শুক্লা রায়-এর আলোচনায় রণজিৎ কুমার মিত্র-র 'স্মৃতি দিয়ে ঘেরা'
স্মৃতি দিয়ে ঘেরা/রণজিৎ কুমার মিত্র
আলোচক : শুক্লা রায়
আমরা যারা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি গ্রহণ করেছি, এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সবার কাছেই এক আগ্রহ ও আবেগের জায়গা। ‘সহজ উঠোন’ –এ যখন ধারাবাহিক ভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে ধারাবাহিক লেখার জন্য স্যার রঞ্জিত কুমার মিত্র কলম ধরলেন, তখন আমি জানি আমার মতো অনেকেই অধীর আগ্রহে সে কাহিনী পড়েছেন। তবে সে পড়া ছিল কতকটা বিচ্ছিন্ন। এক পর্ব শেষ হলে আরো এক সপ্তাহের অপেক্ষা পরের পর্বের জন্য। তাই বই রূপে যখন এই ধারাবাহিকটি হাতে এল তখন তা সমগ্র রূপে পাঠ করার প্রলোভন কিছুতেই ত্যাগ করা গেল না।
জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে তিল তিল করে বেড়ে উঠে ক্রমশ মহীরুহ হয়ে ওঠা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চলার পথটি মোটেও মসৃণ ছিল না। উত্তরবঙ্গের শিক্ষা মানচিত্রে বিপ্লব এনেছে যে বিশ্ববিদ্যালয়টি উদবোধনের দিনই তার পঠন-পাঠন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, ভারত-চীন যুদ্ধের কারণে। সেই সময়কার সমস্যা ও যুগান্তকারী বিভিন্ন সিদ্ধান্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে লেখকের বর্ণনায়। বিভিন্ন উপার্চাযের কার্যকালের নানান ঘটনাবলীসহ তাঁদের নিজের মতো করে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে গড়ে তোলার প্রয়াস ছাড়াও লেখক তুলে ধরেছেন সেই সময়কার ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের পাশাপাশি শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারিদের মধ্যে সামাজিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথাও। ধীরে ধীরে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজা রামমোহনপুর ক্যাম্পাসেরে পরিবর্তন ও বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠা বিভিন্ন শিক্ষক ও কর্মচারি সমিতির গড়ে ওঠা, কর্মচারিদের নিজস্ব কো অপারেটিভ সংস্থার পথ চলাও উঠে এসেছে তাঁর লেখনিতে। স্যার রঞ্জিত কুমার মিত্র নিজেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের দায়িত্ব সামলেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরের মানুষ হওয়ায় তাঁর পক্ষে বিভিন্ন ঘটনার খুঁটিনাটি জানা সম্ভব হয়েছে অনায়াসে, আর সেগুলোই তিনি অকৃপণভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর পাঠকদের কাছে।
নক্সাল আন্দোলনের অস্থির সময়টাও উঠে এসেছে তাঁর কলমে। এ বিষয়ে নিরপেক্ষভাবে ঘটনার বিবরণের পাশাপাশি তাঁর নিজস্ব অনুভূতিও প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করেননি তিনি। তিনি লিখেছেন ‘সবচেয়ে কষ্ট হয় সেইসব অগ্রজদের জন্য, যাঁদের আত্মত্যাগ, বিপ্লবের জন্য শ্রেণিকক্ষ ত্যাগ, সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন, সব অসম্পূর্ণ থেকে গেল। কেউ চলে গেলেন কারাগারের অন্তরালে, কেউ বা পুলিশের সাথে সংঘর্ষে নিহত হলেন। এঁরা হতে পারতেন মেধাবী দায়িত্বশীল অধ্যাপক, প্রশাসক, বুদ্ধিজীবীদের শিরোমণি।'
তবে নানান আভ্যন্তরীণ ঘটনাবলী বর্ণনার পাশাপাশি তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা ও জনজীবনও ধীরে ধীরে পাল্টে গেল। এখানকার জনজীবনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিও বদলে গেল অবধারিতভাবে। এই প্রসঙ্গে তিনি এই অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার নামের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন বিস্তারিতভাবে যা খুবই চিত্তাকর্ষক।
লেখকের সুনিপুণ বর্ণনায় কী না উঠে এসেছে! প্রথম সমাবর্তনের উত্তেজনা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের আগমণ, তাঁদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ -সবকিছু। উপাচার্যগণের কার্যকালের মেয়াদসহ তাঁদের ভূমিকা, শিক্ষক-কর্মচারিদের সঙ্গে সম্পর্ক -সবই লেখকের বর্ণনায় গুরুত্বসহ স্থান পেয়েছে। এমনকি শিক্ষক ও কর্মচারি সমিতির স্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি, তাদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দও তিনি অকপটে তুলে ধরেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশনা বিভাগ নিয়েও লেখক তাঁর নিজস্ব মতামত জানিয়েছেন। আলোচনা-সমালোচনার মাঝে কিছু মজার ঘটনাও পাঠকের আকর্ষণ ধরে রাখবে এই বইটি। জলপাইগুড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার সরকারি বাসটি, তার প্যাসেঞ্জারবর্গ আর আশপাশের পথের বিবরণ ও ঘটনাবলীর বর্ণনা আনন্দদায়ক।
তবে আলোচনার সর্বত্র যেমন লেখক নিরপেক্ষ থাকতে পারেননি, তাঁর নিজস্ব মতামতও স্থান পেয়েছে বিভিন্ন জায়গায়, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান সংঘাত, স্বার্থ দ্বন্দ, উত্তর-দক্ষিণের সংস্কৃতি সংঘাতও তুলে ধরেছেন সুকৌশলে। সবমিলিয়ে বইটি আবেগ ও তথ্যের এক অভিনব মিশেল। উপরি পাওনা হিসেবে সংযুক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো ও অন্যান্য কিছু মূল্যবান ছবি। পরিশিষ্ট অংশে সংযোজিত করেছেন প্রথম সমাবর্তনে আচার্য পদ্মজা নাইডুর ভাষণ এবং প্রধান অতিথি ভি. কে.আর.ভি.রাও এর ভাষণ। উৎসাহী পাঠক পড়ে নিতে পারেন।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴