যের প্রয়োগে, সমরেশ মজুমদার সে পথ মাড়াননি কোনদিন। তাঁর মনে হয়েছে এটা আরোপিত! আবার চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের লেখকদের রচনায় (তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন যাই হোক না কেন) বিধবাদের মত অতি শুদ্ধতা ছিল তাঁর না-পসন্দ।
সেযুগের লেখক কবি বা শিল্পীরা কমবেশি বামপন্থী ভাবধারায় সামিল হয়েছিলেন। সমরেশ মজুমদার তাঁর ব্যতিক্রম নন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন মহৎ সাহিত্যকে কোন ‘ইজম’-এর গণ্ডীতে বাঁধা যায় না। সেক্ষেত্রে এইসব আদর্শ আর মৌলবাদে তেমন একটা তফাৎ নেই। অর্থাৎ একটি সংগঠিত ধর্ম যা করে, যার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ আত্ম-প্রচার ও সংখ্যা অর্জন...অতএব এটি অবশ্যই সৎ সাহিত্যের পরিপন্থী।
আসলে মানুষটিও ছিলেন স্পষ্টবাদী। তাঁর অসামান্য সাহিত্য প্রতিভার সাথে মিশেল ঘটেছিল অনেকগুলি গুণের।আর একটা হচ্ছে অফুরন্ত প্রানশক্তি।ভাবতে অবাক লাগে চা বাগান, জেলাশহর থেকে কলকাতার কলেজ অবধি দৌড় অনেকেরই আছে – কিন্তু সেটাই তাঁর স্টার্টিং পয়েন্ট। সৃষ্ট ‘দৌড়’ উপন্যাসের মত।এ প্রসঙ্গে এসে যায় সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার কথা এবং জহুরি সম্পাদক সাগরময় ঘোষের কথা যিনি উত্তরাধিকার, কালবেলা ও কালপুরুষের মত ট্রিলজি লিখিয়ে নিয়েছিলেন তাঁকে দিয়ে। সেসময় কলকাতায় বিভিন্ন শিল্প ও কলাক্ষেত্রে অসংখ্য গুণী মানুষের মেলা – সাহিত্যে তো বটেই। তবু সমরেশ বসু, রমাপদ চৌধুরী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এঁদের সবাইকে ছাপিয়ে মাত্র বছর চল্লিশের মধ্যে পেলেন সাহিত্য একাডেমী পুরষ্কার। ইনকাম ট্যাক্সের বাঁধা চাকরীও ছেড়ে দিয়েছেন স্রেফ সাহিত্যের টানে। এসব কোনটাই মুখের কথা নয় !
ভীষণ ডাকাবুকো ছিলেন, আবার সাধারণ মানুষের সাথে চট করে মিশে যেতে পারতেন। নির্ভেজাল আড্ডায় কাটিয়ে দিতে পারতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁদের সাথে যারা তাঁর গল্পের চরিত্র হয়ে উঠেছে যথাসময়ে। শুধু তাই নয় – তৎকালীন প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের সাথে নিয়মিত ওঠাবসার অভিজ্ঞতা বিধৃত করেছেন ‘কইতে কথা বাধে’ আখ্যানের পর্বে পর্বে।
সাহিত্যিক বিমল মিত্র একবার সাক্ষাতে সমরেশ মজুমদারকে বলেছিলেন “মানুষ গল্প পড়তে চায় – ওটা লিখতে পারলে থাকবে, নইলে নয়।”
এই থেকে যাওয়াটা একটা বড় ব্যাপার। কাল বড়ই নির্মোহ ! প্রাক্ স্বাধীনতা ও পরবর্তী অধ্যায়ে কালজয়ী উপন্যাস বলতে যে চারটি স্তম্ভ রয়েছে (ভিন্ন মত থাকতে পারে) তা হল মানিকবাবুর ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’, তারাশঙ্করের ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’, অতীনবাবুর ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’। আর আছে মণিমুক্তোর মতো ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ছোটগল্প – যা থেকে যাবে।
সমরেশ মজুমদারও থেকে যাবেন উত্তরবঙ্গবাসীর মণিকোঠায়। সাহিত্যিক অমিয়ভূষণ, সুরজিৎ দাশগুপ্ত, দেবেশ রায়ের পর সমরেশবাবু যিনি বৃহৎ বাংলা ও বিশ্বের দরবারে উত্তরবাংলাকে তুলে ধরেছেন। নিজের মায়ের তুল্য জন্মভূমির প্রতি এই অকৃত্রিম টান ও অনুভবের প্রতিদান তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠকেরা তাঁকে ভাসিয়ে দিয়েছেন বিপুল জনপ্রিয়তার জোয়ারে! দুই বাংলায় তো বটেই –এমনকি প্রবাসেও।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴