শুক্লা রায়-এর আলোচনায় ডঃ রূপন সরকার-এর বই 'গোঁসাই-মিত্রার ডুয়ার্স ভ্রমণ'
শুক্লা রায়-এর আলোচনায় ডঃ রূপন সরকার-এর বই 'গোঁসাই-মিত্রার ডুয়ার্স ভ্রমণ'
ডুয়ার্স মানে নিছক পাহাড় জঙ্গল ঘেরা মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা একটি ভুখন্ড মাত্র নয়। ডুয়ার্স মানে একটি সমৃদ্ধ জনপদ, নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক একটি বহু জনজাতি অধ্যুষিত জনপদ। নিজস্ব ভাষা ও জীবন ধারার এক আশ্চর্য বৈচিত্রময় জনগোষ্ঠিতে পরিপূর্ণ একটি সজীব মানচিত্র। অধ্যাপক রূপন সরকার তাঁর 'গোঁসাই মিত্রার ডুয়ার্স ভ্রমণ' বইটিতে এমন বিষয়েই আমাদের সচেতন করেছেন। আটপৌরে জীবন থেকে কথায় কথায় ডুয়ার্সের মানচিত্রকে তুলে এনেছেন অনেকটাই অন্যরকমভাবে। তথ্যসমৃদ্ধ অথচ তা ভারাক্রান্ত নয়। এমন একটি বই লেখার জন্য যথেষ্ট মুন্সিয়ানা প্রয়োজন। অধ্যাপক সরকার তা প্রমাণ করেছেন। নিজে একজন শিক্ষক হিসেবে প্রথমেই তিনি তাঁর মহাবিদ্যালয়ের পরিবেশ তুলে ধরেছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে ছাত্রীদের মানিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা, হতাশা ও কর্মহীনতার আতঙ্ক নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর লেখায়। শুরুটা যে বেদনাবোধ দিয়ে শুরু হয়েছে গোঁসাই মিত্রার সারাটা ভ্রমণ পথই সেই বেদনার অনুভূতিকে ধরে রেখেছে। তার ফাঁকে ফাঁকে যেন কতকটা ছা-পোষা মানুষের মতো রোজকার কষ্টকে পাশ কাটিয়ে আনন্দকে গ্রহণ করা, সেভাবেই পাঠক গোঁসাই মিত্রার সঙ্গে সঙ্গে পথ চলবেন ডুয়ার্স ও ডুয়ার্সের জীবনকে চিনে নিতে নিতে। প্রথম যাত্রা শুরু হল লাটাগুড়ি, খুনিয়া মোড় হয়ে ঝালং এর পথে। পাঠক লাটাগুড়ি ওভারব্রিজ পেরিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করতে না করতেই পরিবেশের ঠান্ডা আমেজ অনুভব করবেন আর তার সঙ্গে ঘন্টা পোকার আওয়াজ। পরিবেশের নিখুঁত বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে পাঠক অনুভব করবেন ডুয়ার্সের পর্যটন নিয়ে সরকারি, বেসরকারি সব তরফের উদাসীনতা। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা হল ডুয়ার্সের ট্যুরিজমের ইমেজ বিল্ডিং। এ বিষয়টির ব্যাখ্যাও লেখক নিজেই দিয়েছেন, "ইমেজ বিল্ডিং মানে বিশ্ববাসীর কাছে ডুয়ার্সকে তুলে ধরা, সুইৎজারল্যান্ড, মরিশাস এমনকি থাইল্যান্ড, বলতে পারো আমাদের গোয়া, পদুচেরী যেভাবে বা যতটা প্রচার পেয়েছে, ডুয়ার্স কোনোদিন তা পায়নি। অথচ ডুয়ার্সের এমন সব জায়গা আছে যা, যে - কোনো ভ্রমণপ্রিয় মানুষের স্বপ্নের জায়গা হতে পারে।"
লেখকের আক্ষেপ ডুয়ার্স সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণাটুকুও না নিয়ে অনেক পর্যটক এদেশে বেড়াতে আসেন এবং তারপর হতাশ হন। এতে যেমন ডুয়ার্সের পর্যটন নিয়ে তাঁরা একটা খারাপ ধারণা নিয়ে ফেরেন, ডুয়ার্সের পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত মানুষজনও বিড়ম্বনার সম্মুখীন হন।
যাইহোক এসব গুরুগম্ভীর কথার মাঝেই ডুয়ার্সের পথকে ছুঁয়ে, ডুয়ার্সের রাজনীতি ও ইতিহাসকে ছুঁয়ে গোঁসাই-মিত্রা পৌঁছে যায় বিখ্যাত খুনিয়া মোড় -এ। ডুয়ার্সবাসী মাত্রি জানেন এই খুনিয়া মোড়ের আকর্ষণ। এর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে লেখক অমিত কুমার দে -এর বই 'খুনিয়ামোড় এবং'। এখান থেকেই তাঁরা রওনা দিলেন বিন্দু ঝালং -এর পথে। পাঠক এই পথটিও যেন মানস চক্ষে দেখতে দেখতে চলবেন। তবে ভ্রমণ উপন্যাস কেবলমাত্র নিরস ভ্রমণ বৃত্তান্ত হলে তা মোটেও সুখপাঠ্য হয় না। সেদিক থেকে 'গোঁসাই-মিত্রার ডুয়ার্সভ্রমণ' অবশ্যই ব্যতিক্রম। পথে নামলে নতুন পথ চেনার সঙ্গে সঙ্গে পাশের চির চেনা সঙ্গীটিকেও নতুন করে আবিষ্কারের নেশা মানুষকে পেয়ে বসে, পেতেই পারে। আমরা যারা রোজকার জীবনের গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ মাছের মতো ছটফট করি আমযা তা বুঝি। বাইরের খোলা হাওয়া কীভাবে মনকে হালকা এবং আলগা করে। গবেষকের দৃষ্টিতে নয়, এই বই লেখা হয়েছে উপন্যাসের মতো, কিছুটা তথ্য, তত্ত্ব এবং অবশ্যই রোমান্টিকতার পরিমিত মিশ্রণে। সেজন্যই বইটি পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য। ভ্রমণ নিছক ভ্রমণ থাকে না যখন গোঁসাই-মিত্রার সাংসারিক আলাপচারিতায় ঢুকে যায় ডুয়ার্সে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন গণ আন্দোলন। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন থেকে নক্সাল আন্দোলন, তার পরিপ্রেক্ষিত এবং চাওয়া পাওয়ার হিসেব নিকেশও সুক্ষ্মভাবে ধরা থাকে সহজ আলোচনায়। একটি সম্ভবনাময় ইতিহাসের কথা ও আক্ষেপ ফুটে ওঠে কথায় কথায়।
অধ্যাপক রূপন সরকার বইটিকে উপন্যাসের আকার দিলেও তাঁর গবেষণালব্ধ ফলের প্রকাশ বইয়ের সর্বত্র। "ডুয়ার্স এমন একটি ভৌগোলিক অঞ্চল, যেখানে কয়েক কদম পর পর জনবসতির চরিত্র পাল্টে যেতে থাকে। নানা জনজাতির বসবাস এতদঞ্চলে। তরাই ডুয়ার্সকে নৃতত্ত্বের জাদুঘরও বলা যেতে পারে।" এটা সত্যি কথা বহু জনজাতি অধ্যুষিত ডুয়ার্স নৃতত্ত্বের একটি সমৃদ্ধ উৎস। এইসব জাতি গোষ্ঠির প্রত্যেকের উৎস ও সংস্কৃতি আলাদা আলাদা। তাঁরই কয়েকটির উৎস সন্ধান এই বইয়ে পাওয়া যায়। মিত্রার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে গোঁসাইয়ের ভাষায় লেখক বলেন, "ধরো ওড়াওঁ, ওড়াওঁদের উৎপত্তি সম্পর্কে একাধিক মতামত আছে। একটি মত, ওড়াওঁরা নিজেদের 'কুরুখ' বলে পরিচয় দেয়। কিংবদন্তি অনুসারে 'কুরুখ' ছিলেন প্রাচীনকালের একজন শক্তিশালী রাজা। ওড়াওঁরা এই রাজার বংশধর বলে নিজেদের মনে করেন। আবার অনেকে মনে করেন, প্রাচীনকালের কঠোর তপস্বী 'উরাগাঁত ঠাকুর' বা উড়াওঁ থেকে ওড়াওঁ জাতির উদ্ভব।" এসব নানান তথ্য সমৃদ্ধ আলোচনা বইটিকে একটি অনন্য মর্যাদা দান করেছে। এভাবে ডুয়ার্সের বিভিন্ন জনগোষ্ঠির বিষয়ে লেখকের বিস্তারিত আলোচনা পাঠককে সমৃদ্ধ করবে। তবে শুধু জ্ঞানগর্ভ আলোচনা থাকলে পাঠক হয়ত একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ত। কিন্তু চমকে উঠবে যখন পড়বে "একবোতল হাড়িয়া আর খান কয়েক আটার রুটি" একটি ওড়াওঁ বালককে তার মা দুপুরের টিফিন হিসেবে সঙ্গে দিয়েছেন। এটাই ডুয়ার্সের সংস্কৃতির বৈচিত্র।
ডুয়ার্সের মূল যে বিষয় ডুয়ার্সের প্রকৃতি ও পরিবেশ -অনেকটাই জায়গা করে নিয়েছে গোঁসাই-মিত্রার কথোপকথনে। উঠে এসেছে উত্তরের নদীগুলির কথা। নদী ঘিরে গড়ে ওঠা জনজীবন। ডুয়ার্সের প্রাকৃতিক খামখেয়ালের সঙ্গে নদীগুলিও তালমিলিয়ে কেমন নিজেদের চরিত্র পাল্টে পাল্টে নেয়। বইটি হাতে পেলে নিঃসন্দেহে প্রতি ঋতুতে ডুয়ার্সকে আলাদা আলাদা করে চেনার আগ্রহ বাড়বে পর্যটকদের। তবে যারা শুধুমাত্র হুল্লোড় করতে বেড়াতে আসেন তাদের কথা আলাদা। লেখকের কলমেও যেমন উঠে এসেছে তেমনি এখানকার অনেক ভ্রমণ পিপাসু মানুষই জানেন, আজকাল ডুয়ার্সে বেড়াতে আসেন কিছ মানুষ, তারি রাত জেগে উচ্চকিত গান বাজিয়ে, নারী পুরুষ নির্বিশেষে মদ্যপান করে বেড়ানোটা 'এনজয়' করেন। ডুয়ার্স কিন্তু এই সব মানুষদের জন্য নয়। পাঠক ডুয়ার্সের এইসফ নানান ঘটনা ও সমস্যার কথা জানতে জানতেই বেড়ানোর একটা রুট ম্যাপও পেয়ে যাবেন। ডুয়ার্সে বেড়াতে এলে যেমন পাহাড় জানবেন তেমন চাবাগানকে জানতে হবে। ডুয়ার্সের বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে চাবাগান। এই আবাগান সমহ ও তার সঙ্গে যুক্ত মানুষজনকে বাদ দিয়ে ডুয়ার্স অসম্পূর্ণ। ডঃ রূপন সরকার চাবাগানের সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে সচেতন করেছেন বাগানের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের দুর্দশাময় জীবন, কঠিন যাপনচিত্র। অভাব ও দারিদ্র্যের সঙ্গে অবধারিতভাবে এসে মিশেছে হিউম্যান ট্রাফিকিং।
বইটিতে দুটোভাগে লেখক সম্পূর্ণ ডুয়ার্সে পথ ও জনপদের এক আশ্চর্য হদিশ দিয়েছেন। সম্পূর্ণ বইটি পাঠের জন্য আগ্রহী পাঠকদের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করে আমি শুধু একট রূপরেখা তুলে ধরলাম। আশাকরি বইটি আরো জনপ্রিয়তা পাবে।
গোঁসাই-মিত্রার ডুয়ার্স ভ্রমণ
রূপন সরকার
প্রকাশক - সোপান
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴