শুক্লা রায় -এর আলোচনায় কবি উত্তম চৌধুরী -এর বই 'ব্যতিক্রমের বারান্দা'
শুক্লা রায় -এর আলোচনায় কবি উত্তম চৌধুরী -এর বই 'ব্যতিক্রমের বারান্দা'
'ব্যতিক্রমের বারান্দা' -নামটার মধ্যেই যেন এক কাব্যিক রূপ রয়েছে। কবি উত্তম চৌধুরী সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। চিকরাশি পত্রিকা উত্তরের এই বিশিষ্ট কবিকে নিয়ে ইতিমধ্যে কাজ করেছে। তাই উত্তরবঙ্গের সাহিত্যের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত আছেন তাঁরা কবি উত্তম চৌধুরী সম্পর্কে জানেনই। তাঁর দশপদী কবিতা পাঠকমহলে যথেষ্ট আদৃত হয়েছে। কবিতা নিয়ে তিনি যেন অনেকটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। বর্তমানে উত্তরের বিশিষ্ট কবিদের কবিতা ইংরাজীতে অনুবাদ করছেন ধারাবাহিকভাবে 'সহজ উঠোন' ওয়েব জিনে। এখানেও কবিতা নির্বাচন ও অনুবাদ দুটোতেই তিনি বিদগ্ধ জনের প্রশংসা পেয়েছেন, পাচ্ছেন। তাই একজন পাঠক হিসেবে কবি উত্তম চৌধুরীর নতুন কবিতার বইটি পড়ার আগ্রহ শুরু থেকেই ছিল আমার। এবং হাতে পেয়েই বুঝেছি বরাবরের মতো এই বইয়েও তিনি পাঠকের প্রত্যাশা পূরণ করেছেন। প্রথম কবিতাটিতেই পাঠক স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়বেন। 'চিঠি আরামগাঁর ঠিকানায়'। একটা সময় চিঠির জন্য প্রত্যেক মানুষের বুকের ভেতর একটা নিজস্ব অপেক্ষা থাকত। তাছাড়া মেইল আর হোয়াটসঅ্যাপের যুগ আসার আগে দূরের পত্রিকা সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগের একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল চিঠি। লেখা চেয়ে চিঠি এলে যে কোনো লেখক, কবির মনে একটা ভালোলাগার আবেগ কাজ করে। সেই আবেগটিই যেন নতুন করে ছুঁয়ে গেল 'চিঠি আরামগাঁর ঠিকানায়'। অথচ 'বুজরুক' কবিতাটে প্রকাশ পেয়েছে এক অন্যরকম বাস্তবতা। "আগুনের কথা আমাকে বোলো না আর, / অনেক আগুন দেখেছি অনেকবার/ মরে যেতে আর গজাতে নতুন মাঠে/ আগাছার মতো নুয়ে যেতে পথে ঘাটে/ আগুনেরা সব আগুনের কাছে এসে/ জ্বলে গিয়ে ছাই - বুজরুক অবশেষে।" -এই অসামান্য লাইনগুলিকে পাঠক নিজের নিজের বোধের ভাষায় ব্যাখ্যা করুন এবার আর অনোভব করুন কবিতার গভীরতা।
কখনো তাঁর কবিতা যেন পাঠককে একটা অন্য জগতে নিয়ে যায়। যেন এই পার্থিব জগত থেকে চোখ সরিয়ে অন্য কোনো ইপ্সিত জগতে। "আমাকে ভাসাও মেঘ আদিগন্ত/ আর তুলে দাও নিভৃতের চোখে।/ যে আলোকে দৃশ্য থেকে দৃশ্য খুলে যায়/ যে কথায় ফুটে ওঠে নিরক্ষীয় ফুল/ সে সবের সমতুল্য হতে মাথা নাড়ি।" কবিতাগুলোর মধ্যে এক অদ্ভুত জীবনবোধের সুর লেগে আছে। এমন কিছু যা দৃষ্টির ওপাড় থেকে ভেসে আসে কী এক ব্যঞ্জনা নিয়ে। পড়তে পড়তে মুগ্ধতার পাশাপাশি আমাদের ভাবনার গভীরেও তার স্পর্শ থেকে যায় এক স্নিগ্ধ অনুরণণ হয়ে। "কোনোওদিন - কোনও একদিন চোখের আকাশ থেকে/ ঝরে যাবে পথের দীর্ঘতা, মন থেকে সাময়িক/ মুখ আর বোধের গভীর থেকে ক্ষীণ পরম্পরা।/ ............................... কোনও একদিন বৃষ্টির দু'চোখ দিয়ে/ নাইতে গড়িয়ে যাব মোহনার দিকে।"
'চিকরাশি' পত্রিকার মতে উত্তরের সাহিত্য জগতের বটবৃক্ষ তিনি, তিনি অর্ণব সেন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কবি উত্তম চৌধুরীর এই সংকলনটিতে রয়েছে একটি মূল্যবান কবিতা, 'সমুদ্র-হৃদয়'। যথার্থই লিখেছেন - "আপনার দৃঢ় কাঁধ ছুঁয়ে/ নেমে আসছে বিচিত্র আকাশ:/ আমাদের মাটি, ঘাস/ যথার্থই পুষ্ট হয়ে ওঠে। ...........................আপনাকে ডুয়ার্সের আপামর/ মানুষেরা জানে।/ জানে কালজানি নোনোই, ডিমা/ কিংবা আংরাভাসা নদী।/ আপনি সমুদ্র-হৃদয় এক। সার্থক নাম।" উত্তরের সাহিত্য জগত সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল আছেন তাঁরা জানেন কতটা সঠিক ভাবে তিনি অর্ণব সেনকে বর্ণনা করেছেন তাঁর কবিতায়।
তাঁর কিছু কিছু কবিতায় ছায়া ফেলেছে বর্তমান সময় - "বাঁকা পথ, মিছরির ছুড়ি বড় বেশি/ দম চেয়ে বসে ধৈর্য আর সততার কাছে।" অস্বীকার করতে চাইলেও কিন্তু আমাদের যাপনে গেঁথে আছে এই অমোঘ শব্দমালা। অথবা আর একটি কবিতায় কতটা স্পষ্টভাষায় তিনি সময়কে বিঁধেছেন শব্দমালায় "শুধু এক বোতল থেকে আরেক বোতলে/ ঢুকে যাচ্ছে সময়/ শুধু এক হাত থেকে আরেক হাতে/ বদলে যাচ্ছে পতাকার রঙ।/ শুধু এক মুখ থেকে আরেক মুখে/ সরে যাচ্ছে ইস্তাহার, ময়দানের ভাষা।" অথবা আরেকটি কবিতায় ফুটে উঠেছে তাঁর তীক্ষ্ণ বিদ্রুপ, "বোঝা দায় মঞ্চের পেছনে নাটকে/ রং মেখে কারা কারা হাসে!"
'ইচ্ছেকণাগুলি' কবিতায় যেন প্রতিটা মানুষের অন্দরমহল এঁকেছেন শিল্পীর তুলিতে, "ভোরের স্বপ্নের ভেতর বেড়ে উঠছে/ অজস্র আকাশকুসুম, রামধনুচোখ/ আর গোলাপী নদীর মতো দীর্ঘ রিবন/ যা মায়াময় আলোর বুকে টেনে নিয়ে যায়।" আমাদের বুকের ভেতর যে স্বপ্নগুলি গোপনে ডানা মেলে সে সবের খবর বাইরের ক'জন আর জানে! অথচ জীবন যেরকম চলছে তার বাইরে জীবনকে আর একটু রঙিন করে ভাবতে আমরা প্রত্যেকেই ভালোবাসি।
বইটির কাগজ ও ছাপা খুব সুন্দর। হাতে নিলেই মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু ফেসবুকের মন্তব্যগুলি এমনকি পছন্দ কারা করেছেন সেগুলি পযর্ন্ত ছেপে দেওয়ায় আমার মনে হয়েছে এতে যেন বইটির মর্যাদা কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। যদিও এটা আমার ব্যক্তিগত মত। তবে পাঠক হিসেবে বলব কবি উত্তম চৌধুরীর এই কাব্য সংকলনটিও সংগ্রহে রাখার মতো একটি বই।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴