শ্রীচরণেষু/সুকান্ত নাহা
শ্রীচরণেষু
সুকান্ত নাহা
শ্রীচরণেষু মা ও বাবু,
তোমরা আমার শুভ নববর্ষের প্রণাম নিও।
শেষ কবে তোমাদের নববর্ষের চিঠি লিখেছিলাম আজ আর মনে পড়ে না। খুব সম্ভবত কলেজ হস্টেলে থাকার সময়। তারপর তো একটু একটু করে চিঠি লেখা ব্যাপারটাই উঠে গেলো। বাড়িতে ল্যান্ড-ফোন এলো। দূরে থাকলে ফোনেই প্রণাম জানাতাম। এরপর এলো মোবাইল। তোমরা যদিও মোবাইলে তেমন সড়গড় হতে পারোনি। কাঠের স্ট্যান্ডে কুরুশের কাজ করা ঢাকনায় ঢাকা চৌকো ল্যান্ড-ফোনটাতেই স্বচ্ছন্দ ছিলে। তবু আমাদের শৈশব থেকে প্রাক যৌবন পর্যন্ত সেই হলুদপাখি পোস্টকার্ড আর নীলকণ্ঠ ইনল্যান্ড লেটারগুলোই যে উজাড় করা মনের কথা নিয়ে ডানা মেলে দিত প্রিয়জনের উদ্দেশে। আবার সেই পাখিগুলোই কোনও এক নির্জন দুপুরে নিঃশব্দে ফিরে এসে ঘাপটি মেরে বসে থাকতো খয়েরি চিঠির বাক্সে প্রিয়জনের আখর বুকে নিয়ে।
আমাদের চা বাগানের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে, মা? বিচ্ছিন্ন সবুজ দ্বীপগুলো থেকে চিঠি আদান প্রদানের একমাত্র সাঁকো ছিল 'ডাকওয়ালা'। আশপাশের চা বাগান থেকে ডাকওয়ালারা ধূসর ঝোলাব্যাগে চিঠিপত্তর নিয়ে সাইকেলে চেপে চলে যেত কয়েক কিলোমিটার দূরের পোস্ট অফিসে। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি 'হরক ডাকওয়ালাকে'। তারপর এলো 'সোমারু ডাকওয়ালা' । রোদবৃষ্টি মাথায় করে ওরা সাইকেল চালিয়ে মাইলকে মাইল চলে যেতো। বাবু, আমার এখনও মনে আছে পাশের বাগানের কাউকে কোনও খবর দিতে হলেও চিঠি লিখে খামে ভরে তুমি ঐ ডাকওয়ালা মারফৎ-ই পাঠিয়ে দিতে।
"প্রিয় নিকুঞ্জবাবু, নতুন নাটকের রিহার্সাল শুরু হবে কাল থেকে। অজিত বাবুর বাসায়। সময় করে চলে আসুন সদলবলে। "
চিঠিটা উঁকি মেরে পড়েছিলাম। খামের ওপর লিখে দিয়েছিলে "Per Dakwalla"। মোবাইল আসার পর চা বাগানের চৌহদ্দি থেকে এই শব্দবন্ধটিও আজ হারিয়ে গেছে।
মা, তোমার মনে আছে ১লা বৈশাখ আসার দিন সাতেক আগে থাকতে তুমি তাগাদা দিতে বাবুকে ডাকওয়ালা মারফৎ ডাকঘর থেকে পোস্টকার্ড আনাতে। আমার ভুলোমনা বাবা রোজ ভুলে যেতো। শেষ মুহূর্তে যখন একগাদা পোস্ট কার্ড এলো তুমি গজগজ শুরু করে দিলে, "কবে থেকে বলছি এনে দাও, এনে দাও। এখন এতগুলো চিঠি কখন লিখি বলতো?" সংসারের কাজ সেরে যদিও রাত জেগে তুমি কখন যেন ঠিক লিখে ফেলতে। তোমার ছোট ছোট হাতের লেখা। একটু জড়ানো। বাবুর ছিল মুক্তো ঝরা। সংক্ষিপ্ত। নিরাবেগ। চিঠিতে তোমার কথা যেন ফুরোতোই না। শেষে পুনশ্চ এবং কার্ডের চারপাশের চিলতে কোণ গুলোও রেহাই পেতো না। লেখা শেষ করেও আক্ষেপ থেকে যেত তোমার। কত কি বাদ রয়ে গেল। তারপর যথারীতি দোষারোপ নেমে আসতো বাবুর মাথায়, "এইটুকুন পোস্টকার্ডে কি লেখা যায় ? কত বলি ইনল্যান্ড নয়তো খাম এনে দাও। তা না... শুধু কিপটেমি।" বাবু মুচকি হেসে বলতো, "এর পর না হয় দিস্তে খাতা এনে দেব। যত পারো লিখো।"
মনে পড়ে দিদার কথা। আমি তখন শ্রেণী পঞ্চম, বছরখানেক মামার বাড়িতে স্কুলজীবন। নববর্ষের আগে কালো বটুয়াটা খুলে একটা টাকা আর আধুলি হাতে দিয়ে দিদা বলতেন " ছয় খান পুস্টকার্ড আর দুইখান ইনল্যান্ড লইয়া আয় পোস্টাপিস থিকা। দশ পয়সা বাঁচবো নে। লজেন্স খাইস। আর শুন্, রাইতে পড়া কৈরা আমার জবানিতে চিঠি লিখ্যা দিবি কইলাম। অহন চোহে দেহি না। দ্যাখলে তগো দরকার পড়তো না। " নিয়ে এলাম। তারপর দুদিন ধরে চললো দিদার জবানিতে আমার সদ্য পাক ধরা হস্তাক্ষরে চিঠি লেখা। লিখে পড়ে শোনানোটা ছিল বাধ্যতামূলক। দুপুরে কান খাড়া, গেটের শব্দ...ঐ বুঝি ডাকপিওন নিঃশব্দে ডাক বাক্সে চিঠি ফেলে দিয়ে চলে গেল....এক ছুটে বাইরে। হলুদ বাড়িটার দেয়ালে ঝুলে থাকা কাঠের লালরঙা লেটার বক্স খুলে চিঠি উদ্ধার করে নিয়ে আসাটা ছিল যেন গুপ্তধন উদ্ধারের মতো।
চিঠি লেখার সেই দিনগুলো খুব মিস করি, মা। বিশেষ করে নববর্ষ আর বিজয়া এই দুটো দিন ঐ বেনেবৌ আর নীলকণ্ঠ পাখিদের কথা খুব মনে পড়ে। ওরা আর ফিরবে না জানি। দিন চলে যায়। দিন ফেরে না। যেমন তোমরাও ফিরবে না আর কোনও দিনই। ধুলোওড়া চৈত্র দুপুরে গাজনের বাজনা মিলিয়ে যায় দূর থেকে দূরান্তরে। ভেসে আসে "বাবার চরণে সেবা লাগে-এ-এ-এ মহাদে-এ-এ-ব।" গাজনের সঙ, তেল, সিঁদূর মাখানো কাঠের থান , চাল, নয়া পয়সা আর আমাদের সেই ভাড়া বাড়ির উঠোনে থান নামানোর আগে বাড়িওয়ালি মাসীমার জল ঢেলে দেওয়া, কাচ নাচের স্মৃতি। একে একে চৈত্রসংক্রান্তির ভাইছাতু দেয়া সকালে দু পায়ের ফাঁকে মামাদের এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেওয়া ভাইছাতুর মতো স্মৃতিগুলো ব্যস্ত শহরের বাতাসে মিলিয়ে গেছে। বুকের ভেতর এখন শূন্য মাঠ । বর্ষশেষের স্মৃতিগুলো সেখানে হঠাৎ ছুটে আসা ভূতুড়ে ঘূর্ণির মতো ধুলো উড়িয়ে তোলপাড় করে দিয়ে চলে যায়।
তোমরা নেই। কার সাথে স্মৃতিগুলো ভাগ করে নেব বলো? তাই চিঠি লিখে বুকের ভার হালকা করে নিচ্ছি। চিরতরে হারালে মানুষ কোথায় যায় জানি না। আমার স্মৃতির ভেতর যে পারিজাত ফোটা স্বর্গ সেই ঠিকানায় এই চিঠি পাঠালাম।
ভালো থেকো। পরম শান্তিতে থেকো তোমরা।
ইতি
তোমাদের
বিলন।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴