লিখছি তোমায় যীশু/শ্রুতি দত্ত রায়
লিখছি তোমায় যীশু
শ্রুতি দত্ত রায়
তখন আমার বয়স ছিল বড়জোর সাত অথবা আট। ঠাকুমার ঘরের ব্রিটিশ আমলের কাঠের আলমারীতে রাখা পুরোনো চিঠিপত্রের মধ্যে হঠাৎই একদিন খুঁজে পেয়েছিলাম একটি অন্যরকম ইংল্যান্ড লেটার। তাতে ছাপান ছিল একটি আস্তাবলের ছবি। সেখানে চারপাশে ভেড়ার পালের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন দিব্যকান্তি পুরুষ। মাটিতে বসে ছিলেন এক স্নেহময়ী রমণী। মায়া ভরা চোখে তাঁরা তাকিয়ে ছিলেন একটি সদ্যোজাত শিশুর দিকে। শিশুটির হাসি মাখা মুখটি ঘিরে সূর্যের মতো উজ্জ্বল জ্যোতি। এক আশ্চর্য সুষমা ঘিরে ছিল ওই তিনজন মানুষকে। আর তাঁদের ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেশ কিছু সৌম্যদর্শন পুরুষ। হাতে তাঁদের নানান উপঢৌকন। আস্তাবলের দৃশ্যটি ছিল রাতের। অন্ধকার আকাশে তাই জ্বল জ্বল করছিল হলুদ রঙের নক্ষত্ররা। ওই ছোট্ট বয়সেই ছবিটি দেখে আমার ভারি ভাল লেগেছিল। মা-কে প্রশ্ন করেছিলাম "এরা কারা?" মা উত্তরে জানিয়েছিলেন শিশুটি "ছোট্ট যীশু",,, তোমাকে সবাই "প্রভু" বলে, ডাকে "পিতা" বলে। কিন্তু আমার কাঁচা মনে তোমাকে কিন্তু প্রথম দেখায় বড্ড সুন্দর আদুরে এক শিশু ছাড়া অন্য কিছুই মনে হয়নি। কেমন যেন খেলার সাথী মনে হয়েছে। তোমার কথা আরও বেশি করে জানতে ইচ্ছে হয়েছে। তখনও তুমি আমার কাছে প্রভু বা পিতা নও। বরং বেশ বন্ধুর মত। কারণ আমার রক্ত মাংসের বন্ধুদের মত তোমার জন্মদিনও যে পালন হয়,,, মোমবাতি জ্বালিয়ে, রঙীন কাগজে ঘর সাজিয়ে, কেক কেটে, মজা করে। তার সঙ্গে আছে বুড়ো দাদু সান্টা ক্লজের দেওয়া মন ভালো করা উপহারগুলো। এটাও ভারি মজার ব্যাপার ছিল আমার কাছে। জন্মদিন তোমার, অথচ সাদা দাড়ি, লাল টুপি পরা সান্তা দাদু উপহার দেয় আমার মত ছোটদের। তাই ভারি আশ্চর্যের আর খুশির সময় ছিল ২৫ শে ডিসেম্বর, ছোটবেলা থেকেই।
তার উপর আমরা পাড়ার ছোটরা পাড়ারই এক অধ্যাপিকা মাসীর তত্ত্বাবধানে সাজাতাম "ক্রিশমাস ট্রী"। যদিও সেই সময় এখনকার মত দোকানে দোকানে ফারগাছের রেপ্লিকা পাওয়া যেত না, তবুও তাতেও 'কুছ পরোয়া নেহী' গোছের ভাব ছিল আমাদের। এই উপক্রান্তীয় জলবায়ুর দেশের একটি মফস্বল শহরের ছেলে মেয়েরা তাই টগর গাছের অসংখ্য ডালপালাযুক্ত কোন শাখাকেই ক্রিশমাস ট্রী বলে ভেবে নিতাম। ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ আসার দিন পাঁচেক আগে থেকেই সবুজ মার্বেল পেপার দিয়ে সেই ডালপালাকে ফার গাছের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করতাম। নিজেরাই রূপালী ও সোনালী রাংতা কেটে বানাতাম "স্টার"। পিংপং বল কিনে সেগুলোতে নানা রঙীন নকশা এঁকে ঝুলিয়ে দিতাম গাছের ডালে। ঝুলাতাম লজেন্সও। পিচবোর্ড কেটে, সাদা কাগজ সেঁটে, স্কেচ পেনে রঙ করে বানাতাম সান্তা দাদুর কাট আউট। বরফ পুতুলও বাদ পড়ত না। কাগজের বল বানিয়ে আঠা দিয়ে তুলো সেঁটে দিব্যি তৈরী হত পুতুল। গাছের গায়ে তুলো ছড়িয়ে দিলেই বরফ পড়ত। এভাবেই এক টুকরো শীতকালীন বিদেশ যেন হঠাৎই জায়গা করে নিত বসার ঘরের কোণ জুড়ে। বড়দিনের হিমেল সন্ধ্যায় সেই গাছ ঘিরে জ্বালিয়ে দিতাম বেশ কিছু মোমবাতি। এরপর কাটা হত কেক। এখনকার মত এমন ক্রীম ঠাসা নকশাদার পেস্ট্রীর বাহার ছিল না সেসময়। ছিল স্থানীয় বেকারীর হলুদ সেলোফেন মোড়া কেক। সবাই মিলে মহানন্দে সেটাই ভাগ করে খাওয়া হত। এরপর ছোটরা দল বেঁধে চলে যেতাম পাড়ার ব্যাপটিস্ট চার্চে। চার্চের শান্ত পরিবেশে, মোমের স্নিগ্ধ আলোয়, অর্গানের মিঠে সুরে আমাদের শিশুমন এক আশ্চর্য ভাল লাগায় ভরে উঠত। এভাবেই কচি বয়স থেকেই তোমার জন্মদিন আর তুমি আমার বড় প্রিয় হয়ে গেলে।
কালের নিয়মে একসময় আমিও বড় হলাম। ধীরে ধীরে জানলাম তোমার আরও আরও কথা,,,,, জগতের মানুষকে এক প্রেমময় পবিত্র পৃথিবীর স্বপ্ন দেখানোর কথা। মানুষকে ভালবেসে তোমার মাথায় কাঁটার মুকুট ধারণ করার কথা। জানলাম খ্রীষ্টান, ইসলাম, বৌদ্ধ, জৈন নানান ধর্মের কথা। ক্যাথলিক, ব্যাপটিস্ট, প্রোটেস্ট্যান্ট,,, হাজারো শব্দবন্ধের কথা। জাত-পাতে, মানুষে-মানুষে হিংসা বিভেদের কথা। songs of innocence ছেড়ে গাইতে লাগলাম songs of experience এর গান। আর এখন যখন ঘরে-বাইরের এই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতায় হৃদয় দীর্ণ হয়, রক্তাক্ত হয়, তখনই বার বার মনে পড়ে তোমার কথা। আজ মনুষ্য সমাজে আট থেকে আশি সব বয়সের মানুষই বড় বিপন্ন। যে ভরসা, ভালবাসা ও বিশ্বাসের বাণী তুমি শুনিয়েছিলে, মানুষ তা ক্রমাগত বিস্মৃত হয়ে পড়ছে। তাই তো আজ একটি ছোট শিশুর মন জুড়েও good touch, bad touch এর মত সন্দেহপ্রবণ সচেতনতা। যে চার্চ আজ ঝিকিমিকি টুনি লাইটের আলো আর "জিঙ্গল বেল" এর সুরে আমোদিত হয়, তারই সামনে অভুক্ত পথশিশুরা হাত পেতে দাঁড়ায়। ভ্রূণ হত্যা, গণধর্ষণ, সন্ত্রাসবাদ, যুদ্ধ,,,,,এমন কত কত ঋণাত্মক শক্তি টুঁটি চেপে ধরে মানব সভ্যতার। আজকের পৃথিবী তাই শীতের রাতের কুয়াশার চাদরের মতই স্বচ্ছতাহীন,,,,,সরীসৃপের শরীরের মত শীতল,,,,নানান জটিলতার বিষে দূষিত, কলুষিত।
অসহায় হয়ে আজও তাই তোমার ক্রুশবিদ্ধ ছবির দিকে তাকাই। খুঁজতে চেষ্টা করি সেই অলৌকিক আলোটুকু,,,,যে আলোর সন্ধান একদিন তুমিই এই পৃথিবীকে দেখিয়েছিলে। মানুষ চাইলে সেই আলোর বিভায় আজও আলোকিত হতে পারে সকলের চলার পথ। ভালবাসার করুণাধারায় ধুয়ে যেতে পারে সকল পাপ ... সকল কালিমা। পারে না কি? তুমি ছাড়া এর উত্তর কে দেবে বন্ধু ????
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴