শিলাইদহ বেড়াতে গিয়ে (২) প্রশান্ত নাথ চৌধুরী
শিলাইদহ বেড়াতে গিয়ে (২)
প্রশান্ত নাথ চৌধুরী
পরদিন ১৬ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩ আমরা সকালে উঠেই দেখলাম , আমার শ্যালিকা কৃষ্ণা এবং তার স্বামী অর্থাৎ মানসবাবু উপস্থিত হয়েছেন। আমাদের হোটেলের ঘরে তাদের বসালাম । আমরাও রেডি হতে থাকলাম।
ট্রাভেল এজেন্সির মালিক আমাদের বারবার বললেন যে 'বারোটার মধ্যে ফিরে আসবেন আমরা এদিক-ওদিক একটু ঘুরে বেড়িয়ে, রংপুর শহর দেখে দুপুর আড়াইটার মধ্যে চলে যাব হোটেল ছেড়ে।' তো আমি উনাকে বললাম 'আমাদের দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করতে হবে না আপনার। আমি আমাদের দিদির বাড়ি যাচ্ছি , দুপুর বারটায় ফিরে আসব।'
রংপুর থেকে সৈয়দপুর যে রাস্তা তা অত্যন্ত ঝকঝকে। কৃষি জমির মাঝে দুই একটা জায়গায় ছোট ছোট কিছু ইন্ডাস্ট্রি, ইটভাটা তাছাড়া এটাই দিনাজপুরের পথ। হাওয়ার গতিতে গাড়ি চলে এলো সৈয়দপুর । জেনে আমার খুব মজা লেগেছিল যে ছোট্ট শহর সৈয়দপুরে একটা বিমান ঘাঁটি আছে ঢাকা থেকে নিয়মিত বিমান যাতায়াত করে। তবে আমার যতদূর ধারণা ওটা আন্তর্জাতিক বিমান ঘাঁটি নয়। দিদির বাড়ি আকারে বিশাল। চারিদিকে লোহার গ্রীল দিয়ে ঘেরা। এই বাড়িতে তো লোক মাত্র চারজন দিদি ,দিদির মেয়ে, তার দুটো বাচ্চা নিয়ে থাকে।
গল্প গুজব করার খুব একটা সময় পাওয়া গেল না। কারণ আমাদের তো আবার ফেরার একটা তাড়া আছে। আমরা নটায় প্রাতঃরাশ করেছি লুচি,তরকারী, বগুড়ার দৈ ও নানা পদের মিষ্টি দিয়ে। আবার আমরা এগারটার সময় খেতে বসেছিলাম, দুপুরের খাবার ফ্রায়েড রাইস, চিকেন ও ইলিশ সহযোগে। অনেকদিন আমার বাড়িতে ব্রেকফাস্ট হয় সাড়ে দশটায় । আমরা তাড়াতাড়ি রওনা দিয়ে মোটামুটি সাড়ে বারোটায় রংপুর পৌছলাম। রংপুর পৌঁছে বুঝলাম যে আমাদের দলবল যারা রংপুর শহর পরিদর্শনে বেরিয়েছে তারা কেউ আড়াই টার আগে ফিরবে না যদিও ওদের সঙ্গে আমাদের ট্রাভেল এজেন্সির গাড়িটা আছে।
আমরাও সাথে সাথে নিজেদের গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম রংপুর পরিদর্শনে। কারমাইকেল কলেজে অনেকটা সময় ছিলাম। গাছের তলায় তরুন তরুনীদের জমজমাট আড্ডা। প্রায়ই প্রতিটি ছাত্রী কিন্তু হিজাব পরিহিতা। অথচ কর্মব্যস্ত শহরের মহিলাদের অধিকাংশ আশ্চর্যজনকভাবে হিজাব বর্জিত। মনে হয়েছিল হিজাব আজকের শিক্ষিতা তরুনীদের স্টাইল স্টেটমেন্ট।
ওদিকে হোটেলে আমাদের অপেক্ষায় ছিল দিদির কন্যা। সে কলেজে পড়িয়ে প্রতিদিন সৈয়দপুর ফিরে যায়। ফিরে দেখা হলো কন্যার সঙ্গে গল্পগুজবে কিছুটা সময়েই কাটল ভালই ।আমাদের দলবল চলে এলো, অনেকেই ছবি তুলছিল নানা কায়দায়।
আমরা দুপুর প্রায় তিনটার সময় বেড়িয়ে পড়লাল বগুড়ার উদ্দেশ্যে। বগুড়ার কাছে নশরতপুর আমাদের আদি বাসস্থান। এখন সেই ভিটায় কলেজ এবং সন্নিকটে কালিবাড়ি । আমাদের বংশের কেউ ওখানে বাস করেন না। রংপুর থেকে এক আইনজীবী জানিয়ছিলেন। কাজেই আমি নশরতপুর ভ্রমনের পরিকল্পনা বাতিল করলাম।
সন্ধ্যায় বগুড়ায় পৌছে আগের মতোই একটা সরকারি মোটেলে ঢুকে পড়লাম। লবিতে অপেক্ষায় ছিল দিদির কন্যা কঙ্কা, ধামাই পিনাকী ও আমাদের ছোট্ট নাতনি। মোটেল কর্মীরা ফুল দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন । আমাদের ঘরে অনেকক্ষন গল্পগুজব চলেছিল। পরদিন কন্যাদের বাড়ি যাব স্থির হয়েছিল।
সকালে উঠেই স্বাভাবিক তৎপরতা শুরু হয়ে যায় আমাদের। সবচেয়ে বিরক্তিকর হলো ব্যাগ গোছানো। ভারি প্রাতঃরাশের পর আমরা চললাম 'বেহুলার বাসর ঘর' লেখতে। মাটির উচুঁ ঢিপি উপরে উঠলাম এদিক ওদিক দেখে কিছু বুঝলাম না। পাশেই মহাস্থান গড়। ছোট ইট দিয়ে তৈরি বিশাল এলাকা ঘেরা রয়েছে। খৃষ্টজন্মের পূর্ব থেকেই এটা ছিল বিভিন্ন রাজ বংশ শাসিত রাজ্যের রাজধানী।
আমরা যখন মহাস্থানগড়ের প্রবেশ করতে যাই সে সময় ফোন এলো আমাদের জামাই পিনাকীর জকাছ থেকে যে সে কাছেই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। আমাদের দলে বেশ কয়েকজন হয়ে গেছিল আমরা দুটো গাড়ি চেপে ওখান থেকে মহাস্থান গড়ের পেছনটায় চলে এলাম । মানে যে জায়গাটায় আমাদের দর্শন করাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আর আমরা যা দর্শন করলাম তার মধ্যে তার ভেতর বিস্তর পার্থক্য ছিল। পিছনে যে জায়গাটায় গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম সেই জায়গাতে যে কত রকম ভাবে একটা শহরকে তার গণ্ডির মধ্যে সব রকম ভাবে সুরক্ষিত রাখা যায় তার একটা চেষ্টা এবং বুনিয়াদ দেখে আমরা সমৃদ্ধ হয়েছিলাম। চলে এলাম এবার কন্যা কঙ্কা বাড়িতে, বগুড়া শহর একবার ঘুরেও দেখা হলো। কন্যার বাড়িতে মিষ্টি এবং দইয়ের যে বহর সাজানো হয়েছিল আমরা তো একদম হতচকিত হয়ে পড়লাম। যাই হোক ওদের আদরে আমরা খুব খুশি হলাম।
আমরা হোটেলে ফিরে এলাম একটু তাড়াহুড়ো করে। আগে থেকেই সকলের ব্যাগটা গুছিয়ে সকালে বেরিয়েছিলাম। আমরা শুধুমাত্র লাঞ্চ করে নিয়ে এবার বেরিয়ে পড়লাম কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে। পথে আমরা নাটোরের রাজবাড়ি দর্শন করেছিলাম, মোটেই সু-সংরক্ষিত নয়। নাটোর আমার মায়ের বাপের বাড়ির দেশ। 'বনলতা ' আর নাটোরে নেই। ওখানকার কাঁচাগোল্লার খুব সুনাম। বালক ব্রহ্মচারীর জন্মস্থান দর্শন করেছিলাম । শুনেছিলাম অনুকুল ঠাকুরের জন্মভিটে বর্তমান সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন মানে সরকার খাস করে নিয়েছেন জায়গা, তবে ওখানে অনুকুল ঠাকুরের বাবা-মার মন্দির আছে এখানে, ধর্মীয় আলোচনার জন্য বিশাল বড় একটা হল আছে। ওই আশ্রমের অতিথিশালাটি সুনির্মিত এবং আয়তনে বিশাল। একজন বয়স্ক মানুষ শ্রী প্রাণশঙ্কর দাসের সাথে দেখা হয়েছিল এবং তিনি আমাদের যত্নের সাথে গোটা আশ্রমটা ঘুরে দেখিয়েছিলেন । যখন ভদ্রলোককে নমস্কার করে জানতে চাইলাম আপনি কতদিন এখানে আছেন উনি বললেন 'কতদিন সেতো আর হিসাব রাখেনি তবে আছি আমি'। জিজ্ঞেস করলাম 'আপনার এখন বয়স কত'? ভদ্রলোক উত্তর দিলেন 'আমি এখন ৮৭', আমি ভদ্রলোককে বললাম 'আপনারা যেভাবে মন্দিরটাকে সাজিয়ে রেখেছেন তা আমাদের সবার জন্য একটা শিক্ষনীয় ব্যাপার'।
একটু রাত করেই আমরা কুষ্টিয়াতে পৌছলাম। সেখানে যে হোটেলে আমরা ঊঠলাম তার নামে দিশা। সেটা আসলে একটি এনজিও পরিচালনা করে থাকেন , অত্যন্ত ভালো ব্যবস্থা বোধহয় ১০ তলা হবে হোটেলটি এবং সুচারুভাবে সাজানো। আমাদের দলের সাথে রান্নার ঠাকুর যোগানদার বাসনপত্র এমনকি প্রাথমিক কিছু বাজার সব সময় মজুদ থাকে। কাজেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কোথাও কোনোভাবে আমাদের কোন অসুবিধা হয়নি বরঞ্চ আতিথেয়তার মাত্রা কোন সময় লাগাম ছাড়া মনে হয়েছিল।
"বাড়ির কাছে আরশি নগর,
সেথা পড়শি বসত করে।"........ লালন সাঁই।
পরদিন সকালে (১৮.০২.২৩) একই রকম ওই সুটকেস গোছানো, বাসে গিয়ে বসা, বাস চলতে শুরু করলো। গাড়ির মধ্যে সবাই মিলে হৈচৈ গান বাজনা এসব চলতে থাকলো, আমরা চলেছি এবার একটা বিখ্যাত জায়গায়। সেটা হচ্ছে সেটা হচ্ছে কুমারখালী উপজেলার ছেউরিয়া নামে একটা গ্রামে এখানে লালন ফকির বা লালন সাঁই যে নামেই ডাকি না কেন সেই বিখ্যাত মানুষটির এখানে সমাধিস্থল, বিশাল বড় একটা এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছে । আছে সেখানে লালন একাডেমী, লালন মিউজিয়াম, সমাধি মন্দির।আছে নৃত্য গীত পরিবেশন করার জন্য একটা উন্মুক্ত জায়গা যার পরিবেশ অত্যন্ত ভালো। আমরা যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখন একদল মানুষ নিবিষ্ট মনে লালন ফকিরের রচিত এবং সুর দেওয়া গান গাইছিল। তাদের ঘিরে বেশ কিছু মানুষজন বসে ছিলেন। আমরা প্রায় 30 জন গিয়ে সেই দলে ভিড় করে দাঁড়ালাম। আমাদের অনুরোধে গান বাজনা চলতেই থাকলো । আমি তো আশ্চর্য হয়ে দেখলাম আমাদের বাড়ির কিছু মহিলা যারা কোনো অবস্থাতে কোনদিনও নাচ-গানে অংশগ্রহণ করেননি, আমি অন্তত দেখিনি তারাও দু বাহু তুলে একেবারে মন খুলে গলা মিলিয়ে গান গাইছেন, নাচ করছেন । আমার মজা লেগেছিল খুব। দেখলাম এক মা এসেছেন তার দুই তরুণ পুত্রকে সাথে নিয়ে প্রায় চার ঘন্টা গাড়িতে চেপে । আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম 'কেমন লাগছে আপনাদের এই মাজার, লালন শাহের সমাধি, কেমন লাগছে' ? উনি বললেন এখানে এলে মনে হয় যেন একটা পবিত্র ভূমিতে এসে দাঁড়ালাম। যেখানে মনের কোন পাপ কোন কলুষতা আর থাকে না এটা একটা পবিত্র ভূমি এটা অনুভব করি ,এটা বিশ্বাস করি'। আমি ভদ্র মহিলাকে নমস্কার করে বললাম 'আমি অন্য দেশ থেকে এসেছি কিন্তু আপনারা ভারতবর্ষের মানুষদের জন্য যে সম্মান ও ভালবাসা জানিয়ছেন তার তুলনা হয় না।' আর ও বলেছিলাম ' বিশেষ করে সংস্কৃতিবান বাঙ্গালীরা সবাই লালন কে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করেন। লালনকে কোন দেশের গণ্ডিতে আটকে রাখা যায় নি, যেমন রাখা যায় না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যেমন রাখা যায় না কাজী নজরুল ইসলামীকে।' নমস্কার জানিয়ে ওই মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। লালন সাঁইকে নিয়ে কত কথা বলার আছে পরে কোনদিন সে কথা বলব।
ওখানে থেকে খুব কাছেই রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহ কুঠি বাড়ি, একই উপজেলা কুমারখালি। লালন ফকিরের কোন ছবি নেই, ছিল একটি স্কেচ যা এঁকেছিলেন গঙ্গাবক্ষে বোটে বসিয়ে জ্যোতিরীন্দ্র ঠাকুর। ছেওড়িয়া থেকে শিলাইদহ তাড়াতাড়ি চলে এসেছিলাম। প্রবেশপথের ডানপাশে পশরা সাজিয়েছে স্থানীয় দোকানদাররা। পরেই বড়সড় একটা মাঠ। সেখানে ইদানিং স্থাপিত হয়েছে একটি মুক্তমঞ্চ ও অদূরেই এক বিপুল সরাইখানা। বামপাশে রয়েছে অতিথিশালা ও প্রশাসনিক ভবন গীতাঞ্জলি ও সোনার তরী।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴