শ্রীযুক্ত ভানুসিংহ মহাশয় সমীপেষু/রাজর্ষি দত্ত
শ্রীযুক্ত ভানুসিংহ মহাশয় সমীপেষু
রাজর্ষি দত্ত
---------------------------------------
আশাকরি এই পত্র আপনার সুস্থ-সবল দেহসৈষ্ঠব, প্রদীপ্ত আয়তচক্ষু ও রসিক হৃদয়ের সন্ধান পাইবে। আমার পরিচয় একজন কুণ্ঠিত, লজ্জিত বঙ্গবাসী যাহাদের মস্তক আনত হইয়া গিয়াছে নানাবিধ কারণে। আপনি নিশ্চয় দেখিতে পারেন আপনাকে উপলক্ষ্য করিয়া বিচিত্র জগাখিচুড়ী উৎসব, বেসুরো ছন্দের আস্ফালন, রাশি রাশি বিচ্যুতির এবং নিত্য রুচিক্ষয়ের অগুন্তি নিদর্শন! আপনার আশি বৎসরের সুদীর্ঘ জীবৎকালে যাহা গচ্ছিত রাখিয়া গিয়েছেন এই বঙ্গভান্ডারে তাহা ভাঙ্গিয়াই বাঙালির নিত্য পথচলা। আপনার কাব্য, সঙ্গীত ও সাহিত্য রচনা আবিষ্ট করি রাখিয়াছে বাল্যকাল হইতে। পুরাতন রেডিও, রেকর্ডপ্লেয়ার কিংবা আধুনিক ডিস্কের বিবর্তনের মাঝেও অব্যাহত আপনার সৃষ্টির রবিচ্ছটা!
অদ্য আমি এই বিপুল তথা সহস্র বৎসরের বিরল প্রতিভা সম্পর্কে বিরত থাকিব। পরিবর্তে আপনার অন্তর্নিহিত মানব সত্তা লইয়া দুই চারিটি প্রসঙ্গ উত্থাপন করিব।আপনার বহুমাত্রিক চরিত্রের মাঝে ইহাই আমাকে সর্বাপেক্ষা অধিক আকর্ষিত ও উৎপ্রেরণা দান করিয়াছে।ভবিষ্যতেও করিবে।
যে সকল বঙ্গপুঙ্গব তাহাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞানে এক বিলাসী জমিদারপুত্র, যিনি অঢেল প্রাচুর্যের মাঝে বসিয়া কাব্য রচনা করেন ; গুম্ফ,কেশ ও পরিচ্ছদের পরিচর্যায় কাল অতিবাহিত করেন, তাহারা সেই সুঠাম বলিষ্ঠ রবিকে উত্তাল গঙ্গাবক্ষে সন্তরণ করিতে দেখেন নাই। শিলাইদহের জমিতে ট্রাক্টর লাগাইয়া কর্ষণ, উদ্যমী ও সাংগঠনিক রবিবাবুকে বিন্দুমাত্র কল্পনা করিতে পারেন না।
পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠাকালে আবাসিকদের লইয়া অক্লান্ত লড়াই শুরু হয়েছিল, যাহার ফলশ্রুতিতে পত্নী মৃণালিনী দেবীর অকাল মৃত্যু ঘটে। ইহার পর জলস্রোতের ন্যায় মৃত্যুশোকের মাঝে আপন কর্তব্যে অবিচল মানুষটিকে কেহ কি অনুধাবন করিতে পারেন ? কন্যার বিবাহের দিবসে অন্দরমহলে বিষধর সর্পের মোকাবিলায় কবির হস্তে শোভা পায় দন্ড! নিদারুণ অপমানিত হইয়াছেন জামাতা নগেন্দ্রনাথ কর্তৃক। আপামর জনতা বিদ্রুপ, তিরস্কার, ব্যঙ্গাত্মক বাণীতে বিদ্ধ করিয়াছে সর্বত্র, সমগ্র জীবৎকালে।তথাপি সচল আপনার কর্মযজ্ঞ।এক শিহরিয়া উঠিবার মত 'আউটপুট' ! কি করিয়া সম্ভব এই ক্ষীণ হৃদয়ের,আলস্য ও কূপমন্ডুকতায় আচ্ছন্ন তদীয় বঙ্গ সমাজে?
জমিদার পরিবারের সন্তান হইয়াও ছিলনা কোনরূপ স্থির উপার্জন। ইহার নিমিত্ত বিশ্বভারতীর অর্থসংগ্রহে চরকির ন্যায় পাক খাইতে হইয়াছে বিশ্বব্যাপী।অসুস্থ ও ভঙ্গুর কলেবরেও। তাহা কি এক দায়িত্ববান প্রতিষ্ঠানিকের স্বরূপ নহে?
বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রাখী উৎসব আহ্বান করিয়া অসম সাহসীকতার সহিত নগ্নপদে নাখোদা মসজিদে প্রবেশ করিয়া ইমামের হস্তে রাখী পড়াইয়া দেন। তৎকালে ব্রাহ্ম পরিবারে যাহা ছিল অকল্পনীয়!
জালিওলাবাদের হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে আপনার 'নাইট' উপাধি পরিত্যাগ এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত যাহা শাসকের ভ্রুকুটিকে সদাই তুচ্ছ ও উপেক্ষা করিতে শিখায়।
শুধু কি ইহাই ? শ্রীনিকেতন, সুরুলে কৃষির নব্য চেতনার জোয়ার, সমবায় নীতির প্রতিষ্ঠা, যুযুৎসু শিক্ষা, বৃক্ষরোপণ উৎসব আপনার হিমালয় সদৃশ হৃদয় এবং অতিমানবীয় দক্ষতাকে প্রমাণ করে।জাপান নিবাসী রাসবিহারী বসুকে সাংগঠনিক কর্মে অর্থ সাহায্য করিতে যিনি বিন্দুমাত্র ভাবিত হন নাই।
অতএব একজন কবি ও শিল্পীর বাহিরেও আপনার বৃহৎ পরিচয় একজন সংবেদনশীল মানব রূপে।যিনি শুধুমাত্র কল্পনার কোমল ভূমিতে বিচরণ করেন না, তিনি 'বিশ্বভ্রাতার যজ্ঞশালায়' প্রতিষ্ঠিত। তাঁহার স্থান 'ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে' - সেই অনিন্দ্য "মুক্তির" আলোকে প্রজ্বলিত। বিবিধ কর্মকাণ্ডে আপনার "মানবধর্ম"কে প্রতিষ্ঠা করিবার গগনচুম্বী প্রয়াস মর্মে উপলব্ধি করিয়া মুক্তকন্ঠে বলি - "হে মহামানব, লহ শতকোটি নমস্কার!"
-------------------------------------
নিভৃত নিকেতনের একটি রোদেলা সকাল। কবি বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে। তিনি মাঝে মাঝেই বাসা বদল করেন। কখনও পুনশ্চ, কখনও কোনার্ক বা প্রতীচি। এখন যেমন আছেন শ্যামলীতে।
উপাসনা শেষ। এবার টেবিলে বসে চিঠিপত্র লেখার সময়। লেখার টেবিলে রাখা টাটকা মুচকুন্দ ফুল-কবির খুব প্রিয়।
একজন ভৃত্য বেতের ঝুড়িতে নিয়ে এল দেশ-বিদেশের ডাকটিকিট লাগানো একতাড়া চিঠি। অসংখ্য চিঠির মধ্যে বাছাবাছির কাজটি পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীর।
কবির দৃষ্টি পড়লো একটি খামহীন খোলা চিঠির সম্বোধনের উপর। আজকাল রানুর মত দু একজন ছাড়া তাঁকে 'ভানুবাবু'কেউ বলে না। তিনি প্রথমে হাত বাড়ালেন সেদিকে....
ইতি -
একজন দিবাস্বপ্নের অংশীদার
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴