শেষ চৈত্র
শেষ চৈত্র
শুক্লা রায়
-----------
জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে মনে পড়ল চশমাটা নিলেন না। ডাক দিলেন 'মণি! মণি!' মণি ওনার বউ। শুনতে পেল কিনা বোঝা গেল না। আবার জুতো খুললেন। একরাশ বিরক্তি জমল মেঘের মতো। কিন্তু তারা প্রকাশ পেতে জানে না। ভেতরেই জমাট বেঁধে থাকে। ঘরে এসে দেখলেন ভেতরের ঘরের জানলার পাশে বসে মণি একনাগাড়ে ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই হয় মেয়ে নয়ত নতুন বেয়ান। বেয়াইমশাইও হতে পারেন, যা খাতির! চাইলেই ফোনটা রেখে একটু ওনার ডাকটাও শোনার চেষ্টা করা যেত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলেন। মণি অবশ্য বরাবরই এরকম। কোনদিন নীলেশ্বরকে পাত্তা দেয়নি। সে বিয়ের পর থেকেই। প্রথম প্রথম মিনমিন করে নিজের উপস্থিতিটা বোঝানোর চেষ্টা করেছে। এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। মণির মনে আসলে ওর জন্য কোনও জায়গাই তৈরি হয়নি। সেই বিয়ের পর থেকেই। আগে হতাশ লাগত। এখন লাগে না। মানুষ যা চায় সব কি পায়! তিনি নিজে কি পেলেন জীবনে? ভাবতেই চান না এখন। ছেলে তো চোদ্দ আনাই ভ্যাগাবন্ড বনে গেছে। পড়াশুনা লাটে উঠিয়ে ভ্লগ না ব্লগ কী ছাই করে বেড়ায়। তা নিয়ে মা-ব্যাটার ভাষণের শেষ নেই। ওকে দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়। কত আশা ছিল ছেলেকে নিয়ে। আর মেয়েটা? ছেলের থেকে মেয়ের প্রতি বেশিই দুর্বল তিনি। খুব যত্ন করে পড়াতেন। ভাবতেন মেয়ে একদিন বিরাট কিছু হবে। ফিজিক্সের প্রফেসর হবে। গবেষণা করবে। শেষ বয়সে তিনি আত্মতৃপ্তিতে সুখনিদ্রা দেবেন! কোথায় কি! দুম করে বিয়ে করে বসল। এখন সেই মেয়ের বাড়িই যাচ্ছেন। যদিও ও বাড়ির লোককে তার মোটেই পছন্দ নয়। বড্ড বেশি কথা বলে আর সমানে পান চিবোয়। বেয়ান তাকে পান খাওয়ানোর প্রভূত চেষ্টা করেও ফেল। কথাটা ভাবতেই মনে মনে একটু হেসে নিলেন। তবে চেষ্টা এখনও চলছে। তিনি বোঝেন এসব তাকে হাত করার চেষ্টা। এই যে হঠাৎ ডাক পাঠানো, কী, না সারপ্রাইজ আছে। মেয়ের বিয়েটাই তো একটা বড় সারপ্রাইজ জীবনে। আর কী সারপ্রাইজ আছে, থাকতে পারে! সেজন্য তিনি বড্ড রেগে থাকেন এখনও। বিশেষ যেতে চান না। আর মণির কথা কী বলবে! ভাবতেই আর একটা দীর্ঘশ্বাস। দুদিন যেতে না যেতেই বেয়াইমশাই ছাড়া কিছুই বোঝে না। বললেই ফোঁস। "তোমার মতো 'শুষ্কং কাষ্ঠং নাকি' সবাই! একমাত্র মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়ি বলে কথা!" হুঃ! নীলেশ্বরের রাগ অভিমান দুটোই আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।
রাস্তা তো নয়, মাঠ। এখানে সেখানে ডোবা, খানা- খন্দে ভর্তি। দুদিন আগে সামান্য বৃষ্টি হয়েছে, তাতেই অবস্থা আরো বেহাল। বিপরীত দিক থেকে একটা গাড়ি এলে কোন দিকে সাইড দেবেন ভেবে পান না। খুব সাবধানে মোটামুটি স্পীডের কাঁটা ফর্টিতে রেখে এগোচ্ছেন। যাচ্ছেন মেয়ের বাড়ি। যাকে ভেবেছিলেন গবেষক হবে, সে বিয়ে-টিয়ে করে নিয়ে রীতিমতো গিন্নি-বান্নি হয়ে বসে আছে। যত্ত সব! ফোন করে যেতে বলেছেন নতুন বেয়াই মশাই। কী সারপ্রাইজ আছে ঈশ্বর জানেন। বারবার জানতে চাইছিলেন কেন ডেকেছেন, কিছুতেই বলবেন না। 'মশাই আপনি আসেন তো আগে!'- সেই এক কথা। যতই রাগ দুঃখ থাক। সন্তান তো! বড্ড দুর্বল জায়গা। নইলে ছুটির দিনটায় এই ভাঙা রাস্তা উজিয়ে এখন তিনি কোথাও যেতেন না।
লুকিং গ্লাসে দেখলেন একটা বড়সড় পাঞ্জাব বডি ট্রাক তাকে ওভারটেক করছে। গর্ত বাঁচিয়ে সামান্য সরে গেলেন বাঁ দিকে। কিন্তু এবার তার অবাক হবার পালা। উল্টো দিক থেকে একেবারেই রঙ সাইড দিয়ে একটা বেপরোয়া বাইক ছুটে আসছে তীব্র গতিতে। ফাঁকা জায়গা। এখানে কোন ট্রাফিক বা লোকজনও নেই। কোথায় অভিযোগ করবেন। একদম রাস্তার বাঁপাশে নেমে কতকটা বাধ্য হয়েই দাঁড়ালেন। দুটো ছেলে ছিল বাইকে। খুব মজা পেল। হৈ হৈ করে চিৎকার করতে করতে গেল। এসব আর অপমানে নেন না তিনি। তবু মনটা বিরক্তিতে ভরে গেল। কত আর বয়েস হবে! তার ছেলের মতোই।
বিরক্ত হলেই বা কী করার। মুখটা চিরতা গেলার মতো কিছুক্ষণ ওই বেপরোয়া বাইকের ভাবনায় ডুবে থাকলেন। শুধু বাইক নয়, মনে মনে এই জেনারেশনটারই শাপ শাপান্ত করে তবে থামলেন। কেউ দেখলে স্পষ্টই বুঝত মুখটা বিরক্তিতে কেমন কুঁচকে আছে! সব শেষে, যাকগে মরুকগে ভেবে পুনরায় মেয়ের চিন্তায় মগ্ন হলেন। আর কিছুদিন পরে বিয়েটা করলে কী হত? কত ব্রাইট ক্যারিয়ার ওয়েট করছিল ওর জন্য। নাহ্! সব জলাঞ্জলি দিয়ে উনি ড্যাং ড্যাং করে শ্বশুরবাড়ি চললেন। আসলে কেউ না জানুক, উনি তো নিজে জানেন, ছেলেটার থেকেও মেয়েটাকে একটু বেশিই ভালোবাসেন তিনি। তা সে মেয়ে কী বাবার ভালোবাসাটা বুঝল! ইস! আবার তীব্র হর্ণ। সেই মোটর বাইকটাই তীব্র গতিতে তাকে ক্রশ করে বেরিয়ে গেল।
"মরবে! নির্ঘাৎ মরবে এরা।"
মনে মনে বিড়বিড় করলেন। তারপর নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে আবার বাইক স্টার্ট করলেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই লুকিং গ্লাসে দেখলেন সেই বাইকটা। আবার আসছে। দুরন্ত গতিতে। তিনি রাস্তার ধার ঘেঁষে সরে এলেন। ভোঁওওও। বিকট আওয়াজে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় রূমাল নাড়িয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে একটা বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি করে নৃত্য করল যেন। উনি গায়ে মাখলেন না। কিন্তু আবার! আবার সেই বাইক। আবার সেই সিচুয়েশন। তাঁকে একটা দ্রুতগামী সরকারি বাস ওভারটেক করছে। তিনি সরেই এসেছেন রাস্তার সাইডে। তার মধ্যে উল্টোদিক থেকে বাইকটা। রাস্তার পাশে বড় গর্ত। কোথায় সরবেন! তাহলে ব্রেক কষে সসম্ভ্রমে জায়গা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। সারাজীবন মুখ বুজে সয়ে যাওয়া মানুষটার বড্ড আত্মসম্মানে লাগল। দিলেন না সাইড। বাইকটা সামনে এসে হতভম্ব। কোনওরকম কান ঘেঁষে পাশ কাটাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছিটকে গেল। ভাগ্যিস বড় গাড়িটা বেরিয়ে গেছে। টাল সামলাতে না পেরে তিনিও পড়ে গেলেন। আঘাতের থেকেও বেশি মানসিক উত্তেজনায় মুহূর্তে জ্ঞান হারালেন।
চোখ খুললেন ধূপগুড়ি গ্রামীণ হাসপাতালে। হাসপাতাল নিতেই চায়নি, কিন্তু জোর করে ভর্তি করা হয়েছে প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুর জন্য। জ্ঞান ফিরতেই নীলেশ্বর অবাক। কোথায় তার সর্বক্ষণের ফিটফাট সাজুগুজু বৌ। এলোমেলো চুল, ধেবড়ে যাওয়া কাজল আর উদ্বিগ্ন মুখের মণিকে তিনি যেন চিনতেই পারছেন না। সম্বিত ফিরলে ভালো করে নিজেকে দেখে বুঝলেন আঘাত তেমন কিছুই না। কিন্তু এই শেষ চৈত্রে মদনদেবের পঞ্চ শরের আঘাত সইতে পারলেন না। বুড়ো বয়সে উলুঝুলু বৌটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ প্রেমে পড়ে গেলেন। এতদিনের জমিয়ে রাখা রাগ বিরক্তি যেন নিমেষে উধাও! চার চক্ষুর চকিত মিলনে মণি কী বুঝল কে জানে, অকারণ লজ্জা পেয়ে সেই প্রথম দিনের মতো চোখ ঘুরিয়ে নিল। তিনিও চোখ সরাতেই দেখলেন মিটিমিটি হাসিতে ছেলে তাকিয়ে। মনে মনে লজ্জা পেলেন। কিছু বুঝল! ইঃ! ছেলে তো নয় সবজান্তা শত্রু একটা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴