শুক্লা রায়-এর আলোচনায় মৈনাক ভট্টাচার্য-র বই 'ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর'
শুক্লা রায়-এর আলোচনায় মৈনাক ভট্টাচার্য-র বই 'ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর'
ভাস্কর্য বিষয়ে আমি নিজে মোটেও শিক্ষিত নই। তাই খুব আগ্রহ নিয়েই হাতে তুলে নিয়েছিলাম একাধারে ভাস্কর ও সুলেখক মৈনাক ভট্টাচার্যের বই 'ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর'। লেখকের সমৃদ্ধ আলোচনা বইটির দিকে সাবলীলভাবে আমার মনোযোগ টেনে নিয়েছে। আমরা যারা সাধারণ চোখে কোনো ভাস্কর্য দেখি তা আমাদের ভালো লাগে ঠিকই, কিন্তু তার সঠিক রূপ ও রস আস্বাদন করতে হলে অবশ্যই আমাদের চোখকে কিছুটা হলেও শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। যারা এই বিষয়ে সামান্যতম হলেও আগ্রহী -এই বই তাদের জন্য।
আলোচনার শুরুতে প্রথমেই তিনি রেখেছেন রামকিঙ্কর বেইজ -এর নাম। সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত এই অসাধারণ শিল্পীর বিভিন্ন কাজ ধরে ধরে আলোচনায় এনেছেন লেখক। রামকিঙ্কর বেইজ এর বিখ্যাত শিল্পকর্ম 'সুজাতা' -র জন্ম বৃত্তান্ত থেকে শুরু করে এই সৃষ্টিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিতর্ক পর্যন্ত আলোচনায় এসেছে। এবং এই একটি শিল্পকর্মই রামকিঙ্কর বেইজের শিল্পী জীবনের মোড় ঘুরে যায়। গুরুদেবের নির্দেশে পুরো আশ্রম ধীরে ধীরে রামকিঙ্করের তৈরি নানান ভাস্কর্যে ভরে উঠতে থাকে। 'সাঁওতাল পরিবার', 'কলের বাঁশি',। এইসব ভাস্কর্য তৈরির নানান প্রতিকূলতা সহ শিল্পের খুঁটিনাটি অনেক বিষয়ই তিনি আলোচনায় রেখেছেন। দিল্লিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে নির্মিত অতিকায় 'যক্ষ-যক্ষী' নির্মাণের বিস্তৃত বর্ণনা পাঠককে আগ্রহী করে তুলবে। তবে তাঁর 'পোয়েটস হেড' নির্মাণের কথা পাঠকের কাছে গল্পের মতো মনে হবে। কীভাবে গুরুদেবকে একটুও বিরক্ত না করে তাঁকে মগ্ন পর্যবেক্ষণের পর তিনি নির্মাণ করেন 'পোয়েটস হেড' তার বিস্তারিত বর্ণনা স্থান পেয়েছে উৎসাহী পাঠকদের জন্য।
এরপরে লেখকের আলোচনায় স্থান পেয়েছে নাগেশ যবলেকরের 'শ্যামবাজার পাঁচ মাথা মোড়ের অশ্বারূঢ় নেতাজী'। তবে এই মূর্তি সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য অনেকটাই নেতিবাচক। মূর্তিটি তৈরি হয়েছিল আইরিশ ভাস্কর জন হেনরি ফলির নির্মিত ভাস্কর্য আউট্রামের ঘোড়ায় চেপে বসার অনুকরণে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিষয়টি অন্ধ অনুকরণে পর্যবসিত হয়ে মূর্তির সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে গেল। লেখক এখানে দুটি মূর্তির তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে ত্রুটিগুলিকে সুন্দরভাবে আলোচনা করেছেন যা হয়ত আমাদের সাদা চোখে ধরা পড়ত না।
একে একে আলোচনায় এসেছে ভাস্কর রায়চৌধুরীর ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য 'ট্রায়াম্প অফ লেবার'। এই শিল্পকর্মটি আলোচনা করতে গিয়ে তিনি ভাস্কর্যের নির্মাণের বিভিন্ন ধারা নিয়েও আলোচনা করেছেন, আলোচনা করেছেন শিল্পির কাজ নিয়েও। 'চারজন মানুষ মিলে একটা পাথর ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। পেশীবহুল শ্রমছন্দের মননে নিজেকে আন্দোলিত করছে ভাস্কর্যের চেতনা। চেন্নাইয়ের মেরিনা সৈকতে যদি এক পলক উদাস হাওয়ার মতো 'ট্রায়াম্প অফ লেবার' ভাস্কর্যটির সামনে মনকে ভাসাতে পারেন আপনিও আন্দোলিত হয়ে উঠবেন এই ভাস্কর্য চেতনায়।" এই ভাস্করের আর একটি বিখ্যাত শিল্পকর্মকেও তিনি আলোচনায় এনেছেন -'ডান্ডি অভিযান'। বইটি হাতে নিলে পাঠক এর বিস্তৃত বর্ণনার স্বাদ আস্বাদন করবেন।
একে একে আলোচনায় এসেছে চিন্তামণি কর -এর নির্মাণ 'জাস্টিস', গোপেশ্বর পালের ভাস্কর্য 'বেলুড় মঠের রামকৃষ্ণ', সত্যনাথা মুথাইয়া গনপতির 'হুসেন সাগরের বুদ্ধ'।
এরপরে তিনি এক বিস্তারিত আলোচনায় তুলে ধরেছেন 'ডোকরা' শিল্পের কথা। পশ্চিমবঙ্গে 'ডোকরা' শিল্পের প্রসার থেকে 'ডোকরা' শিল্পের উদ্ভবের সম্ভাব্য স্থান ও সময়ের কথাও উল্লিখিত রেখেছেন। মীরা মুখোপাধ্যায়ের 'ডোকরা' শিল্পের প্রতি আগ্রহ ও ছত্তিশগড় থেকে ধাতু ঢালাই শিখে এসে কীভাবে শিল্পকর্মে নিমগ্ন হলেন তার একটি অনুপ্রেরণামূলক আলোচনা বইটিকে নিঃসন্দেহে আর্কষণীয় করেছে।
এরপরে তিনি আলোচনায় রেখেছেন সোমনাথ হোর -এর শিল্পকর্ম। তাঁর ব্রোঞ্জের তৈরি 'রবীন্দ্রনাথ', 'ভিয়েতনামের মা' নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা। তবে যেটা খুব বেদনাদায়ক তা হল 'ভিয়েতনামের মা' কাজটি শেষ করতে দু'বছর লেগেছিল শিল্পীর। শেষ করেছেন ঊনিশশো সাতাত্তরের তেসরা নভেম্বর, আর সেই রাতেই এই বিখ্যাত শিল্পকর্মটি চুরি হয়ে যায়।
বইটির প্রতিটি পরিচ্ছেদেই শিল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভাস্কর্যে রঙের প্রভাব, আলো-ছায়ার পরিমাপ। এত স্বল্প পরিসরে সম্পূর্ণ আলোচনা সম্ভব হল না। তবু আশা করছি আগ্রহী পাঠক বইটির গুরুত্ব ও বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব সম্পর্কে একটি ধারণা পেয়েছেন। বাকিটুকু জানতে হলে অবশ্যই বইটিকে নিজস্ব পাঠের তালিকায় রাখতে হবে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴