শেরপাগাঁও : একান্ত যাপনের আস্তানা/অয়ন নাইডু
শেরপাগাঁও : একান্ত যাপনের আস্তানা
অয়ন নাইডু
পায়ের তলায় শর্ষে! যাত্রা শুরু করেছিলাম শিলিগুড়ি থেকে, অপরিকল্পিত বাইক ট্রিপ,রাস্তা চেনা হলেও গন্তব্য অচেনা! প্রাতরাশ(উল্লেখ্য সেই প্রাত:রাশ করেছিলাম বেলা ১ টা নাগাদ) শেষ করে, তীব্র দাবদাহ থেকে একটুখানি রেহাই পেতেই পাহাড়ে আস্তানার খোঁজে বেরিয়ে পড়া! আমরা বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, আবহাওয়া খুব মিষ্টি, পাহাড় অভিজ্ঞ অভিজিৎ সেনের কথা মতো একটা সোয়েটার নিয়ে যাওয়া, ওখানে নাকি অতটা ঠান্ডা নেই! যাই হোক, চা প্রেমী লোকজনদের নিয়ে সমস্যা থেকেই যায় প্রতি ঘন্টা জার্নির পর নাকি আবার চা এর তেষ্টা পায়! সেবক ব্রীজ পার হয়ে ডুয়ার্সের পথে যেতে শুরু করলাম কিছুটা গিয়েই বাঁদিকে ঘুরে উঠতে শুরু করলাম গোরুবাথানের পথে! যতটা উপরে যাই, ঠান্ডা বাড়তে থাকে এবং সময় বাড়ে, বেশ বুঝতে পারছিলাম যে মেঘেদের রাজ্যে প্রবেশ করছি, মেঘবালিকা দুবাহু তুলে আহ্বান জানাচ্ছে! অন্ধকার নামা শুরু হয়।
কিছুটা রাস্তা চা বাগান পেরিয়ে আবার কিছুটা জনবসতি পেরিয়ে নিঃস্তব্ধ পাইন বনের মধ্যে দিয়ে দুপাশে পাইন বনের ছায়ায় রাস্তার ওপর এক অদ্ভুত প্রশান্তি, পাহাড়ি রাস্তার আঁকেবাঁকে কতই না রহস্য চাপা পড়ে আছে! ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম শেরপাগাঁও মোড়ে। তাপমাত্রার পারদ রীতিমতো নেমে যাচ্ছে, তাই দেরী না করে ব্যাগে রাখা রেইন কোর্ট টা পড়ে ফেলি এরপর বাঁদিকের রাস্তা ধরে একটা অফরোড ধরে চলতে থাকি , তখন সন্ধ্যে নেমে আসছে, রাস্তাঘাটে যান-চলাচল খুবই কম বললেই চলে। ক্লান্ত শরীরে পৌঁছে যাই শেরপাগাঁওতে! তখন প্রায় সন্ধ্যে ৭ টা। যেই হোমস্টেতে উঠেছিলাম সেখান থেকে সামনে শুধু পাহাড় দেখা যায়!অন্ধকারে শুধু পাহাড়ের গায়ে ঘরবাড়িতে জ্বলতে থাকা আলো আবছা বোঝা যাচ্ছে, ব্যাগ পত্র রেখেই খিদের যন্ত্রণায় একবাটি ওয়াই ওয়াই সাবার করে নিলাম, তারপর একটু জিরিয়ে নিয়ে বাইরে যেতেই দেখছি হোমস্টের কর্ণধার অভিজিৎ সেন আগুন জ্বালিয়ে আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানোর জন্য প্রস্তুত, অভিজিৎ সেন সেদিন অনেক গান শুনিয়েছিল কারোকে তে! হোমস্টের বাইরে বসে প্রকৃতিকে উপভোগ করা, সত্যিই ভোলা যায় না! দূরে সব পাহাড়ের কোলে গ্রাম গুলোতে লাইটের আলো দেখা যাচ্ছে! মাঝে মাঝেই মেঘে ঢেকে যাচ্ছে চারিপাশ! বাইরে বসে কখন যে সময় কেটে গেলো বুঝতেই পারলাম না, রাতে খাবারে ছিল রুটি/দেশী মুরগীর মাংস/স্যালাড/আলুভাজা.. আর কি লাগে! খেয়ে নিয়ে বাইরে বসে আছি, অনুভব করছি প্রকৃতিকে, প্রকৃতির টানে কখন চোখ লেগে গেল বুঝে উঠতে পারলাম না!
পাহাড়ের সাথে আগাগোড়াই আমার এক নিবিড় সম্পর্ক, মাঝে মাঝে অনুভব করি যে এই সম্পর্ক হয়তো জন্মজন্মান্তরের! জীবনের যতো চড়াই-উতরাই সমস্তটাই শেখা এই পাহাড়ের কাছ থেকেই, সেই ছোটোবেলায় কবি সুনির্মল বসুর লেখা কবিতার উদ্ধৃতাংশটি ভাবি যে "পাহাড় শিখায় তাহার সমান- হই যেন ভাই মৌন-মহান্"! আমার কাছে পাহাড় শুধু একটি ঘোরার জায়গাতে সীমাবদ্ধ থাকেনা সে আমার কাছে সমস্ত রাগ, অভিমান, ভালোবাসা, অব্যক্ত কিছু বেদনা প্রকাশের জায়গা! প্রতিনিয়ত পাহাড়ের গায়ে কখনো তীব্র সূর্যের বিক্ষিপ্ত কিরণে স্ফটিক পরিস্কার রূপ নিচ্ছে আবার, কখনো মেঘাচ্ছন্ন করে তাকে সম্পূর্ণ ঢেকে রাখছে আবার, পূর্নিমার চাঁদের আলোয় তাকে রূপসী করে তুলছে! কিন্তু এই পাহাড় সেই একই ভাবে দন্ডায়মান! ছোটোবেলায় বাবা-মায়ের কোলে যে প্রশান্তি পেতাম সত্যিই পাহাড়ও যেনো আমায় ঠিক একইরকম প্রশান্তি প্রদান করে! ভাবছিলাম এই প্রকৃতিই তো মন-মাতানো, দৃষ্টিনন্দন, লেখক-কবি তৈরির সহায়ক হিসেবে অংশ নিয়েছে, এই প্রকৃতির সহায়তায় কতো কবি-লেখক ভাষা / শব্দ খুঁজে পেয়েছে, আর মানুষ পেয়েছে বাঁচার আশা, কতো পর্যটক এভাবে বুক ভরে অক্সিজেন এবং হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটাতে এখানে আসেন, এই অনুপম নৈসর্গিক, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, বৈচিত্র্য উপভোগ্য! সুপ্ত মনের প্রতি জায়গায়, মনের অজান্তেই আমরা প্রতিনিয়ত এঁকে চলেছি প্রকৃতির ছবি! মন হারায় অজানার দেশে! এগুলো ভাবতে ভাবতেই নীরবে চলে গেলাম ঘুমের দেশে, পরদিন সকালে পাখিদের সুমিষ্ট কলতানে ঘুম ভাঙল! প্রাতরাশের পর বিদায় জানালাম শেরপাগাঁওকে, বিদায় জানালাম নিভান্না হোমস্টেকে! ভালো থেকো পাহাড়, আবার দেখা হবে!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴