শ্যাম কাকা/চিত্রা পাল
শ্যাম কাকা
চিত্রা পাল
শ্যাম কাকার গল্পটা কিন্তু সত্যিকারেরই শ্যামকাকার গল্প, একেবারে কাপড় কেটে জামা তৈরির মত দেখেশুনে মেপেজুপে বানানোর মত নয়। তবে হ্যাঁ, একটু আধটু এদিক ওদিক তো হবেই। সে হোক, মোদ্দা কথা আসলেই কাকা এরকম।
শ্যামকাকা আমার ঠিক নিজের কাকা নয়, সেটাও জেনেছি অনেকদিন পরে বেশ বড় হয়ে। তাতে অবশ্য কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি। কেননা আমাদের ভাইবোনেদের বড় হবার সময়ের অনেকটা জুড়ে শ্যামকাকার বসত, আর তা থাকবেও সেভাবে। এটা জীবনের সেই সময়কাল যখন সব কিছু কল্পনার রামধনু রঙ্গে রাঙ্গানো।
আমার বাবার সরকারি চাকরি।তাই জন্যে বদলি হতো, আর যেতে হতো এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়। তাই স্কুলের ছুটি পড়লে আমরা আমাদের হুগলির বাড়িতে চলে আসতুম। এ বাড়িতে আসতে আমরা ভাইবোনেরা খুব মজা পেতাম, খুব ভালো লাগতো। এখানে বাড়ি সংলগ্ন জমির হাতা অনেকখানি। সেখানে যেমন আছে হিমসাগর আমগাছ, পেয়ারাফুলি আমগাছ, দুধভাসালি আমগাছ এরকম কয়েকটা আমগাছ,আর কালোজাম জামরুল এসব ফলের গাছ। তেমন ছিলো পেল্লায় একটা কাঁঠাল গাছ। এছাড়া নারকোল সুপুরি এসবও ছিল। ও বলতে ভুলে গেছি একটা বিলিতি আমড়ার গাছও ছিলো। এই গাছের আমড়া যখন পেকে গাছের তলায় পড়তো, সেইপাকা আমড়ার ওপরের ছালটা একটু ফুটো করে জোরসে টেনে আমড়ার রস খেতাম, কি ভালো যে লাগত কি বলব।
যাক্গে, যে কথায় আসব, আমরা বাড়িতে গেলেই ঠিক দু তিন দিন পরে পরে এসে যেতো শ্যামকাকা। আর শ্যাম কাকা আসা মানেই বাড়িতে খুশির হাওয়া। বাবা খুশি, মা খুশি জেঠু দাদু ঠামা সবাই খুশি। সে সময় অন্তত তাই মনে হতো।কিন্তু আমার মনে হতো, ঠিকমতো খুশি হতো না, আমাদের বড় পিসি।সে সময় বড় পিসি ছিলেন অলিখিত সংসারের কর্ত্রী। বড়পিসির কথা হলো, এবারে আবার কি ঝঞ্ঝাট পাকাবে কে জানে। ঠামা বলতো, না,না, সব সময় ওকি ঝঞ্ঝাট পাকায় নাকি।
গরমের ছুটিতে আমরা খুব বাগানে বাগানে ঘুরে বেড়াতাম। কাঁঠাল গাছে ইয়া ব্বড়ব্বড় কাঁচা কাঁঠাল মানে এঁচোড় ঝুলছে। শ্যামকাকা পিসিকে বললো, ওদিদি, তোমরা এঁচোড় খাও না কেন? ওপরের ডালের এঁচোড়খানা যা পুরুষ্টু হয়েছে না। বড় পিসি বললো, হয়েচে হোক, তোমাকে আর কিছু করতে হবে না। কে শোনে কার কথা। খানিক পরে আমাকে বললো, কোথাও থেকে খানিক দড়িদড়া যোগাড় পারিস,তাহলে এঁচোড়খানাকে বেঁধে নাবিয়ে দোব,তাহলে ওপর থেকে পড়ে ফেটে যাবে না। আমি বললুম,দেকচি। খুঁজতে শুরু করতে গিয়ে মনে পড়লো, কি যেন একটা কাজে বাঁশ বাঁধার জন্যে নারকেল ছোবড়ার কাতা দড়ি আনা হয়েছিলো, তার কিছুটা থাকতে পারে বোধ হয়। সেই ভেবে সিঁড়ির তলার খুপরি ঘরে হাতড়াতেই তাকে পেয়ে গেলাম। শ্যামকাকা দেখে বলে, গুড, তোকে দিয়ে তবু একটা কাজ হয়, অন্য গুলোকে দিয়ে তো কিচ্ছুহয় না। চল এবারে বাগানে চল।
শ্যামকাকার হাতে একখানা পেল্লায় ছুরি,কোমরে দড়ি গোঁজা। ওপরে গিয়ে এঁচোড় কেটে দড়ি দিয়ে বেঁধে নাবিয়ে দেবে। আমরা কাউকে কিছু বলিনি। একেবারে এঁচোড় কাটা হয়ে গেলে বলব। তাই খুব চুপচাপ। কাকা তরতর করে গাছে উঠে গেলো, আমি তলায় দাঁড়িয়ে। খানিক পরে শুনি কাকার চিৎকার, ও বাবা গো, গেলুম গো। আমি ওপর দিকে তাকিয়ে দেখি, ওপর থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। আমি দৌড়ে বাড়ীর ভেতরে গিয়ে সবাইকে বললুম। সবাই দৌড়ে এলো। কি ব্যাপার ? না, এঁচোড় খানা বাঁধাও হয়ে গেছে। ডাল থেকে নামানোর সময় শেষ ছুরির কোপখানা কোথায় বোঁটার ওপরে বসাবে, তা না করে কাকা নিজের হাতেই বসিয়ে দিয়েছে যে। বড়রা সবাই বলছে তোকে কে উঠতে বলেছিলো?
সে কথা কে বলবে কাকাকে। সেই এঁচোড় শুদ্ধুই নামলো রক্তাক্ত হয়ে। বাঁহাতের বুড়ো আঙ্গুল কেটে প্রায় ঝুলছে। এর পর ডাক্তার ঘর সেলাই ব্যান্ডেজ় ইঞ্জেকশন। বাড়ি ফিরে বলে, বুঝলে দিদি, ফলখানা পেরায় নাবিয়ে এনেছিলুম, বড়পিসি বলে, তার সঙ্গে যে হাত খানাও নাবিয়ে দিচ্ছিলে, তার বেলা?শ্যাম কাকা সব উড়িয়ে দিয়ে বলে, আহা, যায়নি তো। কাল বেশ জম্পেশ করে গাছ পাঁঠা রাঁধ দিকিনি,জমিয়ে ভোজন হবে। তার বলার ধরন দেখে সকলেই হেসে আকুল।
পরের দিন খেতে বসে দেখি এঁচোড়ের ডালনার গন্ধে দালান একবারে ম ম করছে, আর দেখতে যা হয়েছে না, ওই দিয়েই সবটা খাওয়া হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।আর সবাইকার চেয়ে শ্যামকাকার এঁচোড়ের ডালনার বাটিটা বড়।সবাই তাই দেখছিজুলজুল করে। তাই দেখে শ্যামকাকা বলেই ফেললো,ভাগ্যিস্ হাতটা কেটেছিলো, তাই।
এখন কদিন শ্যামকাকার হিরো হিরো ভাব চলছে। ওই বড় পিসি বলে দিয়েছে যে,আঙ্গুল কাটার জন্যে শ্যামের অনেকখানি রক্ত বেরিয়েছে। ওর শরীর কদিন দুব্বল থাকবে।তোরা ছোটরা শ্যামের পাশে পাশে থাকিস, ওকে দেখে রাখিস। আমরাও শ্যামকাকার হুকুম তামিল করছি যথাসাধ্য, কেননা বড়পিসি বলে দিয়েছে কি না। কেউ তেল মেখে মুড়ি এনে দিচ্ছি,কেউ রান্নাঘর থেকে কাঁচালংকা পেঁয়াজ সাপ্লাই দিচ্ছি, কাকার কাজ বলে কথা।
দু চারদিন পরের এক সকালবেলা। শ্যামকাকা ঘুম থেকে উঠেই বলল, কাল রাতে এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখেচে ও। কে যেন রাতের বেলায় কাঁঠাল পেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই শুনল, কেউ তেমন গা করেনি। দুপুর বেলায় ভরপেট খাওয়া দাওয়ার পরে, খানিক শুয়ে বসে নিয়ে বাবা কাকা জ্যাঠা সবাই মিলে তাস খেলতে বসেছে, তখন তাস বাঁটতে বাঁটতে বলে ওঠে আবার, কেউ নিঘঘাত রাতে বাগানে ঢোকে কাঁঠাল নিতে। মেজজেঠু বলল, তোর নিঘঘাত পেট গরম হয়েছে, তাই এমনধারা দুঃস্বপ্ন দেখছিস্। ডাব সরবত্ এসব খেয়ে পেট ঠান্ডা কর। ঘরে ডাব পাড়া ছিল, কাকা দু দুখানা ডাব খেয়ে নিলে পরেপরেই।
রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, শ্যামকাকা চিৎকার করছে, চোর চোর। শ্যামকাকা দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করছে ভেবে সবাই দৌড়লো কাকার কাছে।কাকা সমানে বলে যাচ্ছে বাগানে বাগানে। মেজজেঠুর হাতে ছিলো একখানা এত্তবড়ো বাঘা টর্চ। সেইটা জ্বেলে সবাই খিড়কি দরজা খুলে বাগানে গিয়ে দেখে এত্তবড়োএক শেয়াল গাছের গোড়ার দিকের কাঁঠালখানাকে খাবলে খাচ্ছে। সবাই মার ওটাকে বলে লাঠি সোঁটা রড হাতের কাছে যা ছিলো ছুঁড়ে দিলে। সে তার সাধের কাঁঠাল খাওয়া ফেলে দিলে এক জম্পেশ লাফ। এমন লাফ যে সে পাঁচিল পেরিয়ে একেবারে হাওয়া। শ্যাম কাকা বললো, ধুপ করে একটা আওয়াজ হলো, আমি ঠিকই শুনেছিলুম তাহলে। সবাই যে যার ঘরে চলে গেলুম, বড়পিসি শ্যামকাকাকে বলে গেলো, এবার নিশ্চিন্তে ঘুমো, আর আমাদেরও ঘুমোতে দে। সকালে মেলা কাজ আছে।
সেবার আমরা পুরো ছুটি কাটিয়ে আবার ফিরে আসবো। এবার স্কুল খুললে পুরোদমে ক্লাস। মাঝে দু চারটে খুচরো ছুটি, সেসবে তো আসা যাবে না। আসবো আবার সেই পুজোর ছুটিতে। শ্যাম কাকা বললো, ওপরের ডালে কাঁঠাল একখানা যা পেকেছে না, এক্কেবারে তৈরি। শুনতে পেয়ে বড়পিসি বলে দিলো, ক্যাঁটাল পাকুক আর না পাকুক কাউকে গাছে উঠতে হবে না।
আমরা আসবার ঠিক দিন দুয়েক আগে,গরমের নিঝুম দুপুরবেলা। সব ঘরের দরজা জানালা বন্ধ। হঠাত্ শুনি বাগানে ধপাস করে শব্দ। কি হলো,কিহলো বলে সবাই দৌড়লো বাগানে। দেখা গেলো, একখানা পাকা কাঁঠাল ছেতরে রয়েছে, তার মাঝখানে শ্যামকাকা। সঙ্গে সঙ্গে বড়পিসির বাজখাঁই গলা। তুই ফের আবার গাছে উটেছিস? শ্যামকাকার মিন মিন করা গলায় বলতে শোনা গেলো, ওই ওরা যে চলে যাবে,তাই ভাবলুম, দুকোয়া যদি খেয়ে যায়। আমি ঠিকঠাকই উটেছিলুম। নাবিয়েও ফেলতুম দড়িবেঁধে,বেঁধেও ছিলুম দড়িটা কিন্তু, ওটা যে সব শুদ্ধু খসে পড়বে কে জানত। বড় পিসি বলে, সেবার কাঁচা কাটতে গিয়ে হাত কাটলো, এবার পাকা পাড়তে গিয়ে পা ভাঙল কি না কে জানে। সত্যিই, বড়পিসির কথাই ঠিক। কাকার পায়েই লেগেছে। কোন রকমে ধরে ধরে এনে হাত পা ধুইয়ে পরিষ্কার করে বিছানায় শোয়ানো হলো।বড় পিসিই চুনহলুদ গরম করে এনে,কাকার মচকে যাওয়া জায়গাটায় চামচে করে লাগিয়ে দিলে। কাকা গরম লাগছে বলে উহু উহু করে উঠছিলো, পিসি বলে, কথা না শুনলে দ্যাখ কি ভোগান্তি।
ওদিকে দড়ির সঙ্গে লেগে কাঁঠালের যে অংশটুকু ঝুলছিল, সেটা পিসি, ঘরে এনে ছাড়িয়ে রেকাবি করে রেখে দিয়েছিলো। বিকেলে সবাইকে এক কোয়া করে দিলে। সবাই একবাক্যে বলে, কি ভালো স্বাদ, কি ভালো খেতে। শ্যামকাকা হা হা করে হেসে বলে,এইটে আমার বড় প্রাপ্তি’। বলে আবার তাস খেলতে লাগল। তবে এখন এটুকু বলে এবারের মতো শেষ করছি, এবারের মতো আপাতত শান্তি। পরের কথা আবার পরে হবে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴