শিলাইদহের চিঠি/রণজিৎ কুমার মিত্র
শিলাইদহের চিঠি
রণজিৎ কুমার মিত্র
শ্রীচরণেষু বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শিলাইদহ কুঠিবাড়ি
কুষ্টিয়া জেলা (সাবেক নদীয়া জেলা) বাংলাদেশ
আপনাকে চিঠি লিখবার দুঃসাহস করে ফেললাম। আপনার চিঠি তো অনবদ্য শিল্পকর্ম। আজকাল এই শিল্পকর্মটিই মেইল ইন্টারনেটের তাড়নায় লুপ্ত হতে বসেছে। আপনি ভারী সুন্দর করে লিখেছিলেন, "চিঠি জিনিসটা ছোট্ট মালতী ফুলের মতো কিন্তু সেই চিঠি যে আকাশের মধ্যে ফুটে ওঠে সেই আকাশ মালতী লতার মতই বড়। "বাংলাদেশ ঘুরতে ঘুরতে এই শিলাইদহে এসে আপনার চিঠির কথা খুব মনে পড়ে গেল। আপনার 'ছিন্নপত্রাবলী'র পত্ররা কুঠিবাড়ির প্রাঙ্গণে কেমন মালতী ফুলের মতো ফুটে আছে, দেখবার ভারী সাধ হয়েছিল।
কুচবিহার ট্রাভেলসের সাথে বাংলাদেশ বেড়াতে গিয়ে শিলাইদহে যখন ঢুকলাম তখন ফাগুন মাসে দুপুরের চড়া রোদ। তবুও পরিমরি করে ছুটে ছিলাম আপনার কুঠিবাড়ির প্রাঙ্গনে। বড় সুন্দর আপনাদের এই কুঠিবাড়ি। মেহগনি, শালকাঠ আর টিনের চাল দিয়ে তৈরি সুদৃশ্য এই কুঠিবাড়ি। এই গ্রামেরই পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদী, ওপারে পাবনা জেলা। সেই জেলারএকটি প্রত্যন্ত গ্রাম ঘোপশীলনদাতে আমাদের সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছিল। সেসব অনেক দুঃখের বৃত্তান্ত জমিদার বাবু। এখানে বসে ভাইঝি ইন্দিরাকে আপনি চিঠিতে লিখেছিলেন -"পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়। এই যে ছোট নদীর ধারে শান্তিময় গাছপালার মধ্যে সূর্য প্রতিদিন অস্ত যাচ্ছে এবং এই অনন্ত ধূসর নির্জন নিঃশব্দ চরের উপরে প্রতি রাত্রে শত সহস্র নিঃশব্দ অভ্যুদয় হচ্ছে জগত সংসারে, এযে কী একটা আশ্চর্য মহৎ ঘটনা, তা এখানে থাকলে তবে বোঝা যায়।" সত্যিই এখানে যে থাকেনি তার মহিমা কীভাবে বোঝানো যাবে। আমার মেয়াদ ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার, সঙ্গী ট্যুর ম্যানেজারের নামতা পড়ার মতো ঘ্যানঘ্যানানি, 'বেশি দেরি করবেন না'। তবুও চেষ্টা করলাম এই জায়গাটার মাহাত্ম্য সম্পর্কে আপনার ভাইঝির কাছে লেখা চিঠিতে যা লিখেছেন, তার সবকিছু পরখ করতে। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে এই কুঠিবাড়িতে আপনি স্থায়ীভাবে সংসার পাততে এসেছিলেন, সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, কন্যা রেনুকা, মীরা আর পুত্র রথীন্দ্র আর শমীন্দ্রকে নিয়ে। ছেলে মেয়েদের শিক্ষার জন্য এই কুঠিবাড়িতেই বিদ্যালয়ের স্থাপন করেছিলেন। জমিদারি সেরেস্তা থেকে জগদানন্দ রায় ও হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সিলেট থেকে এসেছিলেন পন্ডিত সিদ্ধান্ত বিদ্যার্ণব এবং বিলেত থেকে পাগলা সাহেব লরেন্স। তবে শুনেছি এই কুঠিবাড়িতে আপনার নাকি মন টিকত না , মাঝে মাঝেই ছুটে যেতেন পদ্মা নদীর উপর বোটের জলনিবাসে। সেইসব বোটর নাম ছিল 'পদ্মা '-'চিত্রা' 'নাগরবোট'- 'আত্রাই' আর 'লাল ডিঙ্গি'। শুধু 'আশমানদারী' নয় কত কাজ করেছেন আপনি এখানে।আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ, দাতব্য চিকিৎসালয়, সমবায় আন্দোলন, গ্রামীণ মেলা, লোকসাহিত্য সংগ্রহ, আপনার এসব কাজের কথা লোকে বেশি জানে না। আপনার ছেলে রথীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন - "পদ্মাবোটে বাবা থাকতে খুব ভালোবাসতেন, সুযোগ পেলেই চলে যেতেন তার প্রিয় পদ্মা বোটে। পরিবেশের অহরহ পরিবর্তন তাঁর কল্পনা প্রিয় মনকে খোরাক জোগাত।"
আপনি শিলাইদহ থেকে ৯৩ টি চিঠি লিখেছিলেন। 'ছিন্নপত্রাবলীর 'জন্ম শত র্বার্ষিকী সংস্করণের ২৫২ টি চিঠির মধ্যে এই ৯৩ টি চিঠি আছে। এইসব চিঠিতেই রয়েছে শিলাইদহে র প্রকৃতি -ভূমি -নদী আর মানুষজনদের কথা।
আপনাদের এই কুঠিবাড়ি নিয়ে অনেক গল্প আছে। দোতলা হলদে রঙের বিরাট বাড়ি, আগে এটি এক নীলকর সাহেবের কুঠিবাড়ি ছিল। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলে এটি ঠাকুরবাড়ির সম্পত্তি হয়। শেলী নামের এক নীলকর সাহেব ছিলেন এই কুঠিবাড়ির মালিক। এই গ্রাম ভেসে চলা গড়াই এবং পদ্মা নদীর মিলিত প্রবাহে সৃষ্ট গভীর একটি দহ (ঘূর্ণি স্রোত )থেকে গ্রামটি শেলীদহ নাম, কালের বিবর্তনে শিলাইদহ হয়ে যায়। আপনি বলতেন সমবায় ছাড়া গ্রামগুলিকে বাঁচানো যাবে না। সুদখোর মহজনদের হাত থেকে গ্রামের কৃষকদের বাঁচানোর জন্য আপনি সমবায় পদ্ধতিতে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন, বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে টাকা ধার করে। নোবেল প্রাইজের এক লক্ষ ২০ হাজার টাকা এই ব্যাংকের রেখেছিলেন যাতে প্রজারা এখান থেকে অল্প সুদে টাকা পেয়ে উপকৃত হয়, মহাজনের দেনা শোধ করতে পারে। এখানে স্থাপিত হয়েছিল 'মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র', হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি ও অ্যালোপ্যাথি তিনটি পদ্ধতিতেই এই চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসা হত। বিনামূল্যে কুইনাইন দেয়া হত। আপনি নিজে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন। সত্যি কথা বলতে কী এখনো আপনার এসব কাজ কর্মের খবর লোকে বিশেষ জানে না। সামনেই পঁচিশে বৈশাখ আপনার জন্মদিন। লোকে আলোচনা করবে আপনার গান- কবিতা- গল্প উপন্যাস নিয়ে, কিন্তু এইসব বিষয়গুলো বরাবরই আলোচনার বাইরে থেকে যায়। একটি অভিযোগ আছে আপনার কাছে, আপনার এই কুঠিবাড়ির দেখবার জন্য পর্যটক হিসেবে দর্শনী মূল্যও দিতে হয়। এখানকার মানুষজনদের থেকে আমরা যারা ওপার বাংলার বিদেশি পর্যটকরা এখানে এসেছি তাদের চড়ামূল্যে দর্শনী দিতে হয়েছে। প্রতুল মুখার্জি এক গান বেঁধেছেন আমরা এখন আর কেউ বাঙালি নই, ওপারের আমরা ইন্ডিয়ান, এপারের ওরা বাংলাদেশী। আপনি এর একটা বিহিত করবেন বলে এই চিঠি লেখা। এখানে আসবার সময় আমাদের ট্যুর ম্যানেজার দেখিয়েছিলেন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, আগে নাকি শিয়ালদা থেকে দার্জিলিং মেল পদ্মা নদীর ওপর এই হার্ডিং ব্রিজের ওপর দিয়ে ঝমঝম করে যেতে যেতে আমাদের জলপাইগুড়ি পৌঁছে যেত, তখন কুষ্টিয়া জেলা ছিল না নদীয়া জেলা ছিল। কত কী যে বদলে গেল!
যাক গে, দেশটা ভাগ হয়ে গেলেও তো আপনি তো আর ভাগ হয়ে যাননি। আচ্ছা এই দুই বাংলার যাতায়াত কী ভিসা পাসপোর্টহীন হতে পারে না? আপনার মতামত জানবার অপেক্ষায় রইলাম। আমার শতকোটি প্রণাম নেবেন।
ইতি,
বিনীত ------------------
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴