শ্রুতি দত্ত রায় -এর আলোচনায় মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য -এর বই 'আদরের রঙ'
শ্রুতি দত্ত রায় -এর আলোচনায় মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য -এর বই 'আদরের রঙ'
কথা সাহিত্যিক শ্রী মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য বর্তমান বাংলা সাহিত্যের জগতে এক অন্যতম জনপ্রিয় নাম। উত্তরবঙ্গের মানুষ বলে হয়তো তাঁর লেখায় বরাবরই প্রাধান্য পেয়েছে ডুয়ার্স, চা বাগান, পাহাড় এবং সেখানকার জনজীবন। তিনি আমার একজন অতি প্রিয় লেখক। কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সাম্প্রতিকতম উপন্যাস 'আদরের রঙ', জনপ্রিয় প্রকাশসংস্থা "পত্র ভারতী"র হাত ধরে।
এর আগে মৃগাঙ্কদার বেশ কিছু ছোটগল্প এবং উপন্যাস পড়েছি। খুব ভাল লেগেছে। কাজেই এই নবীনতম উপন্যাসটি নিয়েও প্রিয় লেখকের প্রতি আগেই একটি প্রত্যাশা তৈরী হয়েছিল। বইটি হাতে নেওয়ার পর দেখলাম যথার্থই গল্পকারের লেখনী সেই প্রত্যাশাকে চরিতার্থ করেছে। প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত এগিয়ে যেতে খুব বেশিক্ষণ সময় লাগেনি গল্পের গতিময়তার কারণে।
'আদরের রঙ' মূলতঃ প্রেমের উপন্যাস। তার প্রধান প্লট আবর্তিত হয়েছে মুকুট ও রঙ্গিতের প্রণয়কে কেন্দ্র করে। মুকুট নেপালের পাহাড়ে ট্রেক করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। অযাচিতভাবে সে জানতে পারে তার শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্যান্সারের মতো ভয়ানক ব্যাধি। ফলে ট্রেকিং এর স্বপ্ন যেমন তার অধরা থেকে যায়, তেমন তার জীবন যেন আচমকাই হতাশার অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকে। এহেন অমোঘ সময়ে ডঃ রঞ্জন রায়চৌধুরী অন্ধকার টানেলে এক ফালি আলোর রশ্মির মতো এসে উপস্থিত হন। জীবনের এই অনিশ্চিত পথের শেষে মুকুট কি শেষ পর্যন্ত সত্যিকারের বিজয়ীর মুকুট মাথায় ধারণ করতে পারে? এই নিয়েই গল্প এগোতে থাকে। মুকুটের জীবন পথের বাঁকে একসময় হঠাৎই সাক্ষাৎ হয় রঙ্গিতের সঙ্গে,,,,, যার পাগলপারা ভালোবাসা ও ভরসা, অসুস্থ মুকুটের হৃদয়কে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অন্যদিকে মুকুটের প্রেমে রঙ্গিতের হৃদয়ের নদীতেও ওঠে ঢেউ। "মেঘদুয়ার" চা বাগানের সজীব, সতেজ প্রকৃতির আদর মাখা উপত্যকায় ঘনীভূত হয় তাদের আদরের রঙ। এখানে আকাশে, বাতাসে, পাহাড়ে, চাবাগিচায়, হিমেল কুয়াশায় লেপ্টে আছে যেন এক নিরন্তর ভালবাসার মরসুম।
গল্পের সাবপ্লটের আঙ্গিকে এই উপন্যাস একদিকে তুলে ধরেছে প্রেমের তীব্রতা ও কোমলতাকে__আলোকপাত করেছে নারী পুরুষের সম্পর্কের কখনও সহজ, কখনও জটিল কেমিস্ট্রির, অন্যদিকে জীবনের ওঠাপড়ার লড়াইয়ে ধ্বস্ত হয়েও লড়াকু মানব-মানবীর অনমনীয় জয়ের আখ্যান। এই উপন্যাসের নানান চরিত্র এমনই নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে স্বকীয় জীবনদর্শনকে আঁকড়ে এগিয়ে যায় সাফল্যের দিকে। মুকুট ও ডঃ রায়চৌধুরী যেমন তাঁদের অদম্য ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে জয়লাভ করে কর্কট রোগের বিরুদ্ধে, তেমনি সরসতিয়ার মত উচ্ছল তরুণী শ্রমিক নেতা হিম্মত ও তার দলের হাতে গণধর্ষিতা হয়েও শেষপর্যন্ত জন্ম দেয় প্রেমিক শুকরার সন্তানের। জীবন যুদ্ধে ধ্বস্ত হয়েও দাইমা গুণবালা তামাং-এর মতো চরিত্ররাই হোক, কিংবা বছর একের কোন শিশু, যাকে মুকুটরা দেখে ছিমছিমলে খরকা থেকে ট্রেকিং করে নেমে আসার পথে জঙ্গলের এক উঁচু পাথরের চাটানে__এরা প্রত্যেকেই জীবনকে ছুঁড়ে দেয় তাদের মতো করে চ্যালেঞ্জ।
আসলে উপন্যাস তো বাস্তব জীবনের যাত্রাপথে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এক সামগ্রিক গল্প __ মানবজীবনের ঘাত প্রতিঘাতের কাহিনী__ এবং একই সঙ্গে লেখকের জীবনবোধ প্রকাশের মাধ্যম। 'আদরের রঙ' উপন্যাসও তার ব্যতিক্রম নয়। কাজেই এখানেও পাঠক দেখতে পায় লেখকের দৃষ্টিভঙ্গীর অনবদ্য প্রতিফলন। আর সেখানেই 'আদরের রঙ' নিছক প্রেমের উপন্যাস থেকে উন্নীত হয় এক নির্ভীক অথচ নিস্পৃহ জীবন দর্শনের উপন্যাসে, যেখানে মানুষের গোটা জীবনটাই একটা ট্রেকিং রুট,,,, নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ।
উত্তরবঙ্গ ও নেপালের পটভূমিকায় লেখা এই উপন্যাসের উপরি পাওনা হল লেখকের সুদক্ষ হাতে, শব্দবর্ণে আঁকা প্রকৃতির অনবদ্য সব ছবি। রয়েছে ট্রেকিং রুটের অথবা চা বাগানের মানুষের প্রতিদিনের জীবনের টানাপোড়েনের নিখুঁত বর্ণনা যা লেখকের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও প্রজ্ঞার সুস্পষ্ট দলিল। এছাড়াও আছে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে কৌশলে গুঁজে দেওয়া সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তুষার রায়, অঞ্জনা চক্রবর্তীর লেখা বেশ কিছু কবিতা, যা নিশ্চিতভাবেই পাঠকের হৃদয়কে প্রেমের সুরে গান গাইতে অনুপ্রাণিত করবে।
আর যে কথা না বললেই নয়, বইটির প্রচ্ছদটিও ভারি আদুরে। হলুদ, কমলা, লাল,,,,, আদরের নানা রঙে রঙীন এই প্রচ্ছদ নিঃসন্দেহে যে কোন পাঠককেই প্রথম দর্শনেই বইটির প্রেমে পড়তে বাধ্য করবে।
আগ্রহী পাঠকেরা বইটি পড়ে নিতে পারেন। আশা রাখি, নিশ্চয়ই ভালো লাগবে।
বই: "আদরের রঙ"
প্রকাশক: পত্রভারতী
লেখক: মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
মূল্য:২৯৯ /-
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴