শক্তিরূপিনী মা/সমাপ্তি চৌধুরী
শক্তিরূপিনী মা
সমাপ্তি চৌধুরী
ঋতুর রানী শরতের এক সকাল। কাশফুলের শুভ্রতা আর সাদা মেঘের ভেলা। আকাশের উজ্জ্বল নীলিমার প্রান্ত ছুঁয়ে পাঁজা পাঁজা তুলোর মত মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। চারিদিকে মনমাতানো শিউলির সৌরভ। এই অনুষঙ্গে যে অবয়বটি মনের মধ্যে মূর্ত হয়ে ওঠে, তা হল আমার মা, জগতের মা তথা অভয়দায়িনী দেবী দুর্গা।'দুর্গা' শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল 'দুর্গম' ,অর্থাৎ যা অপ্রতিরোধ্য। জগতের প্রত্যেক নারীর মধ্যেই মা রয়েছেন সুপ্তভাবে। প্রয়োজনমত তাঁর স্বরূপ প্রকাশিত হয়। নারীর যেমন এক রূপ স্নেহময়ী, মমতাময়ী, তেমনই আর এক রূপ রুদ্ররূপী, চণ্ডিকারূপী।
পুরাণমতে,রামচন্দ্র রাবণ বধের পূর্বে দেবী পার্বতীর কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে বিল্ববৃক্ষতলে বোধন করে দুর্গাপুজো করেছিলেন। শরৎকাল দেবপুজোর শুদ্ধ সময় নয় বলে রামচন্দ্রের এই বোধন 'অকালবোধন' নামে পরিচিত। কথিত আছে, রামচন্দ্র দুর্গাপুজো করেছিলেন যাতে দেবী তাঁকে সাহস দিয়ে আশীর্বাদ করেন।
অনুরূপভাবে, আমরাও মায়ের আরাধনা করি মনে সাহস ও শক্তি সঞ্চয় করতে। জীবনে চলার পথে যখনই কোন বিপদের সম্মুখীন হই তখনই মায়ের মুখ স্মরণ করি। আর মনে মনে ভরসা পাই। এই ভরসা, ভক্তির জায়গা থেকেই আমরা বছর বছর মায়ের আরাধনা করি এবং করব। সুস্থ বোধ সম্পন্ন সাধারণ মানুষকে সেটা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অর্থহীন। এই সময়টাতে প্রতিবছর মা মর্ত্যে অবতীর্ণ হন যাবতীয় অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটাতে। যুগে যুগে কালে কালে বিভিন্ন রূপে অসুরেরা সমাজের ক্ষতি করে চলে, আর মা আসেন সর্বশক্তি দিয়ে তাদের বিনাশ করতে, সমূলে উৎপাটিত করতে। এবছরও তার অন্যথা হবে না।
বিদ্রোহী কবি বলে গেছেন---- " বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।" কবি যে কথা বহুবছর আগে বলে গেছেন, আজও সমাজকে বুঝি সেকথা মনে করিয়ে দিতে হবে। নর আর নারী একে অপরের পরিপূরক, একজন কে বাদ দিয়ে অপর জনকে কল্পনা করা যায় না।তাই একের যা অধিকার, অপরেরও তাই অধিকার। সুস্থ ভাবে, সম্মানের সঙ্গে, প্রতিটি মুহূর্তে, প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে নর- নারীর সমানভাবে পথ চলার অধিকার আছে। যুগে যুগে কালে কালে এমনটাই হয়ে আসছে, এমনটাই হওয়া বাঞ্ছনীয়। নারীকে পেছনে ফেলে কখনও কোন সমাজ এগিয়ে যেতে পারে না। কবিগুরুর ভাষায় বলতে হয়-----
"যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে। "
যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা এবং পারিবারিক পুজোয় একসঙ্গে অংশগ্রহণ করার বেশ কিছু স্মৃতি মনের মধ্যে বিচরণ করছে। ছোটবেলায় আমরা সব ভাইবোনেরা মুখিয়ে থাকতাম রথের দিনের জন্য। ওইদিন মিস্ত্রীরা এসে মায়ের কাঠামোয় মৃত্তিকা দিয়ে যেত। তারপর ধীরে ধীরে মায়ের প্রতিমা মূর্ত হয়ে উঠত। দেখতে দেখতেই এসে যেত সেই দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যার দিনটি, অর্থাৎ মহালয়া। সেইদিন থেকেই শুরু হয়ে যেত মায়ের আগমনের উণ্মাদনা। পরিবারের প্রত্যেকে ওইদিনগুলো হৈ হৈ করে মায়ের আরাধনায় মেতে উঠতাম।
পুজোর কটা দিন মায়ের সামনে বসে, মায়ের চরণে অঞ্জলি নিবেদনের মধ্য দিয়ে মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি আসে। মায়ের চোখের দিকে তাকালে যেন সব কষ্ট দূরীভূত হয়। মনে সাহস ও শক্তি সঞ্চারিত হয়। কখনও মায়ের চোখ অদ্ভুত মায়াবী মনে হয়, আবার কখনও বা চামুণ্ডা রূপী ভয়ঙ্করতা লক্ষ্য করা যায়। কথিত আছে মহাষ্টমী তিথি শেষ হয়ে যাওয়ার শেষ ২৪ মিনিট এবং মহানবমী তিথি শুরু হওয়ার প্রথম ২৪ মিনিটকে বলে সন্ধিক্ষণ। এই সময়ে মা মহামায়া ত্রিনয়ন উণ্মীলিত করে চামুণ্ডা রূপে চণ্ড ও মুণ্ড নামে দুই ভয়ঙ্কর অসুরদের নিধন করেছিলেন। দেবীর এই চামুণ্ডা রূপেরই আরাধনা হোক এবছর মণ্ডপে মণ্ডপে, প্রতিটি ঘরে ধ্বনিত হোক এই আহ্বান। অসুরসম নরপিশাচদের মা উপযুক্ত শাস্তি দাও।
"যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴