ইতিহাস বলে,মানুষ যত সভ্যতার দিকে এগোয় মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতাও বৃদ্ধি পেতে থাকে।
শিক্ষা চেতনার দ্বার খুলে দেয়। ফলে চেতনে ও অবচেতনে সর্বদাই চলে সৃজনের খেলা। এই পথ
অনন্ত।এইভাবে চলতে চলতে একসময় সভ্যতার
ঘরে বিপর্যয় ।অন্তত মিথ সেকথাই বলে।
একটি বাণী এখন সমাজ মাধ্যমে ঘুরছে।হ্যাঁ আমি বাণীই বলব,কারণ 5G, 6G নেটওয়ার্ক চালু হলে পাখিদের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অতএব এই প্রযুক্তিগত এই উন্নয়ন মানুষ এখন অস্বীকার করতে চাইছেন।আমিও উচ্চকণ্ঠে এই উন্নয়নের বিরোধিতা করছি।ঠিক এইপদ্ধতিতে জীবনের সর্বক্ষেত্রে মানুষের উন্নয়নের প্রতি লালসা একদিন ধ্বংসের
মুখে ফেলে!ভাবুন না আজকের নগরায়ন আমাদের
কোন্ পরিস্থিতিতে ফেলল! তাপমাত্রা বৃদ্ধি জীবনকে
অসহায় করে তুলেছে!আমাদের এত লোভ!কত পরিবেশবিদ কোন ভাবেই কিছু করতে পারলেন না!নতি স্বীকার করতেই হল সভ্যতার অগ্রগতির কাছে!
আমরা যখন সাতের দশকের শেষদিকে একটু একটু করে বড় হচ্ছিলাম,তখনকার প্রাকৃতিক পরিবেশটা একবার ভাবুন!শহর ও শহরতলীতেও বড় বড় গাছ ছায়া দিত। জলা, জংলা এদিক সেদিন।কাদা,মাটি,ঘাস ও পাতাবাহার,গন্ধপাদালি নিয়ে শাদা-কালো স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।পাখিদের ঘরে ফেরা মানুষের মত সন্ধে হলেই। আমরা মিশে থাকতাম মাঠের সঙ্গে। রেলকোয়াটার্সের পাশে একফালি জমিতেও বাবা
অফিসের দায়িত্ব পালন করেও ফলাতেন কফি,আলু
,ভেন্ডি,লঙ্কা,ধনেপাতা। এই ক' বছরে কী হল! নব্বই
দশকে আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে যেমন সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক ক্ষেত্র গুলোতে বদল আমাদের জীবনধারা এক্কেবারে
বদলে দিল! খুব বেশিকাল আগের কথা নয় কিন্তু!
চার পাঁচ বছর আগে থেকেই আমাদের অঞ্চলে একটা ছন্নছাড়া আবহওয়ার ইঙ্গিত পাচ্ছিলাম!আর এই বছরটা!শুরু থেকেই অন্য মতি! অন্য গতি!তরাই ডুয়ার্স বা শিলিগুড়ি শুকনায় এরকম আবহওয়া কল্পনা করেছি কখনও!
একটু গরম মানেই বিকেলে বৃষ্টি! ভাদ্রে তালপাকা গরম দিনদশেক পড়ত তাও বিকেলে বৃষ্টি।
চার পাঁচ মাস ধরেই প্রবল কর্মব্যস্ততায় একঘেয়েমি চলে এসেছিল।তার উপর উত্তরত্তোর উষ্ণতা বৃদ্ধির
প্রকোপ! বেরিয়ে পড়লাম।সপ্তাহান্তে শনিবার।কাছেই।যেন পাশের বাড়ি।খুব পরিচিত।প্রায় প্রত্যেকেই গেছেন দু তিনবার।আমি আসলে সারাক্ষণ একটা নির্মল সবুজের মধ্যে থাকতে চেয়েছিলাম। ঠিক যেমন সবুজ পৃথিবীতে আমাদের
বেড়ে ওঠা। সত্যি সত্যিই সেখানেই সেটা পাওয়া যায়।মিরিক জায়গাটির নাম।কি?খুব খুব চেনা,তাই না!
মূল শহরে না গিয়ে ডান দিকে স্বপ্নের মতো আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে কিছুটা ওপরে উঠলেই স্বৈরিণী চাবাগান।এমনিতেই যাঁরা গেছেন তাঁরা জানেন মিরিকের রাস্তার সৌন্দর্যের কথা! সবুজ উপত্যকার ছড়াছড়ি। ঢালে ঢালে নানানরঙা সবুজ।
যতই চেনা জানা পথ হোক না কেন আমার কাছে
এই পথ চিরনূতন! অনেকটা বাঙালির পুরী দর্শনের
মতো!এই পাহাড়ি পথের প্রতি মুগ্ধতা আমার বেড়েছে করোনার সংকটকালে!যেদিনই সরকারী ছাড়পত্র একটুখানি পেতাম চলে যেতাম ওই পথে।
সুদীর্ঘ সাপ যেন পাহাড় পেঁচাতে পেঁচাতে উঠে যাচ্ছে।সে চলা যেন শেষহীন!চারদিকে উপচে পড়া সবুজ ঢেউ যেন ভালোবেসে বলছে,'এত তাড়া কেন, ধীরে
চলো'!পথ যেন কোন্ বাঁকের আগে স্বপ্নরাজ্যে মন
হারিয়ে ফেলে।সেই লকডাউন সময়ে যানহীন দূষণহীন পথ ও সবুজের আপনমনে খেলা।প্রকৃতি
সেসময়ে ছিলো অন্য সময়ের চাইতে অনেক বেশি
উজাড় করা! সেই মুগ্ধতা আমার যেন ফুরোয় না।
সেই না ফুরনো মুগ্ধতায় আমি মশগুল!হিসেবমতো
চাবাগান আমার জন্মস্থান। কোন এক এক টিলাময়
অপরূপে আমি প্রথম জাগতিক শ্বাস নিয়েছিলাম।
দুদিন পুরো থেকে আড়াই দিনের দিন ফিরব।এমনই পরিকল্পনা ছিল।হলও তাই। আমার বসবাসের জায়গাটি ছিল পাহাড়ের কোলে একেবারে আক্ষরিক অর্থেই।পাইনের সারির আজানুলম্বিত দুই বাহুর বন্ধনে ছিল আমার দুদিনের আদুরে শরীর - মনটি।চারদিকে কাচা জংঙ্গলের প্রাণ উতলা করা মনোময় ঘ্রাণ আমাকে আকুল করে রেখেছিল।
একটি বুটিক চা রিসোর্ট।অসাধারণ রুচিসম্পন্ন সাজগোজ তার অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গে। আমি লুটেপুটে
নিয়ে একেবারে চেটেপুটে খেয়েছি আমাকে ঘিরে
থাকা অদ্ভুত সবুজগুলোকে!রাতের অন্ধকার পাহাড় ছুঁয়ে দেখলাম।স্পর্শ মাত্রেই বুকে কাঁপন লাগে! সঙ্গে থাকে পাহাড়িয়া রাতপোকাদের গানগুঞ্জন।রাতে ঘুম আসছিল না।উঠে চলে গেলাম লম্বা ব্যালকনিতে। দেখলাম এক অলৌকিক মোহময় দৃশ্য।হালকা কুয়াশা আছড়ে পড়ছে ঘন কুয়াশার বুকে। হিম হিম ধোঁয়াময় মানুষ মানুষীরা যেন আলোকোজ্জল রিসর্টের মুক্তাঙ্গনে খেলে বেড়াচ্ছে। বহুদিন পর এতটা নিবিড়ভাবে পাহাড়কে পেলাম। নানান কোণ থেকে তাকে দেখে বিস্মিত হলাম। সেই দুদিন এক অন্যরকম আমির মধ্যে নিজেকে রেখেছিলাম। উষ্ণায়নের প্রভাব যে সেখানেও ছিল সে কথাইবা অস্বীকার করি কী করে!তবু ছিল ক্ষণজন্মা পুলক জাগানো হিমেল হাওয়া।অপূর্ব শোভা ছড়ানো প্রাকৃতিক স্টুডিওতে!ঈশ্বর তার মনের মাধুরী মিশায়ে এক টুকরো স্বর্গ যেন উপহার দিয়েছেন!বাইরে কোথাও যাব না স্থির করেই রেখেছিলাম।আসলে নিজেকেওতো দেখতে ইচ্ছে করে কখনও! সে দেখা ঐ এক টুকরো সবুজে নিমজ্জন। আমার সঙ্গে তার কোন প্রভেদ ছিল না। যেন সে আর আমি একই অঙ্গে দুই রূপে ছিলাম এক অনন্ত হাতছানির ভেতর। এমন স্বপ্নিল যাপন জীবনে খুব কম আসে!অনুভব করলাম রবিঠাকুরের শব্দকে চোখ বুজে! 'চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে!' আরো আরো কত কথা ও সুরে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলাম!এও এক অনন্য পরিভ্রমণ।যদিও সাময়িক তবু সে সত্য!সময় আবার নিয়ে গেল সময়ের বাস্তবতায়। নার্সিসাস মোহময়তা কাটিয়ে সম্বিত ফিরে পেলাম।
এই মধ্যবয়সে এসে উপলব্ধি করতে পারি যে সব স্মৃতি থাকে না।সাম্প্রতিক কিছু কোথায় তলিয়ে যায়!অথচ বালিকা বেলার প্রচুর স্মৃতি আজও মধুর হয়ে আছে।কখনও কখনও মানসিকভাবে যখন অসহায় হয়ে পড়ি তখন সেই মধু টেনে এনে ভালো থাকবার চেষ্টা করি।আমার এই চাবাগানে দুদিনের পাহাড়ি বসবাস স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
কিছুটা বললাম,বাকিটা রেখে দিলাম কৃপণের মতো!
সেটুকু নাহয় নিজের জন্য থাক!