সময়ের চিঠি অনন্যাকে/অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
সময়ের চিঠি অনন্যাকে
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
প্রিয়
অনন্যা,
তুমি খুব চেনা আমার। মনের খুব কাছের। তোমাকে কখনো দেখেছি কড়া রোদে ভিড় রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যালের অপেক্ষায়, কখনো বা গ্রাম থেকে শহরের পথে আসবার সময় সাইকেল চালিয়ে পাশ কাটিয়ে গেছ তুমি। লোকাল ট্রেনের গাদাগাদি ভিড়ে স্কুলের ব্যাগটা বুকে আঁকড়ে কেমন দুলতে দুলতে দাঁড়িয়ে থাকতে সে দৃশ্যও খুব চেনা। তোমাদের খড়ের ঘরের নিকোনো বারান্দাতে পাটি পেতে বসে তোমার সবকিছু ভুলে নিবিড় পড়াশুনো দেখেছি। পড়ার সঙ্গে সখ্যতা তোমার সেই ছোট্টটি থেকে। মায়ের হাত ধরে যেদিন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছিলে, সেদিন থেকেই সেই স্বপ্ন দেখার শুরু। তারপর শত প্রতিবন্ধকতাও রুখতে পারেনি দুর্বার সেই এগিয়ে চলাকে। তোমার একটু একটু করে বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে তোমার মেধা, তোমার প্রতিভা পাপড়ি মেলেছে সহজাতভাবে।
প্রাথমিক স্তরের পড়াশোনার পর প্রত্যন্ত ওই অঞ্চল থেকে শহরের উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিদিনের যাওয়া আসা মোটেও সহজ ছিল না।একেই তো অভাবের তাড়না। হঠাৎ কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাবার তখন অন্য চেহারা। রুজি রোজগারের সমস্ত পথ বন্ধ তখন। দীর্ঘদিনের অতিরিক্ত শ্রম বাবার শরীরে অনেক রোগেরও জন্ম দিয়েছে।গ্রামের এর ওর ক্ষেতে খামারে টুকটাক কাজ করা ঘরোয়া মাকে বাধ্য হয়ে শহরের বেশ কতগুলো বাসাবাড়িতে কাজ নিতে হয়েছে। একটু বড় হতে না হতেই সেই কোন সকালে উঠে চারটি ভাত মুখে দিয়ে মাকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে পাড়ি দিতে হতো এতটা পথ। তারপর এক জায়গায় সাইকেল জমা রেখে লোকাল ট্রেনের সওয়ারি হতে তোমরা মা মেয়ে।মা নেমে যেত বেশ কয়েকটা আগের স্টেশনে। স্কুলের শেষে প্রায় ছুটতে ছুটতে ট্রেন ধরে একইভাবে ফিরে আসা। শীতকালে সাত তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে নেমে আসা টিমটিমে আলোআঁধারি পথ বেয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে নিজের বুকের ধুকপুক নিজেই শুনতে পেতে।তার সঙ্গে সঙ্গে কানে ভেসে বেড়াতো ঠিক সেদিনকারই কোনো একটি বিষয়ের ক্লাসে নির্দিষ্ট কোনো শিক্ষয়িত্রীর কাছ থেকে পাওয়া অফুরন্ত প্রশংসার কথাগুলি। নতুন করে উজ্জীবিত তুমি আরো জোরে প্যাডেল করে পার হতে অন্ধকার সেই পথটুকু। মনে মনে শপথ দৃঢ় হতো জীবনের সমস্ত অন্ধকার থেকে উত্তরণের।
সে দিনটা খুব মনে পড়ে। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে তুমি দেখেছিলে বাড়িতে তোমাদের গ্রামের বেশ কিছু লোক এসে জড়ো হয়েছে। তোমার বাবার কাছে তারা তোমার বিয়ের কথা বলতে এসেছিল। শুধুমাত্র পড়াশোনার জন্য তোমাকে প্রতিদিন শহরে যাওয়া আসা করতে দিতে নিদারুণ ভাবে আপত্তি তুলেছিল গ্রাম্য সমাজ। অনেক সন্দেহ ও অবিশ্বাসের তীর আছড়ে পড়েছিল তোমার ওপর।শয্যাশায়ী বাবা আর মুখচোরা মায়ের ক্ষীণ প্রতিবাদ রুখতে পারছিলনা তাদের অশালীন ইঙ্গিতকে।দশভূজার মতো তুমি একাই শক্তির আধার হয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলে সেই ঘনঘোর ঘনঘটা থেকে।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়। পড়াশোনার প্রতিটি ধাপের ভালো ফলাফলের স্কলারশিপ তোমার এগিয়ে চলাকে তরান্বিত করেছিল অনিবার্য ভাবে। সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় এরপর সুযোগ্য একজন শিক্ষক হবার বাদবাকি ধাপগুলি পেরিয়ে জয়যুক্ত হয়েছিল তোমার এতদিনের বন্ধুর যাত্রাপথ। উচ্চ মাধ্যমিক একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হিসেবে তোমার নিয়োগ ছিল সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও নিষ্কলুষ নির্বাচন প্রক্রিয়ায়।
আলোঝরা দিন এসেছিল তোমাদের কুঁড়েঘরে। বাবার ঠিকঠাক চিকিৎসা,পথ্য অনায়াসসাধ্য হয়েছিল। মায়ের শ্রান্ত জীবন বিরতির পথ খুঁজে পেয়েছিল। চিন্তাগ্রস্ত, ক্ষয়াটে মুখগুলির ঠোঁটের কোণে উঁকি দিয়েছিল প্রাণভরা হাসি।
তোমাকে সেই একই পরিশ্রম করতে দেখেছি এর পরেও। সেই স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির দিনগুলোর মতোই ছিল তোমার রোজনামচার জীবন।সেই ভোর, সেই সাইকেল, সেই লোকাল ট্রেন। বাড়ি ফিরে এসে সেই বাবা আর মা।এই ক'বছরে মা বেশ কয়েকবার জোরালো ভাবে বিয়ের কথা তুললেও তুমি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছো। চাকরি পাবার পর তোমাদের গ্রামের দুএকজন পড়াশোনায় সত্যিকারের আগ্রহী ছেলেমেয়ের দিকে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছো স্বেচ্ছায়।যারা একসময় অবহেলা করেছে, করুণা করেছে এমনকি দুকথা শুনিয়েও দিয়েছে তাদের মুখগুলোও পাল্টে গিয়েছিল তোমার এই সাফল্যে।
সামান্য এ সুখটুকুও কেড়ে নিল ভয়াবহ এক খবর।এত কষ্টে, সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতার মাপকাঠিতে পাওয়া চাকরিটি খোয়াতে হলো তোমাকে আরো অনেকের সঙ্গে সঙ্গে।এক লহমায় আবার অন্ধকার নেমে এল তোমাদের ঘরে, তোমাদের জীবনে। ফিরে দেখা কোনো ভালো কিছুই তোমার মুষড়ে পড়াকে উজ্জীবিত করতে পারছেনা আর।বাবা-মায়ের যে হাসিমুখ এ ক'বছর মনকে আনন্দে ভরে রেখেছিল, ম্রিয়মান সেই মুখগুলির দিকে তাকাতে পারছো না আর তুমি। এতদিনের পরিশ্রম, যুদ্ধ সমস্ত বিফলে গেল ভেবে এমন শক্ত মনের মেয়েরও গাল বেয়ে জলের ধারা নেমে আসছে।চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাচ্ছো তোমার সামনে পরপর সমস্ত দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একে একে। ভয়ানক এক গোলকধাঁধায় হাতরে বেড়াচ্ছ বেরোনোর পথটুকু। রাতে বিরেতে এ দুর্বিষহ জীবন ছেড়ে চলে যাবার চিন্তাও ঘুরপাক খাচ্ছে সজ্ঞানে বা অজ্ঞাতসারে। সম্বিত ফিরেছে আবার বাবা মায়ের মুখের ছায়ায়।
তোমাকে সান্ত্বনা দেবার কোনো ভাষা নেই আমার কাছে। আপাদমস্তক ধুলোবালি মাখা এই আমি আজ নিজেই নিজের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। আমার গায়ে কলুষতার পুরু আস্তরণ।কারা দুর্ণীতি করলো, কারা ঘটিবাটি বেঁচে অভাবের তাড়নায় চাকরির জন্য দুর্নীতিতে সামিল হলো আবার কারা সম্পূর্ণ সৎ পথে এই পেশায় এল সবকিছুরই সাক্ষী আমি।আমি পরিস্থিতির শিকার। আমার হাত পা যেমন বাঁধা তেমনি মুখও বন্ধ রাখবার নীরব অঙ্গিকার করেছি যেন সমস্ত বিষময়তার কাছে। এখন শুধু অপেক্ষা।আলোর আর ভালোর।
এটুকুই শুধু বলতে চাই, এমন ভেঙে পড়া তোমার মতো যুদ্ধজয়ী মেয়েকে মানায়না। নিজের ভেতরের সমস্ত শক্তিকে জড়ো করে লড়াইয়ে নামো অদম্য মনোবল নিয়ে।সে পথ পিচ্ছিল হলেও ন্যায়ের পক্ষে রায় বেরোবেই একদিন এই আশাটুকু বুকে বেঁধে সামনে তাকাও। আর সকলের মতো তোমারও প্রতিটি কাজের সঙ্গী ও সাক্ষী হয়ে যেমন ছিলাম এতদিন, তেমনই থেকে যাব নীরব দর্শক হয়ে।কেউ কারো হাত ধরেনা এটা মনে রেখে জ্বলে ওঠো সাধারণ মেয়ে।নতুন স্বপ্ন,নতুন প্রত্যয়ে নতুন প্রকাশভঙ্গিতে তোমার সামনের মোকাবিলার নতুন পথে হেঁটে চলো নতুন করে নিজেকে ভালোবেসে। জেগে ওঠো আবার নতুন করে। জয় একদিন হবেই হবে....
ইতি -
সময়
তারিখ - ২৭/৪/২০২৪
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴