শুক্লা রায়ের আলোচনায় কবি সুজিত অধিকারীর কাব্য 'মনখারাপের অনুচ্ছেদ'
শুক্লা রায়ের আলোচনায় কবি সুজিত অধিকারীর কাব্য সংকলন 'মনখারাপের অনুচ্ছেদ'
"জীবনডাঙায় জল জমছে না ঠিকঠাক/ চারদিকে উষ্ণ বাতাস/ মাঝখানে ধরে আছি এক বুক ডিজিটাল মানুষ"............................................. সেতুর এপার ওপার, হাতে হাত বাড়ালাম/ জীবনডাঙায় জল নেই, আছে ডিজিটাল মানুষ"। (জীবনডাঙা) বর্তমান সময়কে ব্যখ্যা করার এর থেকে সহজ সরল কথা আর কী হতে পারে! 'মনখারাপের অনুচ্ছেদ' -কবি সুজিত অধিকারী, যাঁর কবিতার সঙ্গে পাঠক একাত্ম হতে পারে, যাঁর ভাবনার সঙ্গে পাঠক নিজের অনুভূতির সাযুজ্য খুঁজে পায়। আসলে তাঁর কবিতা পড়লে মনে হয়, আমাদের সত্তার উপর এক নিভৃত উচ্চারণ রেখে কবি বিদায় নিয়েছেন, অমৃতলোকে। তাঁর কবিতায় খেলা করে এক বিষাদ জ্যোৎস্নার মতো মনখারাপ। তাই তাঁর কবিতা গড়গড় করে বা দ্রুত লয়ে পাঠ করার নয়, নিজের গহীনে ডুব দিয়ে পাঠক নিজেই যেন বেজে ওঠেন কী এক অব্যক্ত কথামালার সুরে।
"নির্জনতার সাথে সমঝোতা করে/ আমি ফিরে আসি/ কান্ডে কান্ডে ফুটে আছে কান্ডজ্ঞানহীন মুখ/ আমাকে নিক্ষেপ করে দূরে নির্জনে/ সম্পর্কে রয়েছে মন, মাধুর্যে বিরতি/ প্রয়োজনে ঈশ্বরকে ভাগ করে নিই আমরা" (মনখারাপের অনুচ্ছেদ)।
কবিতা তো অনুভূতির মূর্ত রূপ। সেটা আরো ভালোভাবে অনুভব করা যায় সুজিত অধিকারীর কবিতায়। সময় ও জীবনকে তিনি যে দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছেন তারই প্রতিফলন ঘটেছে লেখায়। "এখানে মাদুর পেতে বাবা শুয়ে আছেন/ বুকে তাঁর অকৃতজ্ঞ সংসার" (বাবা)। তার পংক্তিগুলো মণি-মুক্তোর মতো উজ্জ্বল দ্যুতি নিয়ে হাজির হয় আমাদের মনের জগতে। চির চেনা পৃথিবীটাকে তিনি তাঁর মতো করে আমাদের চিনিয়ে দেন। 'কবিকে' কবিতাটায় যেন এক গম্ভীর বাস্তব নেমে আসে আমাদের মাঝখানে। "আজকাল মন খারাপ হলে জানালার ধারে দাঁড়াই না/ পাড়ার গন্ডগোলগুলো মাথায় ঝামেলা করে/ নদীর কাছেও দাঁড়াই না, বাবার ক্লান্ত শরীরটা দেখি/ বন্ধুদের ফোন করি, তাঁরা ছবি আঁকে নিজেরই/ কে কার দুঃখ বোঝে/ গাছের কাছে দাঁড়াই/ গাছ আর বাবা দুই আমাকে শান্তি দেয়" (কবিকে)। এভাবেই অক্ষরে অক্ষরে যেন তিনি এই সময়কে নির্মাণ করেছেন তাঁর নিজস্ব দর্শনে। "ব্যবহৃত জলের বোতল, উচ্ছিষ্ট ভাত, শালপাতা/ এসব কুড়োতে কুড়োতে অপু দুর্গা ঘুরছিল/ পিকনিক পেগ খেয়ে কয়েকজন যুবক" (অপু-দুর্গা)। দারিদ্র্য আর নির্মমতার চেনা ছবি তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। আবার অন্যদিকে জীবন ও মৃত্যুকে যিনি সহজভাবে নিতে পারেন তিনিই তো লিখতে পারেন এই অমূল্য কথাটি - "সোজাসাপটা চল পাখির মতো/ উড়তে যে পারে/ তার দিকে আকাশ মেলেছে রূপের ডানা" (মৃত্যুগামী)। কত বিচিত্র অনুভূতি, কত বিচিত্র তাঁর ভাবনা গেঁথে রয়েছে চাবুকের মতো কবিতার পাতায়। কবি সুজিত অধিকারী, সময়কে মূল্যায়ণ করেছেন তাঁর মেধাবী কলমে - "নিজের পরিবেশ বজায় রেখে দিন কাটাচ্ছি/ মিহি গলায় এপাশ ওপাশ দেখে দিন কাটানো ভালো.../পাড়ার দরজায় ছিটকিনি দিয়ে উপন্যাস পড়ি/ যারা জোর গলায় কথা বলে, তাদে পিছনে দাদাশক্তি/ মিহি গলায় একটা সরু চ্যানেল ধরে কোনওরকমে বেঁচে আছি" (চ্যানেল)।
চারটি কাব্য একসঙ্গে সংযুক্ত করে প্রকাশিত হয়েছে 'মনখারাপের অনুচ্ছেদ'। 'পাঠক' থেকে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন কন্যা সংস্কৃতিকে। অসাধারণ সব কবিতা পাঠের সুযোগ করে দেবে কবি সুজিত অধিকারীর কাব্য সংকলন 'মনখারাপের অনুচ্ছেদ'।
প্রকাশক : পাঠক
প্রচ্ছদ : দেবাশিস সাহা
মূল্য : 150
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴