সবুজে মোড়া মানস/মান্তু রায়
সবুজে মোড়া মানস
মান্তু রায়
--------------------------
জীবনের উত্থান পতনের ভিতর থাকতে থাকতে নিজস্বতা কেমন হারিয়ে যায়, এক ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে হয় বন বনানীর আবডালে, রোজনামচা থেকে বেরিয়ে, কোলাহল থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হয় কোনো কোনো সময়!
কোনো প্ল্যান ছাড়াই হঠাৎ বেরিয়ে পড়লাম আমরা কয়েকজন ছবিওয়ালা, জলপাইগুড়ি রোড থেকে ট্রেন, তারপর বরবেটা থেকে বাঁশবাড়ি, সেখানেই সবুজে মোড়া মানস, চারিদিকের সৌন্দর্য যেন পটে আঁকা ছবি, মন কেমনের দেশ, উদাস করা মন, চোখ দেখছে জঙ্গুলের চিত্র, মন ভাবছে আরও কত কি..
পরদিন সকাল ছয়টায় সাফারি গাড়ি করে বেরিয়ে পড়লাম জঙ্গলের উদ্দেশ্যে, প্রবেশ করতেই মনে পড়ে গেল সেই ছোট্ট বেলার গান, "তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই", সবুজের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে সেই সোনার হরিণ, তার চাহনি দেখে মনে হল যেন আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে তার বাড়ির উঠোনে, মুগ্ধ হলাম.... ক্যামেরা বন্দী করে যতটা না শান্তি পেলাম তার থেকে বেশি শান্তি পেলাম তাকে মুখোমুখি দেখে।
জঙ্গুলে গন্ধ যেন বাতাসের গায়ে গায়ে বইছে, প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে চলতে থাকলাম সবুজ বীথিকে সঙ্গে নিয়ে, তারপর দেখা পেলাম নানান রকমের পাখির। সাফারি গাড়ির ড্রাইভারের থেকে পাখিদের নাম জেনে নিলাম। চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম মানস নদীর ধারে। আহা এক অন্য রকম ভালোলাগার ছোঁয়া পেলাম মানসের জলকে স্পর্শ করে। এত গভীর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গিয়ে শেষ সীমান্তে যে মানস নদী আমাদের জন্য প্রহর গুনছে সেটা সেখানে না গেলে বোধগম্য হত না।
হোম স্টেতে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার ছুটলাম জঙ্গুলে গন্ধ মাখতে। দেখা পেলাম হস্তিনীদের, তাদের সন্তানদের নিয়ে সারি বন্ধ ভাবে দুপুরের খাবার খাচ্ছে। এক বিস্ময়কর দৃশ্য দেখতে পেলাম, যা দেখে অভিভূত হলাম, মা হাতিটি তার শুড়ে খাবার নিয়ে বাচ্চাদের খাইয়ে দিচ্ছে, তখন মনে পড়ে গেল " বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে,
দুটো গন্ডার রাস্তা পারাপারের জন্য সামনে এগিয়ে আসছে, কিছু সময় গাড়ি দাঁড়িয়ে দূর থেকেই তাদের ক্যামেরা লেন্সে বন্দী করলাম। আবার চলতে চলতে দেখা মিলল হনুমানের, এক দল হনুমান গাছের ডালে ঝুলছে, আমাদের সাফারি গাড়ি দাঁড়াতেই উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। এক দু'জন আবার পাতার ফাঁকে লুকিয়ে যাচ্ছে, তাদের এই খেলা দেখে মন ভরালাম।
মস্ত বড়ো গাছের ভেতর একটা গর্ত থেকে বেরিয়ে আছে Lizard, তার আবছায়া এসে পড়েছে সেই গাছের শরীর জুড়ে, মাঝে মাঝে জিভ বের করছে, কখনো কখনো চোখ বুজে নিচ্ছে, মনে হচ্ছিল আমাদের প্রেম দিল একগুচ্ছ, তার চাহনি ও চোখের ইশারায় ... !
ময়ূরের ডাক শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝেই, যেদিকে তাকাই সেদিকেই ময়ূর, কখনো পেখম মেলে দাঁড়িয়ে আছে, আবার দেখছি এক ডাল থেকে আর এক ডালে গিয়ে বসেছে, অসাধারণ এই দৃশ্য দেখার জন্যই আমার দৃষ্টি যেন অপেক্ষায় ছিল! সেই দৃশ্যকে ভিডিও করার জন্য মোবাইল ফোনটি বের করে ভিডিও করতে করতে এগোচ্ছি - দুপাশে হাতির দল তাই গাড়িও ছুটছে খুব স্পিডে, একটা শুকনো গাছের ডালে হাতটা লেগে ফোনটি ছিটকে গিয়ে পড়ে হাতিবাবাজির পায়ের সামনে, আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, আমার ফোন আমার ফোন, সামনে এগিয়ে গাড়িটা থামালো ড্রাইভার, হাতিবাবাজির পায়ের কাছে ফোনটা পড়ে আছে দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, অপেক্ষা করছি সকলে মিলে হাতি বাবাজি গেলে ফোনটি আমার মুক্তি পাবে, অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরে হাতিবাবাজি জঙ্গলের দিকে রওনা দিলে আমার ফোন উদ্ধার করি, এ এক সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা।
সন্ধ্যা নেমে আসে, মনে হচ্ছে আরও একটু সময় যদি থাকা যেত এই সবুজের বুকে!
ফিরতি পথে উপরি পাওনা, সরু রাস্তা দিয়ে চলছে গাড়ি হঠাৎ ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিল, ড্রাইভার বলে উঠল ওই দেখুন জলে, মাথা বের করে আছে "water buffalo ". জঙ্গলের ভেতর একটা ঝিল জলের ভেতর তার মস্ত শরীর, দূর থেকে দেখা যাচ্ছে তার বড়ো দুখানা শিং, আহা কি সুন্দর, প্রাণ ভরে ছবি নিলাম আমার লেন্সে!
ফিরতি পথে ময়ূরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ফিরছিলাম। অন্ধকার নেমে আসতেই জোনাকির জ্বলজ্বল আলো, ঝিঝি পোকার শব্দে গা ছমছম পরিবেশে মাঝে মাঝে ছুঁয়ে যাচ্ছিল আমায় শীতল বাতাস।
বাড়ি ফিরেও যেন মন পড়ে আছে মানস জঙ্গলের আনাচে-কানাচে, ঘোর কাটছে না আজও, সেই গন্ধ এখনো আমার নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে....
ভ্রমণ মাঝেই সুখের উল্লাস
রোজনামচা যাও ভুলে যাও
ছুটে চলো সবুজের কোলে
বাঁচো এবার প্রাণ খুলে....৷
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴