শুক্লা রায়-এর আলোচনায় অমিত কুমার দে -র কাব্য সংকলন 'প্রেমের কবিতা'
শুক্লা রায়-এর আলোচনায় অমিত কুমার দে -র কাব্য সংকলন 'প্রেমের কবিতা'
সম্প্রতি চন্ডালবুকস থেকে বেরিয়েছে কবি অমিত কুমার দে-এর প্রেমের কবিতা। সাতান্ন বছর বয়সী কবির প্রেম শরীরী নাকি অশরীরী আপাতত এই বিতর্ককে মুলতুবী রেখে আমরা বরং তাঁর কবিতায় ডুব দিই। কবি অমিত কুমার দে -যিনি ডুয়ার্সের কবি নামেই অধিক পরিচিত। শুধুমাত্র কবি নয়, তাঁর উপন্যাস ও বিভিন্ন গদ্যরচনাও অত্যন্ত সুখপাঠ্য। একজন কবি ভালো গদ্যও রচনা করতে পারেন -এই কথাটির সত্যতা তাঁর গদ্য রচনা পড়লে স্পষ্ট অনুভূত হয়। যাইহোক তাঁর এই প্রেমের কবিতা সিরিজে মোট চোদ্দটি কবিতা রয়েছে। কবিতাগুলি পড়লে কখনও কখনও মনে হয় তাঁর প্রেমিকা রক্তমাংসে গড়া একজন সাধারণ মানবী যাকে কবি তাঁর কল্পনার তুলিতে রঙ মিশিয়ে অসামান্য করেছেন। আবার কখনও মনে হয় এসব কিছুই নয়, কবির প্রেমিকা আমাদের চিরচেনা ডুর্য়াস -ডুয়ার্স সুন্দরী। "ক্যানভাস জুড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা জেগে উঠলে/ আমি শুধুমাত্র তোমার জন্য ভোরের বন্দিস গাই।(কাঞ্চন ভোর)"। কবিতাগুলির কোনোটাই আমার পূর্ব পঠিত নয়। আনকোরা নতুন কবিতায় কবি এই কাব্যগ্রন্থটি সাজিয়েছেন। এবং আর একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় কবি সম্ভবত সচেতনভাবেই দু'ধরণের কবিতা রেখেছেন এই সংকলনে। ছন্দবদ্ধ কবিতা ও গদ্যছন্দের কবিতা। ছন্দবদ্ধ মানেই যে তা কেবল শিশুভোলানো ছড়া নয়, ভাবগম্ভীর কবিতাও হতে পারে তা তাঁর কবিতাগুলো পড়লেই বোঝা যায়। শিশুদের জন্য লেখা ছড়া ও ছন্দবদ্ধ মননশীল কবিতার মধ্যে তিনি এক সুস্পষ্ট সীমারেখা টেনেছেন। 'প্রেমের কবিতা' বইটিতে তিনি দু'ধরনের কবিতাই রেখেছেন। তাই পাঠক পড়ার সময়ে একটা বৈচিত্র্য অনুভব করবেন যা পাঠকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলবে।
কবির প্রেম বলতে আমরা তাঁর রাজেশ্বরীকেই চিনি। কবির নিজস্ব নির্মাণ। এতদিনে তাঁর পাঠকমহলে রাজেশ্বরীর একটি পূর্ণাবয়ব মূর্তিও তৈরি হয়েছে, যদিও তা নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা কাটেনি। রাজেশ্বরী কোনো রক্ত-মাংসের মানবী নাকি আমাদের এই সুন্দরী ডুয়ার্স। এই বিতর্ক সম্পূর্ণ পাঠকের বোধের উপর ছেড়ে দিয়ে কবি একের পর এক প্রেমের কবিতা উৎসর্গ করে গেছেন তাঁর মানস প্রতিমাকে। নিখাদ প্রেম বলতে যা বোঝায় সেই প্রেমের আবেশে ডুব দিতে গিয়েও পাঠক তাঁর কবিতায় একটা সুস্পষ্ট জীবন বোধ এবং স্বতন্ত্র জীবন দর্শন খুঁজে পাবেন, যা তাঁর প্রেমের কবিতাগুলিকে অনন্য করে তুলেছে। নিছক প্রেম নয় যেন সমগ্র জীবন ধরা পড়েছে টুকরো টুকরো ছবিতে। "রাজেশ্বরী, মুক্তির পথ একটা বড় সড়কের মতো/ দুটো বাঁক নেবার পর দেখবে পেছনে কেউ নেই/ একটা অবধারিত ল্যাম্পপোস্ট/ অলীক মানুষের মতো বিলুপ্ত বিলীন/ আলোটার কী রঙ ছিল, লাল কী হলুদ/ কয়েকটা স্টপেজ শেষে মনেও পড়বে না/ এভাবেই ফেরা যায়, ফিরে যাওয়া যায়" (প্রত্যাবর্তন)। চিরন্তন এই বাক্যসমুহ একজন প্রেমিকের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে কত সহজে। 'দুর্গা-টুনটুনি' কবিতায় তিনি আরো সহজ ভাষায় জীবনকে সহজে গ্রহণ করার কথা বলেছেন "যতটা সহজের কাছে যেতে চাইছি আমরা/ ততটাই দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছি কেন!/ তুমি কোন চাঁদে পা নামাতে নামাতে/ ছিটকে পড়ছ সমান্তরালের বাইরে(দুর্গা-টুনটুনি)।"
প্রকৃত প্রেম মানুষকে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে দেয়। হৃদয়ের পূর্ণতা এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরিয়ে রাখে সবকিছু। প্রেম তখন ব্যক্তিগত গন্ডির সীমা পেরিয়ে সর্বজনীনতা লাভ করে তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে। "রাজেশ্বরী, তোমাকে দেবপ্রয়াগের কাছে/ আজ যখন হাত ধরে পৌঁছে দিচ্ছিলাম/ তুমি তখন সুন্দরের সর্বশেষ সঙ্গীত গাইলে/ আর আমি ক্রমাগত ঈশ্বর হয়ে উঠলাম।" (ঈশ্বর ঈশ্বরী) প্রেমের এই পরম পূর্ণতা পাওয়ার পর কিইবা চাইবার থাকে! মানুষ তখন নিজেই ঈশ্বর হয়ে যায়।
কবির ছন্দ কবিতাগুলির উল্লেখ না করলে বইটির আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কারণ বইটির অন্যতম বিশেষত্ব এই ছন্দ কবিতাগুলি বলেও আমি মনে করি। "তুমি তখন পাহাড় ছুঁয়ে ছিলে/ তুমি তখন আস্ত একটা ঝোরা/ হয়তো তুমি ভিষণ কাছেই আছ/ কিংবা গহীন মেঘচাদরে মোড়া!"(পাহাড়িয়া) তাঁর কবিতায় এক অপূর্ব চিত্রকল্প ফুটে ওঠে। ভাষার জটিলতা নেই, অনর্থক কঠিন শব্দের বাড়াবাড়ি নেই। সহজ-সরল এক সাবলীল গতিপথে ফুটে ওঠে কবিতার মাধুর্য। "গ্রামীণ একটা উনুন ঘিরে অনেকগুলো হাত/ আধখাওয়া চাঁদ জানান দিল - রাত হয়েছে, রাত/ রাতের পাশে বাজতে থাকে গ্রাম্য একটা ঘড়ি/ বুকের কাঁটায় ঘুরতে থাকো আমার রাজেশ্বরী!" (চাঁদপুকুর)। আবার পাঠকের নস্টালজিয়া ছুঁয়ে যাবে কবির অপূর্ব শব্দমালা "তোমার যেসব গরুর গাড়ি/ হারিয়ে গেছে সে কোন হাটে/ সন্ধে ছুঁয়ে ফিরবে তারা/ আবার তোমার রাজ্যপাটে।"(পদ্মবাড়ি)। ছন্দ তাঁর নিজস্ব বিচরণ ক্ষেত্র। তাই প্রতিটি ছন্দ কবিতা যথাযথ মর্যাদায় ফুটে উঠেছে এই সংকলনটিতেও। আকারে ছোট হলেও সাহিত্য গরিমা ও কাব্য সুষমায় বইটি একটি মর্যাদাপূর্ণ সংকলন। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলির মতো এই বইটিও পাঠকপ্রিয় হবে বলেই আমার বিশ্বাস।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴