লাল ডাকবাক্স, তোমায় লিখছি/মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
লাল ডাকবাক্স, তোমায় লিখছি
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
আমার প্রিয়
ডাকবাক্স,
সেই কোন ছোট্টবেলা। তুমি ছিলে আমারই মত জীবন্ত লাল টুকটুকে। তোমার মুখের ভিতর জিভ দেখতে পেতাম আমি আর বড়দের খাম ইনল্যান্ড কিংবা পোষ্টকার্ডগুলো কোন গভীরে পেটের ভিতর যত্নে রাখতে! পাড়ার সে তরুণদল ক্লাব ছাড়ানো কালভার্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে এক পায়ে। খেলতে খেলতে অদ্ভুত বিস্ময় জাগত, দাঁড়াবার তো উপায় ছিল না! ছুটছি খেলছি প্রকৃতির মেঘ বৃষ্টি রোদে একাকার হয়ে, বৃষ্টি ভেজা পাতাগুলো তোমাকে ভালোবাসত। সন্ধের অস্পষ্ট অন্ধকারে জানলার দিকে তাকিয়ে মনে হত ঐতো একা ভিজছ তুমি কিংবা দুরন্ত রোদে শুকিয়ে উঠছে লাল রঙ।
খুব ইচ্ছে হত ঐ পাঁচ ছ বছর বয়সেই নিজেই চিঠি লিখে ফেলব তোমার মুখের ভেতর। তখনও জানি না চিঠি লেখা কাগজ খামে ঢুকিয়ে আঠা সেঁটে ঠিকানা লিখলে তবেই পৌঁছয়। কতটা অজ্ঞ ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে ছোট্ট দুহাতে একদিন কোন বন্ধুকে লেখা চিঠি সত্যিই ভরে দিয়েছিলাম তোমার ভিতরে।...তারপর? পিওন দাদুর অপেক্ষা। সত্যিই নেবে তো সে চিঠি! এবার ঠিক কয়েকদিন পরই সত্যি সত্যিই জানলাম চিঠি কীভাবে যায়, কীভাবে আসে, তখন আর লজ্জার সীমা নেই! কাউকে বলিনি সে কথা। সে কাগজ টুকরো পিওন দাদু কোথায় হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছিল না সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল জানি না, মনে আছে পরদিন আপন মনে খুঁজেও এসেছিলাম তোমার একপায়ে দাঁড়ানো সে ঘাসের আস্তরণে।
লাল ডাকবাক্স কবে যে হারিয়ে গেল, হারিয়ে যেতে যেতেই আমরা সমকাল বেড়ে উঠলাম পাশাপাশি। ছোটরা বড় হল, বড়রা আর ও বড়। তাঁরা হারিয়েও গেল।
একই ইনল্যান্ডে ভাগে ভাগে বিজয়া কিংবা নববর্ষের শুভেচ্ছা বা প্রণাম জানানোর সময় ফিকে হয়ে গেল।...নতুন ভাবনাকে স্বাগত জানিয়ে আমরাও অনেকেই হ্যান্ডসেটে 'মেসেজ' লিখি অথবা অন্যান্য মিডিয়ায় শুভেচ্ছার কথা বলি। শুধু বড় পোষ্ট অফিসে ঢুকলেই বড় বড় তিনটে ডাকবাক্স আজ ও দাঁড়িয়ে থাকে। এই সেদিন ও খয়েরি খামে নিজের লেখা অথবা চিঠি ভরে ফেলেছি সেখানে...
কেমন শূন্যতা আর মন কেমনের ঘর। পুরনোরাই নতুনকে স্বাগত জানাই, প্রবল চেষ্টা করি কি ভাবে নতুনের জয় পতাকাতলে দাঁড়াতে পারি! হয় না সবসময়। নতুন হতে গিয়ে মনের ভাঙচুর ও তো কম হয় না! সবটার সাক্ষী থেকেছ তুমি। ঝড়ে জলে বৃদ্ধ সুশীল পিওনের আর না আসা সব অস্পষ্ট করে তোলে চোখ।
সাদা কাগজ বাতাসে ওড়ে। পাগলের মতো যত্ন করি। অক্ষর আসুক নেমে আসুক আর ও। কত তথ্য, কাহিনি মাথায় জমতে থাকে, সাদা পৃষ্ঠার কাছে কলম হাতে বসে পড়ি, কখন ও শূন্যতা জুড়ে থাকে, মাথার কোমল কথাগুলো জটিলতার আবর্তে ঘুরতে ঘুরতে অস্পষ্ট ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে যায়। কালি, কলম, কাগজ কিংবা খাম পোষ্টকার্ড সব কেমন বিদায়ের গান গাইতে গাইতে ডাকঘরের অমলের সঙ্গেই কোথাও অন্ধকারে লুকিয়ে পড়েছে। রাজার চিঠির সন্ধান অমল ঠিক পেয়েছে।
লাল ডাকবাক্স, তোমার জন্য এখন ও তোলা আছে আমার চিঠির সরঞ্জাম। গোপন লেখার সেসব ডায়রীর অক্ষর, প্রথম দিকে কুরিয়ারের ঘেরাটোপে সময়ের নতুনদের দ্রুত পৌঁছনোর পালা। দেখতে দেখতে কেড়ে নিল দ্রুততা...একপলকে পৌঁছনোর ইচ্ছে কথা। চিঠি লেখার অনভ্যাস কচি হৃদয়ের আবেগকে চুরমার করে। চিঠি লেখা হয় কাগজে কালির আড়ালে তোমার অনস্তিত্ত্বে। তবু জানো, আমার মতো কোনো কোনো পাগল এখন ও চিঠি লেখে রাতের গভীরে কিংবা ভোর রাতের পাখির সুরে আর ব্রাউন খাম ক্রমশ পরিমানে কলেবরে বাড়ে। একদিন পোষ্ট অফিসেরই পেট মোটা লাল রঙের লেগে থাকা স্থায়ী তোমার লাল টুকটুকে মুখের ভেতর সে সব ছড়িয়ে জমে উঠবে। বিকেল অথবা সকালের নির্দিষ্ট সময়ে নতুন পিওন ভাই বন্ধ তালা খুলে সে সব চিঠির খবর ঠিক পৌঁছে দেবে দূরে আর ও দূরে...। বক্সা পাহাড়ের দিকে এখন ও যেমন ঝুম ঝুম শব্দ করে চিঠি ঠিক পৌঁছয়...সচল আমার লালচে ডাকবাক্স তুমি। মনকেমনের মেঘ হয়েও বেঁচে থেক লালচে ডাকঘরের অদ্ভুত দেয়ালে।
ইতি শ্রীমতী
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴