সদবুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত যে মাতৃশক্তি/কবিতা বণিক
সদবুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত যে মাতৃশক্তি
কবিতা বণিক
আপামর জনসাধারণ মায়ের “দুঃখহরা“ নামের সাথেই পরিচিত। কারণ মায়ের কাছেই সবাই হৃদয় জুড়ায়। মাতৃত্ব একটা বোধ। সেটা পুরুষের মধ্যেও থাকে। তেমনি পিতৃত্বও মায়ের মধ্যে থাকে। এই সত্বা গুলো সদবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হলে তবেই সার্থক জন্ম লাভ হয়। আজ এমনই এক মহীয়সী নারীর জীবনের ঘটনা বলব, যিনি আজও প্রাতঃ স্মরণীয়া। খুব বেশিদিন আগে নয় তবুও সে সময় মেয়েদের তাদের শারিরীক দুর্বলতার কারণে ব্রত, পূজো, পার্বণের ওপর বিশ্বাস ও নির্ভরতার জায়গা ছিল। তারা জানে, যে কোন বিপদই আসুক না কেন তাদের হরি, কৃষ্ণ, কালী যে যে দেবতার পূজো করেন বা বিশ্বাস করেন তিনিই রক্ষা করবেন। এই বিশ্বাস সদবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হলে তবেই অবশ্য কার্যকরী হতো।
আমরা দেবী চণ্ডীকেও দেখেছি মেয়ে হওয়ার সুযোগ নিয়ে নয়, মাতৃশক্তিকে কাজে লাগিয়ে তাঁর অষ্টশক্তি দিয়ে রক্তবীজ বধ করেছিলেন। ঠিক তেমনি মহারাষ্ট্রের ‘অহল্যাবাঈ হোলকার‘ নাম আজও সর্বজনবিদিত। আমরা জানি ভারতবর্ষের প্রতিটি কোণায় তাঁর স্পর্শ আছে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া মন্দির গুলির পুনর্নির্মান করছেন তিনি। তাঁর মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য উত্তরে কাশী বিশ্বনাথ ও কেদার নাথ, দক্ষিণে শ্রীশৈলম মন্দির, পূর্বে জগন্নাথ মন্দির,ও পশ্চিমে সোমনাথ মন্দির তিনিই সংস্করণ করিয়েছেন। তিনি অত্যন্ত শিবভক্ত ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে কোন মানুষ খালি হাতে ফিরে আসত না। তাঁর রাজ্যে ডাকাতদের দমন করেছেন। জঙ্গলের অধিবাসীদের জঙ্গল রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছেন। অনেক কুয়া, পুকুর, নদীর ঘাট, রাস্তা, ধর্মশালা তৈরি করেছেন। আমরা তাঁর কাছে খুবই কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমরা সবাই হয়তো জানি না মহিলা বলে সে অবলা নয়।
অহল্যা বাই হোলকর মহারাষ্ট্রের একটা ছোট্ট গ্রামের মেয়ে। সে সময় মেয়েরা পড়াশোনা না শিখলেও তাঁর বাবা তাঁকে পড়াশোনা শিখিয়েছিলেন। আট বছর বয়স কালে গ্রামের মন্দিরে অহল্যা বাঈ আরতির গান গাইছেন। সে সময় মালবা রাজ্যের রাজা মাল্হার রাও সে গ্রামে উপস্হিত ছিলেন। দেখলেন ছোট্ট একটি মেয়ে মন্দিরের বাইরে সবাইকে প্রসাদ সেবন করাচ্ছেন। ঐ বালিকার সেই সেবার প্রতি নিষ্ঠা ও যত্ন রাজাকে মুগ্ধ করেছিল। রাজা ঐ মেয়েটির বাবার সাথে পরিচয় করলেন। রাজা মাল্হার রাও তার পুত্র খাণ্ডে রাও এর সাথে বিবাহ দিয়ে রাজধানী ইন্দোর নিয়ে আসেন মেয়েটিকে।
এইটুকু মেয়ে শ্বশুর বাড়ির সবার প্রতি সেবা, নিষ্ঠা ও সুমধুর ব্যবহারে রাজা তার পুত্রের সাথে পুত্রবধুকেও রাজকার্যের শিক্ষা দিতে আরম্ভ করলেন। বিবাহের বারো বছর পর স্বামী খাণ্ডেরাও কুম্ভের যুদ্ধে মারা যায়। তখন তার এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তান বর্তমান। তা সত্বেও তিনি সহমরণে যেতে চাইলে শ্বশুর মশাই মাল্হার রাও বলেন। “তুই আমার পুত্র। তুই ছাড়া আমার কেউ নেই। এই বুড়ো বাবার কথা চিন্তা করে সহমরণ থেকে বিরত থাক মা!“ শ্বশুর পিতার চোখের জল অহল্যা বাঈ এর মনকে শক্ত করে। কিছুদিন পর শ্বশুর পিতাও চলে গেলেন। এবার সমস্ত রাজকার্য তাকেই দেখতে হয়। ছেলে তখনও ছোট। অহল্যা বাঈ অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না। একবার ছেলের মৃত্যুদণ্ডও তিনি ঘোষণা করেছিলেন। সেবার অহল্যাবাঈ এর রথ চলার পথে দেখতে পান একটা রক্তাক্ত মৃত বাছুরের পাশে তার মা গাভীটি বসে আছে। তিনি বুঝলেন আঘাত লেগেই বাছুরটির প্রাণ গেছে। খোঁজ নিয়ে জানলেন যে কিছুক্ষণ আগে তাঁরই পুত্রের রথের চাকায় বাছুরটির প্রাণ গেছে। অহল্যাবাঈ ঘোষণা করেন তাঁর পুত্র মালোজীকে হাত, পা বেঁধে রাস্তায় ফেলে তার ওপর দিয়ে রথ চালিয়ে তাকেও পিষে মেরে ফেল। কিন্তু সেদিন কেউ রথ চালাতে চায়নি তখন রাণী নিজেই রথ চালালেন কিন্তু ঐ মা গাভীটি বারে বারে তাঁর রাস্তা আটকিয়েছে। অগত্যা অহল্যাবাঈ ক্ষমা করলেন ছেলেকে। কারণ মা গাভীটিও চাইছিল না আর কোন মায়ের সামনে তার সন্তানের মৃত্যু হোক। এর কিছুদিন পরেই ছেলেকে রাজতিলক করালেন, যে দাদাজীর মতো তাকেও রাজ্য চালাতে হবে। কিছুদিনের মধ্যেই যে মালোজী রাও শয্যা নিলেন আর ওঠেননি। এই অবস্হায় মা অহল্যা বুকে পাথর চাপা দিয়ে প্রজাদের কথা চিন্তা করে রাজকার্যে মন দিলেন। রাজ্যের যাতে পতন না হয় সেই দিকে তাঁর চিন্তা বেশী। এদিকে হোলকার পরিবারে সেই সময় কোন পুরুষ ছিল না। এই সুযোগে রাজ্যের এক কর্মচারী অন্য রাজ্যের রাজা রাঘবা রাওকে চিঠি দিয়ে হোলকার রাজ্যকে কব্জা করার নিমন্ত্রণ দেন। অহল্যাবাঈ এই ষড়যন্ত্র ধরে ফেলেছিলেন। ঘোষণা করলেন যে তিনি নিজেই সিংহাসনে বসবেন। তাঁর সেনাপতি রাণীকে সহযোগিতা করেন। আশে পাশের রাজ্যগুলিক খবর দেওয়া হয় । এমনকি পেশোয়া বাজীরাও কেও এই ঘটনা জানানো হয়। সবাই এই উদ্যোগে খুশি হয়েছিলেন এবং সহযোগিতারও আশ্বাস দেন। সবার আশ্বাস পেয়ে অহল্যাবাঈ রাজ্যের শক্তি বাড়ানোর অস্ত্র শস্ত্র জোগাড় করা শুরু করেন। এবং নিজের নেতৃত্বে এক মহিলা সেনাবাহিনী তৈরি করেন। এই মহিলাদের সবরকম প্রশিক্ষণ দেন ও যুদ্ধের নানান কৌশলও তিনি শেখান। সম্পূর্ন তৈরি হয়ে অহল্যাবাঈ সেই শত্রু রাঘবা রাওকে চিঠি লেখেন।
“হে রাজন! তুমি আমাকে অবলা ভেবে ভুল করেছো। এই জন্য আমি যুদ্ধ ভুমিতেই এর জবাব দেব যে অবলা কি করতে পারে। আমার থেকেও আমার মহিলা সেনাবাহিনী তোমার মুখোমুখি হবে। তাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। কিন্তু মনে রেখ , এই যুদ্ধে যদি আমি হারি তবে দুনিয়া কিছুই বলবে না আর তুমি যদি হারো তবে এই কলঙ্ক থেকে তুমি কোনদিনই মুক্ত হতে পারবে না। কারণ তুমি মহিলাদের সাথে যুদ্ধ করছ তাই। না হলে নিজেই এই কলঙ্কের ভাগীদার হবে।“ চিঠি পড়ে রাঘবা রাও হতভম্ব হয়ে গেলেন। এ কি কোন অবলার কথা? তিনি ফয়সালা করলেন যুদ্ধ করবেন না। কিন্তু তার পারিষদটা মানছেন না তার কথা। “মহারাজ! আপনার সামনে ঐ মহিলা টিকতেই পারবেন না। শত হলেও তিনি তো একজন মহিলাই।” কিন্তু রাঘবা রাও মানলেন না । তার মনে হয়েছে লাভের থেকে ক্ষতি বেশি হবে। অহল্যার কাছে দুখজী রাও এর মতো কুশল সেনাপতি আছে। যার নেতৃত্বে হোলকাররা অনেক যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। সে কারণে রাঘবা রাও অহল্যাবাঈকে চিঠি লিখে যুদ্ধ করবেন না বলে ঘোষণা করলেন। যেভাবে রাঘবা রাও বাজী হারলেন আর হোলকার রাজ্যের সংকট দূর হলো, তাতে অহল্যাবাঈ এর খ্যাতি দূর দূর পর্যন্ত। ছড়িয়ে গেল। তাঁর বীরত্বের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল দেশ দেশান্তরে। কিন্তু অহল্যাবাঈ দেশের বিকাশের দিকে নজর দিলেন। তাঁর কথা ছিল - “এ আমার বচন , আমার বচনই আমার শাসন।”
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴